রবিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

সিনেমা নির্মাণে ঝোঁক নেই কারও

আলাউদ্দীন মাজিদ

সিনেমা নির্মাণে ঝোঁক নেই কারও
ছবি নির্মাণে তেমন কারও ঝোঁক নেই। বেশির ভাগ আসে বন্ধু-বান্ধবীদের খুশি করতে। টাইম পাস করার জন্য চলচ্চিত্রকে বেছে নেয় তারা। দু-একজন মেয়ে নিয়ে একটি ফাইভস্টার হোটেলে সিটিং দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে শুরু হয়ে যায় মনোবাসনা পূরণের কাজ।

 

‘এখন বেশির ভাগ প্রযোজক চলচ্চিত্র ব্যবসার মানসিকতা নিয়ে এই অঙ্গনে আসেন না। এদের অনেক টাকা আছে। সেই টাকার কিছু দিয়ে সিনেমা নির্মাণের নামে নায়িকা নিয়ে ফূর্তি করা আর পত্রিকা-টেলিভিশনে নিজেদের ছবি ও নাম দেখাতেই নামেমাত্র ছবি নির্মাণে আসেন। এর ফলে সেই ছবি আর ছবি হয়ে ওঠে না। মানহীন দু-একটি ছবি নির্মাণ বা মহরত করার মাধ্যমে নিজের স্বার্থ হাসিল করেই কেটে পড়েন তারা। এ কারণেই বর্তমানে চলচ্চিত্র শিল্পের এমন দৈন্যদশা চলছে।’ এমন ক্ষোভ প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মালেক আফসারীর। দীর্ঘদিন কর্মশূন্য থাকার পর শাকিব খান আর ইকবালের প্রযোজিত একটি ছবি নির্মাণে সম্প্রতি ফিরেছেন তিনি। তার কথায়- এখন আসলে ছবি নির্মাণে তেমন কারও ঝোঁক নেই। বেশির ভাগ আসে বন্ধু-বান্ধবীদের খুশি করতে। টাইম পাস করার জন্য চলচ্চিত্রকে বেছে নেয় তারা। দু-একজন মেয়ে নিয়ে একটি ফাইভস্টার হোটেলে সিটিং দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে শুরু হয়ে যায় মনোবাসনা পূর্ণের কাজ। এভাবে চলতে থাকলে প্রকৃত অর্থে চলচ্চিত্র নির্মাণ কীভাবে হবে? মালেক আফসারী আরও বলেন, চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য শীর্ষ সংগঠন হলো চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি। এই সমিতিরই অস্তিত্ব নেই দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। সমিতিটি মৃত থাকায় প্রযোজকও আর আসেন না, চলচ্চিত্রকারদের স্বার্থও সংরক্ষিত হয় না। ফলে চলচ্চিত্র নির্মাণ বলতে গেলে একদিকে কমছে আরেকদিকে মানহীন হচ্ছে। মালেক আফসারীর বক্তব্যকে সমর্থন করে আরেক নির্মাতা শাহাদাৎ হোসেন লিটন যিনি নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে নির্মাণে নিয়মিত ছিলেন এবং ২০০০ সালের পর কাজের অভাবে অন্য ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বলেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ মানে একটি টিম ওয়ার্ক। একজন নির্মাতার গল্পকার, সংগীত পরিচালকসহ শিল্পী কলাকুশলী নির্দিষ্ট থাকে। এর ফলে সেই নির্মাতা

