শনিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

অমিল থাকা সও্বেও আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি

অমিল থাকা সও্বেও আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি

থিয়েটার, টিভি নাটক আর চলচ্চিত্রে দুজনই সমান জনপ্রিয়।

একই অঙ্গনে কাজ করার সুবাদে হয়েছিল পরিণয়। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে একই ছাদের নিচে করছেন সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি। টিভি মিডিয়ায় আশির দশক থেকে বর্তমানের সেতুবন্ধনে যাদের রয়েছে অসামান্য ভূমিকা, তারা হলেন শোবিজ অঙ্গনের জনপ্রিয় দুই মুখ শহীদুজ্জামান সেলিম এবং রোজী সিদ্দিকী। এবার বাংলাদেশ প্রতিদিনের শোবিজ বিভাগের আড্ডা আয়োজনে অতিথি হয়ে তারা এসেছিলেন। এই গুণী তারকা দম্পতির সঙ্গে খোলাখুলি সেই আড্ডা তুলে ধরেছেন আলী আফতাব ও পান্থ আফজাল, ছবি : রাফিয়া আহমেদ

 

অনেক দিন থেকেই এই তারকা জুটির সঙ্গে সময় মেলাতে কষ্ট যাচ্ছিল। শুটিং ও বাড়ি বদলের ব্যস্ততায় তা আর সম্ভব হচ্ছিল না। এবার তারা সম্মতি দিলেন। এই সম্মতির পেছনেও কারণ আছে, এখন তারা আমাদের প্রতিবেশী! সম্প্রতি তারা বসুন্ধরায় বাসা শিফট করেছেন। তাই এই সপ্তাহের ফ্রাইডে আড্ডায় নিমন্ত্রণ করতেই বিন্দুমাত্র সময়ক্ষেপণ না করেই দুজনেই নির্দিষ্ট দিনে অফিসে হাজির। কনকনে এই শীতের মুহূর্তে রৌদ্রের উত্তাপ গায়ে মেখে দিনের মধ্যভাগে তারা ঠিক সময়ে উপস্থিত। সাদা কুর্তির ওপরে কালো জ্যাকেট গায়ে ভিজিয়ে সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরে উঠলেন রোজী সিদ্দিকী। সারা মুখে ভুবন-ভুলানো সেই মিষ্টি হাসি। তার সঙ্গী শক্তিশালী অভিনেতা ও জীবনসঙ্গী শহীদুজ্জামান সেলিম। পরেছেন হালকা অ্যাশ রঙের ব্লেজার। শোবিজ টিমকে দেখেই দিলেন এক শুষ্ক হাসি। শীতে বেজায় ঠোঁট ফাটলে আমরা যেভাবে হাসি দেই ঠিক তেমন! কনফারেন্স রুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই বলতে শুরু করলেন, ‘একসময় এমনই সুন্দর পরিবেশ ও সুসম্পর্ক শিল্পী ও সাংবাদিকদের মধ্যে ছিল। দুই জগতের মানুষ বিভিন্ন আড্ডায় একাত্ম হয়ে যেতাম। এখন সেটা খুবই কম দেখা যায়। তাই আজকের এই আসাটা আমি মনে করি দুজনের জন্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’ রোজী সিদ্দিকীর কথায়ও সেই একই সুর। ‘আধুনিকতার রহস্যময় মোড়কে আমরা শিল্পী ও সাংবাদিকরা যেন মুখ লুকিয়ে আছি। কাজের ব্যস্ততা আর যানজটের কারণে আড্ডা দেওয়ার মন-মানসিকতা আমরা হারাতে বসেছি। এখন শিল্পীর সঙ্গে সাংবাদিকদের যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে পড়েছে ফোন ও সামাজিক মাধ্যম। এসবের কারণেই দুই জগতের মানুষের সঙ্গে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। শিল্পী ও সাংবাদিক যদিও একে অন্যের পরিপূরক।’ এই কথার রেশ ধরে শহীদুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘শিল্পী তৈরির পেছনে সাংবাদিকদের পৃষ্টপোষকতা বা সাপোর্ট খুবই দরকার। আগে শিল্পীর সঙ্গে সাংবাদিকের এমন সম্পর্ক ছিল যে, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বাড়ি চিনত, নিমন্ত্রণ করত, একসঙ্গে আড্ডা দিত, বন্ধুর মতো সব কিছু শেয়ার করত। এখন অনেকেই আছেন যারা অল্পের মধ্যেই সেরে ফেলতে চান; সেটা ফোন করে। আবার অনেকেই আছেন তারা কিন্তু শিল্পী সম্পর্কে জেনে, স্টাডি করে তবেই কিন্তু ইন্টারভিউ করেন। যারা পুরনো তারা তো জানেনই! একজন শিল্পী সম্পর্কে কেউ যদি জেনে প্রশ্ন করে তবে শিল্পীর মনে এক আনন্দের শিহরণ জাগে। এটার রেশ ধরে রোজী আপা কি কিছু বলবেন? ‘সেলিম আসলে যেখানে বসে