শনিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

সম্পর্ক অটুট রাখে বিশ্বাস

সম্পর্ক অটুট রাখে বিশ্বাস

আজিজুল হাকিম ও জিনাত হাকিম। কোনো বিশেষ বিশেষণে বিশেষিত করা যাবে না এ দুই নাট্য ব্যক্তিত্বকে। অভিনয় শিল্পী হিসেবে আজিজুল হাকিম যেমনি আকাশ ছুঁয়েছেন, তেমনি তার সহধর্মিণী জিনাত হাকিমও নাট্যকার হিসেবে বিশেষ একটি অবস্থান দখল করে আছেন। নাটককে অন্য একটি মাত্রা দিয়েছেন তারা। বাংলাদেশ প্রতিদিনের শোবিজ বিভাগের সাপ্তাহিক আড্ডা আয়োজনে অতিথি হয়ে কর্মের দ্যুতি ছড়ালেন দুজন। তাদের বলা কথা বলেছেন আলাউদ্দীন মাজিদআলী আফতাব। ছবি : রাফিয়া আহমেদ

 

বয়স ধরে রাখার জাদুর কাঠি ওর হাতে : আজিজুল হাকিম

আড্ডার শুরুতেই আজিজুল হাকিমের কাছে তার বয়সের চিরসবুজ তারুণ্য ধরে রাখার গোপন রহস্যের কথা জানতে চাইলে এই দম্পতি হাসিতে সরব হয়ে ওঠেন। হাসতে হাসতে আজিজ বলেন, গোপন রহস্য বলে কিছু নেই। নিয়মিত জীবনযাপন, মানে সময়মতো ঘুম, যথার্থ খাদ্যগ্রহণ, খাদ্যাভ্যাস, ঘড়ির কাঁটা মেপে কাজ করা, জীবন থেকে হতাশা আর বিষাদকে দুহাতে দূরে ঠেলে দেওয়া এসব নিয়ম-কানুনকে আপন করে নিতে পারলেই বয়সটাকে চিরসবুজ করে রাখা কোনো ব্যাপার না। আর আমার এই বয়স ধরে রাখার জাদুর পেছনে যার একমাত্র অবদান তিনি হলেন আমার প্রিয় পত্নী জিনাত। তার হাতেই রয়েছে আমার চির সবুজ বয়সের জাদুর কাঠি। হা..হা..হা... পরম তৃপ্তির হাসি হেসে উঠলেন এই সফল অভিনেতা।

 

আমি ওয়েল অর্গানাইজার মাত্র : জিনাত হাকিম

স্বামীর হাসির রেশ ধরে জিনাত হাকিম বলে ওঠেন, আমি নিজের জন্য ডিসিপ্লিন মেনটেইন করতে পারি না। তবে ওর জন্য ওয়েল অর্গানাইজার হিসেবে কাজ করাটা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আসলে ওই যে একটা কথা আছে না, যে অন্যকে কাজ করায় নিয়ম মানায় সে নিজের জন্য কিছু করতে পারে না আমার ক্ষেত্রেও তাই হা...হা...হা...। আর ও বলল আমি ওর সব কিছু গুছিয়ে দেই, সেও কিন্তু আমার সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে দেয়।

 

এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনার : আজিজুল হাকিম

এক পয়লা বৈশাখে আমাদের দুজনার দেখা হয়। ওই যে গানের মতো ‘এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনার’। রমনা বটমূল থেকে বেরিয়ে আমি আমার বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দিচ্ছি টিএসসিতে। ও ওর বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল। ভক্ত হিসেবে জিনাত আমার কাছে অটোগ্রাফ নিতে আসে। সেই প্রথম দেখা। তারপর টেলিফোন নম্বর দেওয়া হলো। তখন তো মোবাইল ছিল না। বাসার টেলিফোন নম্বর দিলাম। সেই টেলিফোনে কথা বলতে বলতে কখন যেন মনে হলো কথা বলতে তো ভালোই লাগছে। মনে হলো বোঝাপড়াটা ভালোই হবে। ওর ক্ষেত্রেও নাকি তাই মনে হয়েছিল।