কী চান তা সবাই সহজে বোঝে এবং সূচারুভাবে কাজটি সাধন হয়। এ অবস্থা এখন আর নেই বলেই ছবি আর পূর্ণাঙ্গ ছবি হয়ে ওঠে না। যথার্থ ছবি নির্মাণ না হওয়ার আরেকটি কারণ হলো- এখন যারা এ বিষয়ে লেখাপড়া করে নির্মাণে আসছেন তারা তাদের জ্ঞান শুধু পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছেন, প্র্যাকটিক্যালি কাজটি শিখছেন না। ফলে তার নির্মিত ছবি হয়তো দেশ-বিদেশে পুরস্কার পায় কিন্তু দর্শক গ্রহণযোগ্যতা পায় না। ফলে সেই নির্মাতা আর নির্মাণে নিয়মিত হতে পারেন না। এমন অনেক কারণে দর্শক আর নির্মাতা ও ছবির মধ্যে দীর্ঘ দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। ফলে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র আর পূর্ণতা পাচ্ছে না। এ ছাড়াও এখন ডিজিটাল প্রজেক্টরের নামে সিনেমা হলে হোম থিয়েটার দিয়ে ছবি প্রদর্শনের নামে যেভাবে প্রতারণা চলছে তাতে পর্দায় স্বচ্ছ ও নিখুঁত ছবি দেখতে না পেয়ে বিরক্ত দর্শক সিনেমা হলবিমুখ হচ্ছেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিনিয়র চলচ্চিত্র প্রযোজক বলেন, চলচ্চিত্রের স্বার্থে গড়ে উঠেছিল নানা সমিতি। এসব সমিতি এখন শুধু গল্প-আড্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সমিতির কাজ চলচ্চিত্র নির্মাণ কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, নির্মাতা, শিল্পী কলা-কুশলীদের অধিকার কীভাবে সংরক্ষণ করা যায় তা নিয়ে এর কর্তাব্যক্তিদের কোনো মাথাব্যথা নেই। দুই বছর মেয়াদি চেয়ারে বসে স্বার্থ হাসিল, পিকনিক আর নানা অনুষ্ঠানের নামে চাঁদাবাজি করেই ক্ষান্ত হয়। মানে চলচ্চিত্র সমিতি থেকে চলচ্চিত্র শব্দটি মাইনাস হয়ে এটি শুধুই সমিতিতে পর্যবসিত হয়েছে। ফলে প্রকৃত অর্থে চলচ্চিত্র নির্মাণ আর হচ্ছে না। শতকরা ৯৫ জন প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পী ও কলা-কুশলী এখন বেকার। তারা কাজের অভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকে ভিক্ষাবৃত্তির মতো পেশা বেছে নিয়েছেন। এর সঙ্গে বর্তমানে যোগ হয়েছে তারকাদের রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডে ব্যাপক হারে অংশগ্রহণ ও নির্বাচনমুখী হওয়া। পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবির অভাবে নব্বই দশকের শেষ ভাগে দেশে থাকা প্রায় ১ হাজার ৩০০ সিনেমা হল কমে এখন ২৫০-এ ঠেকেছে। সিনেমা হল মালিকরা ব্যবসা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় আছেন। মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার ইফতেখার নওশাদ বলছেন, বছরে হুট করে দু-একটি ছবি ব্যবসা করলে তা দিয়ে তো একটি সিনেমা হল চালানোর মতো সারা বছরের খরচ উঠে আসে না। বিদেশি ছবি আমদানিও নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় সিনেমা হল টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতির উপদেষ্টা মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, নির্মাতারা ছবি দিতে পারছেন না, অথচ সিনেমা হলের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। কন্টেন্ট যদি না থাকে তাহলে সিনেমা হল বা সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করে কী লাভ হবে। বছর দুয়েক আগে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু সিরাজগঞ্জে একটি অত্যাধুনিক সিনেপ্লেক্স নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু ছবির অভাবে এক বছর পূর্ণ না হতেই সেটি লোকসান গুনে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। তাই আগে কন্টেন্ট দিতে হবে। পরে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা উচিত। এমন অনেক কারণেই শিল্পটি এখন স্থবির হয়ে পড়েছে। সরকারি অনুদানের অর্থ নিয়ে সব সময়ই নয়ছয় চলে। এতে সরকারি অর্থের অপচয়ই শুধু হয়, মানসম্মত ছবি নির্মাণের উদ্যোগ আর বাস্তবায়ন হয় না। যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ কেন হচ্ছে না? এমন প্রশ্নে চলচ্চিত্র নির্মাতা অনন্য মামুন বলেন, এই ধারার ছবি নির্মাণে নতুন যে নীতিমালা তৈরি হয়েছে তাতে কাজ করা কঠিন। বাংলাদেশি অংশের ছবির স্বার্থে এ নীতিমালা সংশোধন করা দরকার। চলচ্চিত্র এডিটরস গিল্ডের সভাপতি আবু মুসা দেবু বলেন, এমনিতে প্রযোজক সমিতি অকার্যকর। তার ওপর সমিতির গঠনতন্ত্র মতে, সিনিয়র প্রযোজকদের সদস্যপদ বাতিল করা হয়। এতে উৎসাহ হারিয়ে মান-সম্মান বাঁচিয়ে এই অঙ্গন থেকে দূরে সরেছেন সিনিয়র খ্যাতিমান প্রযোজকরা। ফলে ভালো ছবি নির্মাণ এখন কেবলই স্বপ্ন। শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ নির্মাতার অভাবেই এ দুরবস্থা চলছে। একজন শাকিব খান দিয়ে আর কতদিন চলবে। নতুন শিল্পী শুধু এলে চলবে না। তাদের অভিনয় দক্ষতা আর কাজ দরকার, যা নেই বলে নতুনরা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন না। গল্প, নির্মাতা, শিল্পীর অভাব এবং পাইরেসির আগ্রাসনে বড় মাপের প্রযোজনা সংস্থাগুলো আর নির্মাণে আসতে পারছে না। চলচ্চিত্র প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু বলেন, প্রযোজক যদি মূলধনই ফেরত না পান তা হলে চলচ্চিত্র ব্যবসায় বিনিয়োগ করবেন কেন। আগে হিট আর ফ্লপ বলে দুটি শব্দ ছিল। এখন কোনোটিই নেই। মানে ছবি চলেই না। নির্মাতা, গল্প ও শিল্পী নেই। নকলের নৈরাজ্য আর পুরনো ফর্মুলা থেকে এখনকার নির্মাতারা বেরিয়ে আসতে পারছেন না। আমরা গল্পের জন্য প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হকের মতো গল্পকারদের কাছে যাই না। সিনেমা হলের পরিবেশ নেই। ডিজিটালের নামে চলছে প্রতারণা। ইলেকট্রনিক প্রজেক্টর বসিয়ে প্রযোজকের কাছ থেকে নানাভাবে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যদি পুরো মাত্রায় ডিজিটাল ও সেন্ট্রাল ব্যবস্থা চালু করা যায় তাহলে একদিকে দর্শক স্বাচ্ছন্দ্যে ছবি দেখতে পারবেন, অন্যদিকে পাইরেসি ও প্রতিনিধির দ্বারা চুরি বন্ধ হবে। রেন্টাল কমাতে হবে। সরকার, চলচ্চিত্রকার ও সাধারণ মানুষ মিলে টার্গেট করতে হবে ২০ টাকা হারে প্রতি টিকিটে ১ কোটি মানুষ ছবি দেখবে। না হলে চলচ্চিত্র ব্যবসায় কেউ আর বিনিয়োগ করবেন না। পরিচালক সমিতির নবনির্বাচিত মহাসচিব বদিউল আলম খোকন বলেন, আমরা আমাদের নির্বাচনী ওয়াদা মানে চলচ্চিত্রের প্রাণ ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব। তার কথায় প্রযোজক যখন তার লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা পাবেন তখনই নির্মাণে আসবেন। এ জন্য প্রথমেই আমরা প্রযোজক, প্রদর্শক, শিল্পী, কলা-কুশলীদের নিয়ে বৈঠক করে সিনেমা হলে ডিজিটাল প্রজেক্টরসহ অন্যান্য মেশিন স্থাপন এবং পরিবেশ উন্নয়নসহ সব ধরনের পদক্ষেপ নেব। সরকারিভাবে ৬৪ জেলায় সিনেপ্লেক্স স্থাপনের উদ্যোগ রয়েছে। এ ছাড়া ১০০ ডিজিটাল মেশিন স্থাপনেরও কথা রয়েছে। আমরা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আরও ১০০ প্রজেক্টরের আবেদন করব। চলচ্চিত্র নির্মাণে বর্তমান সরকারি অনুদান প্রথার পরিবর্তে এফডিসির মাধ্যমে বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণের আবেদন করব। এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাব যারা অনুদানের অর্থে ভালো ছবি নির্মাণ করবেন তাদের আবারও যেন অনুদান দেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর