মঙ্গলবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

গরুর গাড়িতে করে মুক্তির গান গেয়েছি

গরুর গাড়িতে করে মুক্তির গান গেয়েছি

মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত শব্দসৈনিক তিমির নন্দী। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যিনি কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে যুক্ত থেকে মুক্তিযুদ্ধের গতিকে করেছেন ত্বরান্বিত। এ দেশের আধুনিক গানে রয়েছে তাঁর অসামান্য অবদান। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় - পান্থ আফজাল

 

মহান বিজয়ের মাসে ব্যস্ততা জানতে চাই...

বেশকিছু রেকর্ডিং, লাইভ অনুষ্ঠান রয়েছে। কিছু শো করার কথা আছে। নির্বাচনের কারণে সবখানেই থমথমে পরিবেশ। ১৬ ডিসেম্বরে অবশ্য তিনটি চ্যানেল লাইভ করব। দীপ্ত টিভিতে সকাল ৭টায় দীপ্ত প্রভাতী, এশিয়ান টিভিতে রাত ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত লাইভে থাকব। আর মাই টিভিতে একটি অনুষ্ঠান করার কথা আছে। 

 

বিজয় দিবসকে কীভাবে অনুভব করেন?

বিজয় দিবস আমার কাছে বিশাল ব্যাপার। এটা শ্রেষ্ঠতম অর্জন। নতুন প্রজন্ম তো যুদ্ধ, নৃশংসতা দেখেনি। তাই তাদের কাছে বিজয় দিবসের অনুভূতি কিছুটা ভোঁতা। বিজয় দিবসে আমাদের বড় অর্জন হচ্ছে একটি স্বাধীন মানচিত্র, একটি স্বাধীন পতাকা।

 

মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার ফেলে আসা স্মৃতি সম্পর্কে জানতে চাই।

তখন পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে ছিল যে, সেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব ছিল। মানুষকে উজ্জীবিত করার জন্য কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাটে গান করতাম। গান গাইতে গরুর গাড়িতে করে কুড়িগ্রাম থেকে বগুড়া গিয়েছিলাম পাক হানাদাররা রংপুরে এসে পড়েছিল বলে। গ্রুপে সব সংস্কৃতিকর্মী ছিলেন। কয়েকজন মিলে আসাম গেলাম, সেখান থেকে কলকাতা গেলাম। ফিরে এসে মাকে বোঝালাম। মা বলল, ঠিক আছে যুদ্ধ করবি, তাহলে কণ্ঠ দিয়ে কর! আমি অবাক হলাম, কণ্ঠ দিয়ে আবার যুদ্ধ করা যায় নাকি! পরে বুঝলাম, অবশ্যই যায়। একসময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাওয়ার সৌভাগ্য হলো। সেখানে অনেক পরিচিত মুখের সঙ্গে দেখা। শরণার্থী শিল্পীগোষ্ঠীর দলে ছিলাম। গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করতাম।

 

অনেক স্মৃতি! আচ্ছা, কেন আপনাকে বিশেষ দিনগুলোতেই শুধু দেখা যায়?

আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে তো সারা বছরই ব্যস্ত থাকার কথা! কিন্তু আমাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে  ভেবে নিয়ে শুধু মার্চ, ডিসেম্বর আর শোক দিবসে ডাকা হয়। আমার প্রশ্ন, কেন আমাদের শুধু একটি নির্দিষ্ট সময়ে স্মরণ করা হয়? টিভি, রেডিও বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে সারা বছর কেন স্মরণ করা হয় না? এই নির্দিষ্ট সময়েই যেন আমাদের মতো শিল্পীদের চাহিদা বাড়ে! যেন করতেই হবে তাই ডাকলাম টাইপের! সারা বছর কেউ খোঁজ নেয় না। যাদের কারণে এই স্বাধীন বাংলাদেশ, তাদের কেন এভাবে অবমূল্যায়ন করা হয়?

 

আধুনিক গানের শিল্পী হলেও কেন দেশাত্মবোধক শিল্পী হিসেবে আপনাকে একপেশে করে দেওয়া হচ্ছে?

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবেই আমাকে স্মরণ করে রেডিও, চ্যানেল বা শো আয়োজকরা। আমার দর্শকনন্দিত অনেক আধুনিক গান রয়েছে। সেগুলোর কোনো মূল্যায়ন হয় না। কেন অন্যদের সঙ্গে পার্থক্য গড়ে দেওয়া হচ্ছে? এখন তো আমাদের অনেকেই যে যার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত; স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র দিয়ে নয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হচ্ছে আমাদের অহংকার। ইচ্ছা করলে কেউ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হতে পারবে না। এমন সত্যি কথা ব্যান্ডের বিপ্লবের গানেও ফুটে উঠেছিল।

 

এ কারণেই কিন্তু নতুন প্রজন্ম আপনাদের সম্পর্কে কম জানে...

আমাদের সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম আসলেই খুব কম জানে। প্রত্যেক দেশে নিজেদের জাতীয় সংগীতের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মিউজিক ভিডিও তৈরি থাকলেও আমাদের নেই কেন? কথাগুলো শিল্পী হিসেবে কষ্ট থেকেই বলছি।

 

সেটা ঠিক। আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানগুলোও তো একটা নির্দিষ্ট সময়ে স্মরণ করা হয়...

দেশপ্রেম তো আমাদের সবার মধ্যেই আছে। তবে কেন বিশেষ মাসকে ঘিরেই এমনটা এমন লোকদেখানো আয়োজন? সর্বদাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি বলে আমি মনে করি।

 

প্রায় অর্ধশতক ধরে গান করছেন...

তা সত্যি। রেডিও-টেলিভিশনে গান গাওয়ার প্রায় ৫০ বছর পূর্ণ হবে। কিছুদিন আগে আন্তজার্তিক স্বরলিপির আলোকে ৩টি গান ইংরেজিতে হারমোরাইজ করে দিয়েছি। এর মধ্যে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানও আছে। চারটি স্বরে নজরুলের ‘দাও শৌর্য, দাও  ধৈর্য’ ইংরেজিতে হারমোরাইজ করেছি।  

 

যেভাবে দেশকে দেখতে চেয়েছিলেন...

একটি স্বাধীন দেশে বসবাস করছি এটাই সবচেয়ে বড় বিষয়। এ প্রজন্মের অনেক তরুণই আসলে বুঝতে পারছে না মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস কোনটা? তবে এখনকার সরকারের সময় আমরা সেই আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।

 

সর্বশেষ খবর