সেখানে আমার বলার জায়গা খুবই ক্ষিণ! তবে কেউ যদি পরিচয় দেয় আমি সাংবাদিক, শিল্পী হিসেবে আমি তাকে মূল্যায়ন করতে চাই। তবে যখন দেখি তার জানার বিষয়টা বা প্রফেশনাল দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ, তখন  খুবই বেদনা অনুভব করি। যখন দেখি কিছুই জানে না; অথচ সে আমাকে প্রশ্ন করছে। আবার এমনও দেখি, অনেকে এমন কারও ইন্টারভিউ নিচ্ছে যাকে শিল্পী বললে ভুল হবে। আমি কিন্তু ছোট করছি না কাউকে। এটা মেনে নিতে পারি না বলেই বলছি। কারণ, একটা শিল্পী শব্দের ওজন অনেক বেশি।’ তাদের দু’জনের কথার মধ্যে অনেক খেদ ধরা দিল। বোঝা গেল শিল্পী আর সাংবাদিকের মধ্যেকার সেই সম্পর্ক আর আগের মতো নেই। শহীদুজ্জামান সেলিম আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আমাদের দেশের কিছু দৈনিক আছে, যার হাফ পেজ জুড়ে থাকে বিনোদন। তার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ খবর থাকে বলিউডের। সেখানে একটা দায়সারা গোছের আমাদের দেশীয় খবর থাকে । আবার অনেক শিল্পী পত্রিকার পাতাজুড়ে থাকে, যাকে অনেকে চেনেই না।’ তার কথার সঙ্গে যোগ করে রোজী সিদ্দিকী বলতে শুরু করলেন, ‘যে শিল্পীকে কেউ ফোনে পাচ্ছে না, সেও কল ব্যাক করছে না। কারণ কী! কারণ তারা সঠিক পদ্ধতিতে শিল্পী হয়ে গড়ে ওঠেনি। রাতারাতি শিল্পী হয়ে ওঠার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে কিছু বেনামী অভিনয়শিল্পী মিডিয়াকে বেছে নেয়। তবে কিছু পত্রিকাকে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই, এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও দেশীয় সংস্কৃতিকে তারা তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।’ তাদের দুজনের ভারী ভারী বক্তব্যকে হালকা করার প্রয়োজনেই রোজী সিদ্দিকীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন, ‘থিয়েটারের শুরু কবে ও কেমন করে? তিনি বলতে শুরু করেন ‘আমি ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় ফঁাঁকিবাজ, তবে অন্যান্য কাজে খুবই এক্সপার্ট। আমি বেড়ে উঠেছি পাড়া কালচারে। সিদ্দিকবাজারে আমার জন্ম। শৈশবটা ওখানটায় কাটলেও বেড়ে ওঠা মতিঝিলে। মতিঝিলের স্কুলে পড়াশোনার সময়ই নাচে হাতেখড়ি হয়। ১৯৮৯ সালের দিকে মমতাজউদদীন স্যারের হাত ধরে ‘থিয়েটার আরামবাগ’-এর সঙ্গে যুক্ত হই। উনি আমাকে নিজের মেয়ে মনে করতেন। স্যারের হাত ধরেই আমার বিটিভিতে এনলিস্টেড হওয়া। তার আগে আমি মতিঝিল সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিশু সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ১৯৯৩ সালে শহীদুজ্জামান সেলিমের সঙ্গে বিয়ের পর ঢাকা থিয়েটারেও যোগ দিই।’ এবার শহীদুজ্জামান সেলিমের পালা। তিনি যোগ করলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন যুক্ত হই নাট্য আন্দোলনে। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ সালে ঢাকা থিয়েটারে মঞ্চ অভিনেতা হিসেবে যোগ দেই। এখনো আছি, তবে অনিয়মিতভাবে।’ কথার মাঝে ঢুকে পড়ে রোজী সিদ্দিকী বলতে শুরু করেন, ‘আমি তখন থিয়েটার (আরামবাগ) করতাম। আর সেলিম ছিল ঢাকা থিয়েটারে। তারা আড্ডা দিত ফরিদী ভাই, বিলু ভাই, খায়রুল ইসলাম বাকী ভাই, সূর্বণা আপা, আসাদ ভাই, কামাল ভাই, ফারুক ভাইসহ অনেকেই। ওরা বেইলী রোডের মহিলা সমিতির বারান্দায় আড্ডা দিত। আমরা তাদের বাঘের মতো ভয় পেতাম। তবে ঢাকা থিয়েটারে সুর্বণা আপা আমাকে প্রথম থেকে কাপড় পরিয়ে দিতেন। খুবই আদর করতেন আমাকে।’ আপনাদের প্রথম পরিচয়, প্রেম, বিয়ে কীভাবে হলো? রোজী সিদ্দিকী বক্তব্যকে টেনে নিয়ে বললেন, ‘আমি সেলিমকে কখনোই প্রপোজ করিনি। আমি তাকে এতই ভয় পেতাম! আর সেই সময় ওদের সবাই খুবই শয়তান ছিল। আমি ছিলাম লালটু-গল্টু। রাক্ষুসী নাটকে আমাকে হিন্দু বৌ সাজতে হতো। লাল টুকটকে সিঁদুর পড়তাম। ওরা তাই এটা দেখার জন্য আমাকে দেখতে চাইত। তবে আমি যখন টেলিভিশনে রাবেয়া খাতুনের ‘মোহর আলী’ নাটকে কাজ শুরু করি। সেই নাটকে সেলিম আর আমি অভিনয় করি। ওই নাটকের সবাই সবসময় পলিটিক্স করত আমাদের নিয়ে। চাইতো যে দুজনের সঙ্গে একটা ভাব হোক। আসলে আমাদের সম্পর্ককে বলা যায় যৌথ প্রযোজনার রিলেশন। মানে হলো সবার চেষ্টা যে, এই দুইটাকে কীভাবে এক করা যায়। একবার এমন হয়েছে যে, একটি দৃশ্যে ছিল নৌকার সিন। তো দুজনকে উঠিয়ে দিয়েছে সবাই। অনেকক্ষণ হওয়ার পরও কাট আর কেউ বলে না। এরকম বদমাইশ ছিল তারা। তবে আমি এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমার আর সেলিমের রিলেশন নিয়ে বাংলাদেশের সব দর্শক খুবই খুশি ছিল।’ আপনারা কি খুশি ছিলেন না? প্রশ্নটা খপ করে ধরে নিয়ে সেলিম উত্তর দিলেন, ‘মিথ্যা বলবো না, অবশ্যই খুশি । ৯১ বা ৯২ এর দিকে রোজীকে আমি দেখেছি। ও তখন তরুণ নাট্যকর্র্মী। তখন রিহার্সেল শেষ হলে প্রতিদিন ঢাকা থিয়েটার ও নাগরিক মহিলা সমিতির বাইরের সিঁড়ির দুই পাশে বসে আড্ডা দিত। রোজী আরামবাগ থিয়েটারে কাজ করত। সাত ঘাটের কানাকড়ি দেখি তখন, তবে রোজীর শো দেখিনি। দেখেছি মেমীর শোটা। আমি ওকে পাই রাক্ষুসীতে। তবে রোজীর সঙ্গে আমার ভালো করে পরিচয় নাটক মোহর আলীতে। সেই নাটকে লক্ষ করি, রোজী খুব সুন্দর দেখতে। তখন আমার জীবনে একটা ট্্রানজিশন চলছিল। ভেবেছিলাম কখনো বিয়েই করব না। তবে ওকে ভালো লেগে যায়। তাকে ডেকে একদিন বললাম, তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। তুমি যদি রাজী তাহলে তোমাকে বিয়ে করতে পারি। তখন রোজী বলে, আপনি আমার বাবা-মার সঙ্গে কথা বলেন।’ তারপর কী করে রাজী করালেন? ‘আমি একদিন প্রস্তাব নিয়ে ওর বাবার কাছে যাই এবং বলি, আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। আর যদি বিয়ে নাই দেন, তাও আমরা বিয়ে করে ফেলব। তিনি অনেকক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেন, ঠিক আছে আমি এই বিষয়ে একটু ভেবে দেখি। অবশেষে বিজয় নিশ্চিত করতে আমরা ১৬ ডিসেম্বরকে বিয়ে করার জন্য মনস্থির করলাম।’ প্রায় ২৫ বছর এক ছাদের নিচে।’ দুজনের মধ্যে বোঝাপড়ায় কোনো সমস্যা হয়? অনেক অমিল থাকা সত্তেও, আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি। এটা হলো একটা অলিখিত বোঝাপড়া। আমি আর রোজী দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে সংসার করছি। দুজনের মধ্যে বোঝাপড়ায় সমস্যা হলে এই দীর্ঘ সময় ধরে কি একই ছাদের নিচে থাকতে পারতাম? সে আমাকে বোঝে, আমিও।  শহীদুজ্জামান সেলিমের অভিনয় জীবনের অনেকটা জুড়ে আছে হুমায়ুন ফরিদীর নাম। হুমায়ুন ফরিদীর প্রসঙ্গ আসতেই শহীদুজ্জামান সেলিম বলতে শুরু করলেন, ‘ফরিদী ভাই মজার মানুষ ছিলেন, তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব মাথায় মাথায়। আড্ডা হতো প্রায় দিনই। তাকে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। তাকে চূড়ান্তভাবে মিস করি। আমার জীবনে তিনি সিংহভাগ জায়গা দখল করে আছেন। রোজীর সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার ব্যাপারেও ‘ফরিদী ভাইয়ের অবদান অনেক। আমি যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করি তিনি তখন নাট্য সম্পাদক ছিলেন। আমার থেকে ৪ বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু ছিলেন সবচেয়ে কাছের বন্ধুর মতো। আমার যত বড় বড় মঞ্চের চরিত্র পাওয়া-তারই অবদান।’

