মঙ্গলবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

চরম সংকটে চলচ্চিত্র

চরম সংকটে চলচ্চিত্র

নব্বই দশকের শেষভাগ থেকে চলচ্চিত্রের মন্দাবস্থা শুরু হয়। অশ্লীলতা ও পাইরেসির আগ্রাসনে চরম সংকটে পড়ে এ শিল্পটি। জীবনধর্মী ও সময়োপযোগী গল্প, গান ও দক্ষ নির্মাতা ও শিল্পীর অভাবে দর্শক মুখ ফিরিয়ে নেয় দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে। এর ফলে ১৩০০-এর স্থলে এখন আছে মাত্র ১৭৪টি সিনেমা হল। চলচ্চিত্রের এই সংকটের চিত্র তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

বন্ধ হওয়া প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান

কাকরাইলের ফিল্মপাড়া এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। দেশ স্বাধীনের আগেই বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, তোপখানা রোড, নয়াপল্টন, কাকরাইল, গ্রিন রোড, সিদ্দিক বাজার,

নবাবপুর, ওয়াইজঘাট, ইসলামপুর, গুলিস্তান, দিলকুশা, মতিঝিল, বিজয়নগর, ওয়ারী, পুরানা পল্টন, গুলশান, ধানমন্ডি, আরামবাগ, ফকিরাপুলসহ নানা স্থানে বিস্তৃত হয় চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থার অফিস। দেশ স্বাধীনের পর গুলিস্তানে গুলিস্তান সিনেমা হল ভবনে প্রযোজনা সংস্থার অফিসগুলো একত্রিত হয়ে গড়ে তোলে ফিল্মপাড়া। দুই হাজার সালের প্রথম দিকে গুলিস্তান সিনেমা হল ভেঙে ফেলা হলে প্রযোজনা সংস্থাগুলো কাকরাইলে চলে আসে। এখানে রাজমণি ভবন, ভূইয়া ম্যানশন, ফরিদপুর ম্যানশন, যমুনা ভবন, ইস্টার্ন কমার্শিয়াল ভবনে খোলা হয় প্রযোজনা সংস্থার বিভিন্ন অফিস। তখন থেকেই চলচ্চিত্রপাড়া হিসেবে খ্যাতি লাভ করে কাকরাইল। এই ফিল্মপাড়ায় শতাধিক চলচ্চিত্র প্রযোজনার অফিস ছিল। ২০০৭ সালের পর চলচ্চিত্র ব্যবসায় মন্দাভাব শুরু হলে ধীরে ধীরে প্রযোজনা সংস্থা বন্ধ করে দিয়ে অফিস গুটিয়ে নিতে শুরু করে প্রযোজকরা। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা মিয়া আলাউদ্দীন জানান, এখন দুডজন অফিসও নেই। মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, কাকরাইলে ছয় তলাবিশিষ্ট ভূইয়া ম্যানশনে অর্ধশতেরও বেশি অফিস ছিল। বর্তমানে রয়েছে মাত্র সাতটি অফিস। এগুলো হলো- আশীর্বাদ চলচ্চিত্র, এন এন ফিল্মস, বেনানা ফিল্মস, মালঞ্চ কথাচিত্র, জননী কথাচিত্র, টি ও টি ফিল্মস এবং হার্টবিট প্রোডাকশন। এসব সংস্থা থেকেও নিয়মিত চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় না। যেসব নামি-দামি প্রযোজনা সংস্থা অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- রাজলক্ষ্মী প্রোডাকশন, ত্রয়ী চিত্রম, মজনু মুভিজ, এস এস প্রোডাকশন, মেট্রো ফিল্মস, মমতা কথাচিত্র, গীতিকথা চিত্র, জুপিটার ফিল্মস, মাসুদ কথাচিত্র, চিত্রা ফিল্মস, জ্যাম্বস মুভিজ, ডি রাস ফিল্মস, যমুনা ফিল্মস, সুচন্দা চলচ্চিত্র, ববিতা মুভিজ, পারভেজ ফিল্মস, রোজী ফিল্মস, মধুমিতা মুভিজ, মেরিনা মুভিজ, উজ্জ্বল ফিল্মস, দেশ কথাচিত্র, আজাদ পিকচার্স, স্টার করপোরেশন, লিবার্টি ফিল্মস, গীতাঞ্জলি চলচ্চিত্র, মুস্তাফিজ ফিল্মস, সোলার মুভিজ, খান আতা প্রাইভেট লি., আলমগীর পিকচার্স, শুক্লা ফিল্মস প্রভৃতি।

