শিরোনাম
শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
সা ক্ষা ৎ কা র

‘হুমায়ূনের স্ত্রী কেন চুল কাটাবে’

‘হুমায়ূনের স্ত্রী কেন চুল কাটাবে’
মেহের আফরোজ শাওন। অভিনেত্রী, সংগীতশিল্পী ও পরিচালক— মিডিয়ায় আরও অনেক ক্ষেত্রে বিচরণ তার। এ ছাড়া হুমায়ূনপত্নী হিসেবে আলাদা একটা সত্তা তো রয়েছেই। ব্যক্তি শাওন ও হুমায়ূনপত্নী হিসেবে কখনো কি দ্বন্দ্বে ভোগেন। কিংবা ‘সিঙ্গেল মাদার’ হিসেবে কীভাবে যুদ্ধ করছেন সমাজের সঙ্গে। এ ছাড়া ভক্তদের চাওয়া-পাওয়া তো রয়েছেই। সম্প্রতি তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের স্পেশাল তারকা আড্ডায়। এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে এখানে। তার সঙ্গে কথা বলে সে সব তুলে ধরেছেন— শামছুল হক রাসেল ও সাইফ ইমন। ছবি :  রাফিয়া আহমেদ

 

মেহের আফরোজ শাওন। তার সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলা বা পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তাই শুরুতেই তার ভক্তদের অভিযোগ তুলে ধরা হলো তার কাছে। প্রায়ই শোনা যায় তিনি নাকি অনেকটা মিডিয়াবিমুখ। কেউ কেউ বলেন, মিডিয়াকে এড়িয়ে চলেন তিনি। মুখের কথা শেষ না হতেই জানালেন নিজের অভিব্যক্তি। শাওন বলেন, একটা সময় আমাকে নিয়ে প্রচুর নিউজ হয়েছে। অবশ্যই হুমায়ূন আহমেদের কারণেই এ গুরুত্ব দেওয়া। আর আমাকে যদি গুরুত্ব না দিত তাহলে তো নিউজই হতো না। একটা সময় আমাকে এত বেশি গুরুত্ব দিয়ে নিউজ করেছে যে, তখন অনেক সত্যতা যাচাই-বাছাই করা হয়নি। বলতে পারেন, হুজুগে অনেক নিউজ হয়েছে। যেটা আসলে সত্যি নয়। ফলে আমার মানসিক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি হয়েছি পারিবারিকভাবেও। তার কারণে বলব আমি দুর্ভাগ্যবান। শাওন আরও বলেন, মিডিয়ায় আমি সৌভাগ্যবানও বটে। কারণ ওই জায়গা থেকে পার হয়েছি প্রায় ছয় বছর। আজ যখন একটা লেখা ফেসবুকে দিই সেটাও গুরুত্বের সঙ্গেই ছাপা হচ্ছে। এই যে দ্বি-চারণ বিষয়টি হয়েছে আমার সঙ্গে; তা কিন্তু খুব কম মানুষের সঙ্গেই হয়। আমি খারাপ সময় পার করেছি মিডিয়ার সঙ্গে, একই সময় ভালো সময়ও।

মেহের আফরোজ শাওন এখন আর নিজের মধ্যে নেই... তিনি এখন একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। তাই ভক্তরাও আপডেট থাকতে চান সব বিষয়ে। সবাই জানতে চান শাওন এখন কী করছে, কী ভাবছে। এ বিষয়টা অনেকেই হ্যান্ডেল করতে পারেন না। তাহলে শাওন কী পারছেন? উত্তরে তিনি জানান, খুব সুন্দরভাবেই চেষ্টা করছি বিষয়টাকে গুছিয়ে নিতে। বিস্তারিত জানতে চাইলে শাওন বলেন, এটা খুব সচেতনভাবে মেইনটেইন করার চেষ্টা করি। যদি ১০ জন লোকও পছন্দ করে বা বলে যে, আপু আপনি আমার ইন্সপাইরেশন— সেটাই রেসপনসিবিলিটি। তখন আমার কাছে সত্যি মনে হয়, আমার তো একটা রেসপনসিবিলিটি আছে। কারণ যারা আমাকে দেখে উৎসাহিত হয় তাদের তো আমি ভুল পথে পরিচালিত করতে পারি না। একটা ঘটনা যোগ করা যেতে পারে। ২০১২ সালের পর ২০১৪ বা ২০১৫ সালে ভাইয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম লন্ডনে। সেখানে প্রচুর ফ্যামিলি ছবি তোলা হলো। যেখানে সবাই উচ্ছ্বসিত ছিল। তখন কাছের কিছু মানুষ বলত ‘তুমি ফেসবুকে হাসি হাসি ছবি দিবা না।’ এটা আমি অদ্ভুতুড়ে বলছি। তখন মনে হতো, কেন আমি হাসি হাসি ছবি দিতে পারব না। তখন তারা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করল মানুষ তোমাকে খুশি দেখতে চায় না। হয়তোবা মানুষের একটু খারাপ লাগে যে, এত খুশি কেন! এরকম মানুষ কিন্তু আছে সোসাইটিতে। এখন কথা হচ্ছে, তারা ভুল নাকি আমি ভুল— আমি কিন্তু এখনো জানি না।

 

 

কথায় কিছুটা বিরতি টেনে এবার শাওন বললেন, আপনি জানতে চেয়েছেন যারা আমার কাছ থেকে ইন্সপায়ার্ড হচ্ছে আমি সচেতন কিনা। আসলে তখন মনে হতো এগুলো বন্ধ করে দিব। কিন্তু এগুলো ভণিতা করা হয়ে গেল না? কোনো কারণে হয়তো খুশি, তারপরও আমি আনন্দ প্রকাশ করতে পারছি না। একটা মানুষ সারা দিন যেমন খুশি থাকতে পারে না, তেমনি সারা জীবন দুঃখে থাকতেও পারে না। কিছু কিছু জিনিস থাকে যা মানুষকে সারা জীবন ঘিরে রাখবে। তার মানে সে যদি তার ফ্যামিলিকে নিয়ে সুন্দর সময় কাটানোর পর একটা প্রাণোচ্ছল ছবি দেয় তাতে করে তার বন্ধুরা দুঃখ পাবে— বলবে, কেন তিনি এত খুশি? তারা কি বলবে— হাসবেন্ড নেই, এত হাসে কেন? তখন আমার মনে হলো, না আমি ভুল করিনি। বরং আমি চাই ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠুক। আমি চাই মানুষ তার খারাপ সময়টা শক্তিতে পরিণত করুক।

শাওনকে থামিয়ে জানতে চাওয়া হয়— এ জন্যই কি আপনাকে এখন মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবেও দেখা যাচ্ছে... হা. হা.. হা... কিছুটা হেসে এবার শাওন বলেন, আমার কাছে এই ওয়ার্ডটাকেই মনে হয় খুব নতুন একটা টার্ম। মোটিভেশনাল স্পিকার বলে কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। মূলত আমার ধারণা যারা ইউটিউবার, যারা অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলে মোটিভেট করেছে তাদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভালো কথা বলার জন্য। ইদানীং আমাকেও খুব ডাকে কথা বলার জন্য। এটা হয়তোবা আমি অর্জন করেছি। হয়তো, আমি কোনো না কোনো কর্মকাণ্ডে দুটো মানুষকে ইন্সপায়ার করতে পেরেছি। এ ধরনের অনুষ্ঠানে যারা ডাকে তারা হয়তো একটা রিসার্চ করেই ডাকে। এই জায়গাগুলোতে আমি যখন প্রথম প্রথম যেতাম আমার খুব লজ্জা লাগত। কারণ এর আগে আমি যত অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়েছি সে সব ছিল হুমায়ূন আহমেদ বিষয়ক অনুষ্ঠান। এ কথার জেরে জানতে চাওয়া হয় ব্যক্তি শাওন ও হুমায়ূনপত্নী হিসেবে নিজের অস্তিত্বে কোনো জড়তা রয়েছে কিনা? জানালেন, বিষয়টাকে তিনি খুব এনজয় করেন। তবে একটা দ্বন্দ্ব নাকি থেকেই যায়। শাওন বলেন, দ্বন্দ্বটা