 

আমরা প্রেম করার সময় পাইনি : জিনাত হাকিম

আমরা আসলে প্রেম করার সময় পাইনি। পরিচয়ের মাত্র ১৫ দিনের মাথায় আমাদের বিয়ের সানাই বেজে উঠল। অল্প সময়ের মধ্যেই আমাকে প্রস্তাব দেয় ও। বলেই ফেলল আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আমারও তখন বিয়ে করার সময়। চাইলেই করতে পারি কারণ ওই সময় বাসা থেকে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। ও বলল আমি যদি প্রস্তাব দিই তোমার পরিবার গ্রহণ করবে তো? আমি তখন চিন্তাও করতে পারিনি, সে আমাকে বিয়ে করতে চাইবে। আমি তো তার ফ্যান ছিলাম। টেলিভিশনে তার নাটক দেখে হাউমাউ করে উঠতাম। তাকে পছন্দ করি। তার অভিনয় পছন্দ করি। একবার ক্যাম্পাসে এসেছিল শুটিং করতে। আমার বন্ধুরা সবাই ডেকে নিয়ে গেল এই দেখ, তোর পছন্দের অভিনেতা। দূর থেকে দেখলাম। বেশ ভালো লাগল। বাসায় গিয়ে সবাইকে বললাম আজ আজিজুল হাকিমকে দেখেছি। অনেক সুইট দেখতে। সে আমাকে বিয়ে করতে চাইবে, ভাবতে পারিনি।

 

বিয়েটা পারিবারিকভাবেই হয়েছিল : আজিজুল হাকিম

 জিনাত আমাকে জানাল

 প্রস্তাবটা পারিবারিকভাবেই দিতে হবে। যেভাবে সামাজিকভাবে হয় আর কী। এরপর পারিবারিকভাবেই  প্রস্তাব দেওয়া হয়। তারাও গ্রহণ করলেন। আমি মিডিয়ার ছেলে বলে অনেকেই তার বাবা-মাকে বলেছিল মেয়েকে কার সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছ? আমাদের সমাজে হয় না; এখনো কিন্তু অনেকে বলে ছেলে কী করে? নাটক-ফাটক করে? তার চাচাতো বোনেরা তার বাবাকে বললেন চাচা সবার মেয়ের ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারের সঙ্গে বিয়ে হয়। আর আপনি দিচ্ছেন নাটকের ছেলের সঙ্গে। তখন তার বাবা গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, সবাই তো দেয় ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারদের সঙ্গে আমি না হয় একটু অন্যকিছু করলাম। নায়ক জামাই কয়জনের ভাগ্যে জোটে? জিনাতের বাবা-মা এই প্রফেশনটাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন। ব্যস, পারিবারিকভাবে আমরা বসে পড়লাম ছাদনা তলায়।

 

আমাদের রসায়নটা দারুণ : জিনাত হাকিম

আমাদের দুজনের মধ্যে রসায়নটা দারুণ। সে আমাকে বোঝে আমিও তাকে...। আমাদের কাজের ধরনটাও একই। আমি নাটক লিখছি সে নির্দেশনা দিচ্ছে, অভিনয় করছে। ইভেন্টগুলোর বিষয়ে আমি অ্যারেঞ্জ করি ঠিকই, তবে আমার পাশে থেকে পুরো সাপোর্ট দেয় হাকিম। দুজনের ব্যস্ততা একই রকম। দুজনের রসায়নটাও দারুণ।

 

আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে হয় নাটক : আজিজুল হাকিম

জিনাতের সঙ্গে আমার যে ক্যামিস্ট্রি, তা হচ্ছে যেহেতু আমরা দুজনই একই ঘরের মানুষ। তাই যে কোনো বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রতিদিন আলাপ-আলোচনা হয়। এ ক্ষেত্রে আমার যদি কিছু বলার থাকে আমি বলি, ওর কিছু বলার থাকলে ও বলে। ও যখন নাটক লিখে তখন থেকেই আমার চরিত্রটাকে ভাবনার মধ্যে রেখে চিন্তা করতে পারে। একসঙ্গে থাকার কারণে এটা সম্ভব হয়। আমি তার কাজ সম্পর্কে জানি, সেও আমার লেখার ধরনটা বোঝে। একসঙ্গে থাকার সুবিধাটা কাজের ক্ষেত্রটাকে আরও সহজ করে দিয়েছে। কাজের ক্ষেত্রেও আমাদের রসায়নটা অনেক ভালো।