 

প্রয়োজন জীবনঘনিষ্ঠ গল্প নির্মাণ, অভিনয়, গান

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াতের কথায় চলচ্চিত্র মানে জীবনের ছায়া। তাই প্রয়োজন সময়োপযোগী গল্প। এরপর আসে বলিষ্ঠ চিত্রনাট্য ও দক্ষ নির্মাণ। সব শেষে প্রকৃত অভিনয় জরুরি। এ ছাড়া গান আর দৃশ্যায়নের মুনশিয়ানা তো আছেই। আশির দশকের মধ্যভাগের পর দেশীয় চলচ্চিত্র থেকে গল্প উধাও হয়ে গেছে। এর কারণ তখন এ দেশে ভিসিআরে হিন্দি ছবি দেখা শুরু হয়। কতিপয় নির্মাতা এসব মৌলিক গল্প বিবর্জিত ছবির অনুকরণে মারদাঙ্গা গাঁজাখুরি ছবি নির্মাণ করে দর্শকদের মনে বাংলা ছবির প্রতি বিরক্তি উৎপাদন করে ছাড়ে। এই অবস্থা এখনো চলছে। মাঝে-মধ্যে দু-একটি পারিবারিক গল্পের জীবনঘনিষ্ঠ ছবি নির্মাণ হলেও পরিমাণে তা খুবই স্বল্প। চলচ্চিত্র নির্মাতা মতিন রহমান বলেন, এখনকার ছবিতে গল্পই তো নেই চরিত্র থাকবে কীভাবে। বর্তমানে ডিজিটাল চলচ্চিত্রের নামে মেধাহীন কিছু লোক যেসব ছবি নির্মাণ করছে তাতে যাপিতজীবনের উপকরণ নেই। এসব গল্প ও জীবনবোধের ছায়াহীন ছবি দর্শক কেন দেখবে।

 

সংকটে জাজ মাল্টিমিডিয়া

২০১২ সালে প্রযোজনায় আসে জাজ মাল্টিমিডিয়া। প্রতিষ্ঠানটি সময়োপযোগী নির্মাণ, শিল্পী আর প্রযুক্তি দিয়ে যাত্রার শুরুতেই দর্শক-মন জয় করে নেয়। স্থানীয় ও যৌথ প্রযোজনায় মানসম্মত ছবি নির্মাণের মাধ্যমে সিনেমা হলকে বন্ধের হাত থেকে রক্ষার সফল প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। এ দেশের ছবির বাজার বিদেশেও সম্প্রসারণ করে। চলচ্চিত্রে নতুন শিল্পী ও নির্মাতা উপহার দেয়। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম ধরা পড়ায় মামলা-মোকদ্দমা জটিলতায় কর্ণধার বিপাকে পড়ায় জাজ মাল্টিমিডিয়ার ছবি নির্মাণ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।

 

অশ্লীলতা ও পাইরেসিতে ধস

অশ্লীল ছবির কারণে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত এবং মহিলা দর্শক সিনেমা হলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। অন্যদিকে ছবি পাইরেসি হয়ে যাওয়ায় স্বল্প মূল্যে পাইরেটেড সিডি কিনে দর্শক ঘরে বসে ছবিটি দেখার কারণে চরম লোকসানে পড়ে সিনেমা হল মালিক। ছবি না চললেও প্রতি মাসে কর, ইলেকট্রিক বিল, কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ঠিকই গুনতে হচ্ছে সিনেমা হল মালিকদের। ফলে বাধ্য হয়ে সিনেমা হল বন্ধের হিড়িক শুরু হয়। ১৩০০ এর স্থলে বর্তমানে কোনোরকমে টিকে আছে মাত্র ১৭৪টি সিনেমা হল। জানিয়েছেন প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা মিয়া আলাউদ্দীন।