তেমন বড় কিছু নয়। এর জন্য যে খুব ক্ষতি হচ্ছে তা নয়। সেটা হচ্ছে, কিছু কিছু জায়গায় মানুষ যখন আমাকে শুধু হুমায়ূনপত্নী হিসেবে ভাবে তখন তাদের কাছে আমার অনেক কিছু মনে হয়— এরকম না হয়ে তো ওরকম হওয়া উচিত ছিল। যেমন, আমি চুল ছোট করায় অনেকে কষ্ট পেয়েছেন। তাদের মূল কথা ছিল— হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী কেন চুল কাটাবে? তারা কিন্তু বলেনি যে, শাওন আপু আপনি কেন চুল কাটালেন। এখানে যে শুধু সাধারণ ভক্তরা ছিল তা নয়, দুই-একজন বিখ্যাত লোকও ছিলেন। অনেকে বলেছেন, স্যার আপনাকে নিয়ে গান লিখেছেন ‘কন্যার চিরল বিরল চুল’ সেখানে আপনি চুল কাটালেন! আপনি কি জানেন আপনি স্যারের সঙ্গে অন্যায় করেছেন। এটা কিন্তু ফান করে বলেননি। বরং সিরিয়াসলি বলেছেন যে, আপনি কিন্তু স্যারের সঙ্গে অন্যায় করলেন এটা। তখন কিন্তু ঠিক দ্বন্দ্ব বলব না। বিষয়টা আমার কাছে বরং মজাই লেগেছে। তবে ব্যাপারটা এরকম যে, হ্যাঁ এটা কিন্তু আসলেই একটু দ্বন্দ্বের। তবে সব ছাপিয়ে আমি ব্যক্তি শাওন পরিচয়টাও যেমন এনজয় করি, তেমনি আমি মিসেস হুমায়ূন আহমেদ— এই পরিচয়টায় খুব সম্মানিত বোধ করি।

হুমায়ূন আহমেদকে ভক্তরা কতটা ভালোবাসে তা এমনিতেই উপলব্ধি করা যায়। এ ছাড়া তার জন্মদিন বা মৃত্যুদিবসে নানা আয়োজন আরও বেশি মনে দাগ কাটে। কিন্তু শাওন মনে করেন, যেভাবে এ দিবসগুলো উদযাপন করা হয় তা যেন অনেকটাই বাণিজ্যিক টাইপের। এ প্রসঙ্গে শাওন বলেন, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আয়োজন অবশ্যই আড়ম্বরপূর্ণ হওয়া উচিত। কিন্তু যেভাবে করা হচ্ছে তা একটু বাণিজ্যিক টাইপেরই হয়ে যাচ্ছে। প্রথম-দ্বিতীয় বছর যা হয়েছে তৃতীয় বছর যদি একটু অন্যকিছু হতো তাহলে ভালো লাগত। হয়তো আয়োজনটা তিন দিনব্যাপী হলো কিংবা যদি দেখতাম বিষয়টা আরও একটু বড় পরিসরে হচ্ছে, তাহলে আরও ভালো লাগত। ভাবতাম, হুমায়ূন আহমেদকে ভাবার পরিসরটা বিকশিত হচ্ছে। কিন্তু তারপরও হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের একজন হিসেবে আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি। হুমায়ূন বাণিজ্য হলেও হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে হচ্ছে তো। কিন্তু আমি ঠিক এভাবে ভাবিনি। আমি ভেবেছিলাম, ব্যাপারটা কি এরকম হতে পারত না যে, দিনটাকে বলা হলো হুমায়ূনজয়ন্তী। যেমন ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আমরা কি এরকম কিছু করতে পারি না?

আচ্ছা, বাংলাবাজারের একটা রাস্তা কি হুমায়ূন আহমেদের নামে হতে পারে না? কিছুটা থেমে এবার শাওন বলেন, বাংলাবাজারেরই কেন। যে কোনো স্থানেই হতে পারে। হুমায়ূন আহমেদ চাইলেই আমেরিকায় থেকে যেতে পারতেন। তিনি তা করেননি। তিনি চাইলে বিদেশি ভাষায় সাহিত্য রচনা করতে পারতেন। তিনি তা করেননি। আমি প্রত্যেক বছর এ কথাগুলো বলি। এই প্রস্তাবটা আমি অফিশিয়ালি বিভিন্ন সময় বলেছি।  