বিষাদ ছেড়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে শহীদুজ্জামান সেলিমের দিকে প্রশ্ন? চলচ্চিত্র নিয়ে সামনের পরিকল্পনা কী? ‘তেমন করে তো পরিকল্পনা করি না। তবে কিছু চলচ্চিত্র ও ওয়েব সিরিজে কাজ করেছি। কিছু করার কথা চলছে। অনন্য মামুনের ইন্দুবালায় কাজ করেছি। সৈকত নাসিরের একটি ফিল্মে কাজের জন্য কথা হয়েছে।’ সেলিমের উত্তর শুনেই রোজী সিদ্দিকী চলচ্চিত্রে তার কাজের ফিরিস্তি দিলেন, ‘তেমন করে কাজ করা হয়নি। ১৯৯৫ সালে করেছিলাম লাভ স্টোরি- প্রেমের গল্প, এরপর কমন জেন্ডার আর মেড ইন বাংলাদেশ।  এরপর করা হয়ে ওঠেনি। তবে ভালো গল্প, নির্মাতার কাজের অফার এলে করব।’ এদিকে দীর্ঘ সময়ের আড্ডায় দুজনের মধ্যে অ™ভুত কিছু মিল ও অমিল খুঁজে পাওয়া গেল। রোজী ও সেলিম দুজনেই রাগী। রোজী বেশি কথা বলে, সেলিম কম। তবে সিনেমা, মিউজিকে পছন্দের ক্ষেত্রে দুজনের চয়েজই ভিন্ন। তবে যে যেটাই পছন্দ করুক না কেন, সেটাকে দু’জনেই রেসপেক্ট করেন। তাই সবার মতো একই চাওয়া, ‘ভালোবাসারা বেঁচে থাক’!

সর্বশেষ খবর