 

ছবি আমদানিতে বাধা

চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শোয়েব রশিদ বলেন, ঢাকায় অবস্থিত সিনেপ্লেক্সগুলো চালু রয়েছে ইংরেজি ছবির ওপর নির্ভর করে। মফস্বলের দর্শক ইংরেজি ছবি সেভাবে দেখে না। স্থানীয়ভাবে যখন নির্মাতারা কনটেন্ট দিতে পারছিল না তখন উপমহাদেশীয় ছবি আমদানির মাধ্যমে সিনেমা হল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হলে তথাকথিত চলচ্চিত্রপ্রেমীদের বিরোধিতায় সরকার তা স্থগিত করে দেয়। এরপর কলকাতার বাংলা ছবি আমদানি করতে গেলে আবার এসব চলচ্চিত্রকার নামধারী অশুভ চক্র তাতেও বাধা দিয়ে উৎসবে মুক্তির ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করে। এতে প্রদর্শকরা আরও ক্ষতির মুখে পড়েন। কারণ উৎসব হলো চলচ্চিত্র ব্যবসার প্রধান মৌসুম। সিনেমা হল বাঁচাতে বিদেশি ছবি আমদানি করতে হবে।

 

হতাশ প্রযোজক-প্রদর্শক

এডিটরস গিল্ডের সভাপতি আবু মুসা দেবু বলেন, আগে প্রযোজক ছবি নির্মাণ করে পরিবেশকের কাছে যেতেন। উভয়ে মিলে ছবিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতেন। বর্তমানে এ দুই সংগঠনের মাঝখানে মধ্য স্বত্বভোগী হিসেবে বুকিং এজেন্টের উদ্ভব হয়েছে। তারা ছবির রেন্টাল নির্ধারণ করে কমিশনের ভিত্তিতে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রযোজক ও প্রদর্শক। দ্বিতীয়ত, সিনেমা হল ডিজিটাল হওয়ায় একটি টিকিট থেকে প্রযোজক পাচ্ছেন মাত্র ২৫ ভাগ শেয়ার মানি। বাকিটা নানা অজুহাতে সিনেমা হল মালিকরা নিয়ে নিচ্ছেন। সরকার যদি স্বল্প সুদে সিনেমা হল সংস্কার নির্মাণ আর ডিজিটালাইজ করে দেয় তাহলে চলচ্চিত্র শিল্পের সুদিন আবার ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখা দেবে।

 

বিনিয়োগকারী নেই

লোকসানের ভয়ে প্রযোজক এবং প্রদর্শক নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। সিনেমা হল বাঁচাতে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত ছবি দরকার। যা অনেক বছর ধরেই হচ্ছে না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় যৌথ প্রযোজনা আর চলচ্চিত্র বিনিময় ব্যর্থ প্রায়। সরকারের দুটি মন্ত্রণালয়ের দুরকম সিদ্ধান্তের ফলে বিনিময় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাফটা চুক্তির আওতায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চলচ্চিত্র বিনিময়ের অনুমতি দিলেও তথ্য মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত আরোপ করেছে। ২০১০-১২ বছরে সরকার উপমহাদেশের ছবি আমদানির অনুমতি দিয়ে ছয় মাস পর তা বন্ধ করে দেয়। এর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরে আবার ২০১২-১৫ বছরের জন্য ফের অনুমতি দেয়। ২০১৬-১৮ সালেও তা বলবৎ ছিল। তা সত্ত্বেও তথ্য মন্ত্রণালয় কেন পূর্বশর্ত এবং এনওসির কথা বলে এই