সামাজিক প্রেক্ষাপটে খুব একটা সহজ নয় সিঙ্গেল মাদারের লাইভ লিভ করা। কীভাবে সামলাচ্ছেন এই কর্মযজ্ঞ— এমনটা জানতে চাইলে শাওন বলেন, প্রতিমুহূর্তে বিষয়টা আমাকে খোঁচা দেয়। বাসায় দায়িত্বশীল একমাত্র ব্যক্তি আমি। এক হাতেই দুই বাচ্চা এবং সংসার সামলাতে হচ্ছে। বাচ্চাদের পরীক্ষা চলছে আর আমাকে বাইরে চলে আসতে হচ্ছে। এটা আমাকে জীবনের প্রয়োজনে করতে হচ্ছে। যে কোনো সমস্যা ও রোগবালাইসহ বিভিন্ন পারিবারিক ঝঞ্ঝাটও আমাকে আগলে রাখতে হচ্ছে। আমি দুদিন অফিসে যেতে পারিনি। ছেলেকে সময় দিতে হয়েছে। কিন্তু অফিসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ পেন্ডিং রাখতে হয়েছে। সিঙ্গেল মাদার বলেই কিন্তু সমস্যাগুলো ফেইস করতে হচ্ছে। শুধু আমি বলে না যে, কোনো সিঙ্গেল প্যারান্টেসের জন্য কষ্টকর।

নিষাদ না নিনিত— কার মধ্যে বেশি তাদের বাবার ছায়া দেখতে পান...  শাওন বলেন, নিষাদের মধ্যে একটু বেশি দেখতে পাই। নিষাদ অনেক ক্রিয়েটিভ। তার বাবা-চাচাদের ছবি আঁকার হাত যেমন খুব ভালো। নিষাদও খুব ভালো ছবি আঁকে। রাইটিংও খুব ভালো। বেশকিছু গল্প লিখেছে। আবার পড়াশোনায়ও খুব ভালো। নিষাদ বই পড়তে খুব পছন্দ করে তার বাবার মতো। আর নিনিতের মধ্যেও কিছু অংশ পাই। তার বাবা যেমন বন্ধুবৎসল ছিলেন সেও বন্ধুবৎসল। হুমায়ূন আহমেদ খুব রসিক ছিলেন। আমার ছোট ছেলেটাও ভীষণ রসিক।

শাওন জানালেন, হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশক আছেন ১৪ জন। তারা এখনো এডিশন করছেন বইগুলো। এর বাইরে মাত্র একজন প্রকাশক হুমায়ূন আহমেদের কিছু সংকলন প্রকাশ করেছেন পরিবারের সবার অনুমতি নিয়ে। তাহলে রয়্যালিটি কীভাবে মেনটেইন করছেন? এর উত্তরে শাওন বলেন, খুব ভালো হতো হুমায়ূন আহমেদ ট্রাস্ট বা ফাউন্ডেশন গঠন করা হলে। যারা হুমায়ূন আহমেদের কি প্রকাশ পাবে আর কি পাবে না তা নিয়ে ডিসিশন দিতে পারবেন। আর রয়্যালিটির কথা যদি বলেন, সেক্ষেত্রে বলব পরিবারের একজন দায়িত্বশীল মানুষ রয়েছেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি প্রকাশকদের একটা চিঠি পাঠিয়েছেন সাকসেশন সার্টিফিকেটসহ। যেখানে লেখা আছে কীভাবে রয়্যালিটি দিতে হবে। শুনেছি সেভাবেই রয়্যালিটি দেওয়া হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশকরা যেভাবে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি সৎ ছিলেন সেভাবে তার পরিবারের প্রতিও সৎ থাকবেন।

মি-টু নিয়ে যদি জানতে চাই মুখ খোলার মতো কিছু আছে কি? হোক সেটা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ— হা. হা.. হা... প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ? ভালোই বললেন। শাওন বলেন, এই আন্দোলনটা আমার কাছে মনে হয় একটা সময়োপযোগী আন্দোলন। মানুষের জীবনের কষ্টের কথা কাউকে না কাউকে বলতে ইচ্ছা করে। সবাই এতে নিষেধ করে। কিন্তু কষ্টের কথাটা বলে ফেলাতেও একটা স্বস্তি আছে। অপরদিকে, যদি প্রমাণের অভাবে কোনো শাস্তি নাও পায় একটা মানসিক শাস্তি ও সামাজিক জড়তা হলেও দোষী পাবে। কিন্তু এখানে একটা ‘কিন্তু’ আছে। আমাদের দেশে একটা পজিটিভ আন্দোলন নষ্ট করে ফেলার অনেক ইতিহাস রয়েছে। তাই সময়োপযোগী এ আন্দোলন যেন কারও অসৎ উদ্দেশ্যে নষ্ট না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে।

সর্বশেষ খবর