 

মঞ্চ দিয়েই অভিনয়টা আমার শুরু : আজিজুল হাকিম

মঞ্চ দিয়েই আমার অভিনয়টা শুরু। মঞ্চে যুক্ত হয়েছি ১৯৭৭ সালে। আরণ্যক নাট্য দলের ‘ওরা কদম আলী’ নাটকে আমার প্রথম অভিনয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যে নাটকের চর্চা, সাহিত্যের চর্চা, সংস্কৃতির চর্চা সেক্ষেত্রে একমাত্র নাটকই এগিয়ে ছিল। বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী একদল মানুষ যারা সংস্কৃতি নিয়ে ভাবেন তারা বিভিন্ন নাট্যদল গঠন করে নাট্যচর্চা শুরু করেন। সেই আন্দোলন একটা পর্যায়ে গিয়ে গ্রুপ থিয়েটারে রূপান্তরিত হয়। এখনো পর্যন্ত আমরা গ্রুপ থিয়েটার চর্চা করছি।

 

বিশ্বাস আর ভালোবাসা হলো সম্পর্কের বন্ধন : আজিজুল হাকিম

প্রায়ই দেখা যায় তারকাদের সংসার সহজেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায়। এ ভাঙন রোধে প্রয়োজন বিশ্বাস আর ভালোবাসা। যে যে ক্ষেত্রেই কাজ করুক না কেন, সব জায়গায় সৎ থাকতে হবে। সততা থাকলে ঝামেলা হয় না। যেমন আমি সারা রাত কাজ করে যখন ঘরে ফিরি তখন সে যদি বিশ্বাস করে আমি সৎ আছি তখন আমারও দায়িত্ব হয়ে পড়ে তার বিশ্বাসকে রক্ষা করা। সবাই যদি বিশ্বাস আর ভালোবাসাকে অক্ষুণ্ন রাখে তাহলে সংসার ভাঙার প্রশ্নই ওঠে না।

 

সংসার ভাঙার জন্য মানসিকতা দায়ী : জিনাত হাকিম

সংসার ভাঙার জন্য ব্যক্তি মানসিকতাই দায়ী। যেমন ধরুন, একটি ছেলে জেনেশুনে একজন মডেল বা অভিনেত্রীকে বিয়ে করল। বিয়ের পর তার কাজে বাধা দেয় বা সমালোচনা করে, তাকে গৃহবন্দী করে রাখতে চায় তাহলে মেয়েটি তো মানসিকভাবে ভেঙেই পড়বে। পরিবার যখন মেয়েটির সুযোগ সুবিধায় বাধা দেবে তখন বাইরে সুযোগ সন্ধানী মানুষরা সেই সুযোগ গ্রহণ করে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে মেয়েটিকে সংসার ভাঙার উস্কানি দেবেই। আর এতে সংসার ভাঙাটা ত্বরান্বিত হয়।

 

ইচ্ছে ছিল সাংবাদিক হব : জিনাত

আমার ইচ্ছে ছিল সাংবাদিক হব। স্কুল জীবন থেকেই লেখালেখি করতাম। কিন্তু অভিনেতা আজিজের সঙ্গে বিয়ের পর নাটকে সুযোগ পেয়ে গেলাম। বেশ ভালো লাগল। সাংবাদিক না হয়ে, হয়ে গেলাম নাট্যকার।

 

দুই নৌকায় পা দিতে চাইনি : আজিজুল হাকিম

প্রচুর প্রস্তাব আসা সত্ত্বেও কমার্শিয়াল চলচ্চিত্রে অভিনয় করিনি। অভিনেতা হিসেবে আমার পরিচয়টা গড়ে উঠেছে নাটকের মাধ্যমে। আমি যদি নাটকের পাশাপাশি

 

ছবিতেও অভিনয় শুরু করতাম তা হলে দুই নৌকায় পা দেওয়ার মতো অবস্থা হতো। সে ক্ষেত্রে কোনো দিকেই সফলতা পেতাম না। তাই নাটকেই এখনো নিজেকে সীমিত রেখেছি। এর মধ্যে অবশ্য মৌলিক ধারার চারটি ছবিতে অভিনয় করেছি। তাও নিতান্তই

 

 

শখের বশে বলতে পারেন।

 

নতুনদের মেধার পরিচয় দিতে হবে : আজিজুল হাকিম

অভিনয় শিল্পীর অভিনয় করাটাই প্রধান কাজ। অভিনয়কে মনেপ্রাণে ভালোবাসতে হবে। এখন টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বাড়ছে। নতুনরা অভিনয়ে আসছে। অনেকেই ভালো করছে। কিন্তু বেশির ভাগই দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পারছে না। একই শিল্পীকে একই চরিত্রে বারবার দেখা যায়। দর্শক একজন শিল্পীকে বিভিন্ন রূপে দেখতে চান। অনেকে শুধু তারকা খ্যাতির পেছনে দৌড়ায়। একজন শিল্পী তার মেধা, অভিনয় ও যোগ্যতা দিয়েই তারকা খ্যাতি অর্জন করতে পারে। নতুনদের প্রতি প্রত্যাশা, তারা এসব বিষয়ে সচেতন হবে। এখন টকনোলজির ব্যাপক পরিবর্তনে কাজের মান উন্নত করা সহজ হয়ে পড়েছে। টেকনোলজির মাধ্যমে কাজকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা থাকতে হবে।

 

মানহীনতায় বাজেট দায়ী : জিনাত হাকিম

বর্তমানে একটি নাটক নির্মাণে টিভি চ্যানেল  যে বাজেট দেয় তা দিয়ে মানসম্মত কাজ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ফলে গল্প, চরিত্র, নির্মাণ সময় থেকে শুরু করে সবকিছুর সঙ্গে নির্মাতাকে আপস করতে হয়। এই আপস করতে গিয়ে কাজটি হয়ে পড়ে মানহীন। ফলে দর্শক ধীরে ধীরে টিভি নাটক বিমুখ হয়ে পড়ছে। তা ছাড়া সিনিয়র শিল্পীদের কেন্দ্র করে গল্প তৈরির প্রবণতা এখানে নেই। সিনিয়র শিল্পীরা অবহেলিত এবং বেকার হয়ে পড়েছে। অথচ পার্শ্ববর্তী ভারতে ‘বেলাশেষে’-এর মতো ছবিতে সৌমিত্র বাবুকে মুখ্য আর বলিউডে ‘পিংক’ ছবিতে প্রধান চরিত্র দিয়ে অমিতাভ বচ্চনকে কাস্ট করা হয়, সম্মান প্রদর্শন করা হয়। দর্শকও তা সানন্দে গ্রহণ করে।

 

শৌখিন নির্মাতা-শিল্পীর কারণেও নাটকে ধস নেমেছে : জিনাত হাকিম

এখন শৌখিন নির্মাতা আর শিল্পীর উপদ্রব বেড়েছ্। তারা কাজের মানের চেয়ে অর্থের দিকে ঝুঁকে পড়ে বেশি। এক সময় এমনটা চিন্তাও করা যেত না। অর্থের দিকে ঝুঁকে পড়ায় কাজের মান কমে যাচ্ছে। ফলে প্রফেশনালরা অবশেনালদের কাছে মার খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ অবস্থা চলতে থাকলে নাটক এক সময় অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।

শুভেচ্ছা

একসময় প্রাণবন্ত আড্ডা শেষ হলো। উচ্ছ্বসিত হাকিম দম্পতি বাংলাদেশ প্রতিদিন পরিবারকে ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা জানিয়ে পা বাড়ালেন চিরাচরিত ব্যস্ততার পথে।

 

সর্বশেষ খবর