বিনিময় বাধাগ্রস্ত করছে। রপ্তানির ক্ষেত্রেও চলছে একই অবস্থা। এ অবস্থায় আমার প্রশ্ন-কেন এই দ্বৈত নীতি? সিনেমা হল টিকিয়ে রাখতে উৎসবে ছবি আমদানি বন্ধ করা কতটা সিনেমা হলের স্বার্থ রক্ষা করবে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। জানালেন প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস।

 

প্রতারণার নতুন ফাঁদ ‘মহরত’

দীর্ঘদিন ধরে চলছে ছবি নির্মাণের নামে নতুন প্রতারণা। এই প্রতারণার নাম ‘মহরত’। ছবির নাম এফডিসিতে এন্ট্রি করে হয় জমকালো মহরত। তারপর নারী ভোগবিলাস থেকে শুরু করে স্পন্সরের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা আদায়সহ নানা অনৈতিক কর্ম করে থাকে এসব ছবির প্রযোজক নামধারী সংঘবদ্ধ একটি চক্র। প্রায় সময়ই দেখা যায় তথ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীকে দিয়ে মহরত করিয়ে সেই ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে নানা ফায়দা লুটে ওই নামধারী নির্মাতারা। এসব ছবি আর নির্মাণ হয় না। অনেক ছবির আবার লোক দেখানো কিছুটা শুটিংও হয়। এটি হয় বিশেষ করে স্পন্সরদের মধ্যে আস্থা তৈরি করে অর্থ আদায় আর ভোগবিলাসের জন্য। বেশির ভাগ মহরত সর্বস্ব ছবিতে লোভ দেখিয়ে নতুন মেয়ে আনা হয়। তারপর ভোগবিলাসেই সীমিত হয়ে যায় ছবি। নির্মাণ আর হয় না। এফডিসি বা পরিচালক সমিতিতে এমন শতাধিক এন্ট্রি সর্বস্ব ছবির নাম রয়েছে। জানিয়েছেন প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস।

 

সিনেমার স্টাইল বদলেছে

এখন সিনেমার স্টাইল বদলেছে। তামিল আর হিন্দি ছবির অনুকরণে নির্মাণ দিয়ে দর্শকদের সিনেমা হলমুখী করা যাবে না। দরকার জীবনধর্মী গল্প। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজন জীবনঘনিষ্ঠ গল্প ও আধুনিক নির্মাণ। একই সঙ্গে দরকার প্রদর্শনের আধুনিক ব্যবস্থা মাল্টিপ্লেক্স। এ কথা চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগরের।

 

নতুন প্রজন্মের পছন্দের চলচ্চিত্র প্রয়োজন

প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার নওশাদ বলেন, সিনেমা হলে দর্শক টানার মতো চলচ্চিত্র এখন আর নির্মাণ করা সম্ভব হয় না। কীভাবে হবে। দক্ষ নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্পী কোথায়? গল্পের দুর্দিন চলছে। তামিল, হিন্দি আর বিদেশি ছবির গল্পের নকলে সবাই ব্যস্ত। ডিজিটালের নামে যেসব ছবি নির্মাণ হচ্ছে তা টেলিফিল্মও হচ্ছে না। শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ নির্মাতার অভাবেই এ দুরবস্থা চলছে। একজন শাকিব খান দিয়ে আর কতদিন চলবে। নতুন শিল্পী শুধু এলে চলবে না। তাদের অভিনয় দক্ষতাও দরকার, যা নেই বলে আর কেউ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন না। পাইরেসির আগ্রাসন তো আছেই। মূল কথা গল্প, নির্মাতা, শিল্পীর অভাব এবং পাইরেসির আগ্রাসনে বড় মাপের প্রযোজনা সংস্থাগুলো আর নির্মাণে আসতে পারছে না। সরকারকে এ ক্ষেত্রে ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা এবং পাইরেসি ও নকল রোধে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর