বুধবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির আলটিমেটাম

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হল

আলাউদ্দীন মাজিদ

বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হল

সিনেমা হলের বিরাজমান অচলাবস্থা অচিরেই দূরীকরণের ব্যবস্থা নেওয়া না হলে বন্ধ করে দেওয়া হবে দেশের সব সিনেমা হল। সরকারের প্রতি এমন আলটিমেটাম দিতে যাচ্ছে চলাচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি। সমিতির সভাপতি ইফতেখার নওশাদ ও প্রধান উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এ তথ্য জানান। তারা বলেন, ‘আমাদের ওপর সারা দেশের সিনেমা হল মালিকরা ক্রমাগত চাপ দিয়ে বলছেন, দেশীয় ছবির অভাব, বিদেশি ছবি আমদানিতে জটিলতা, চারটি প্রধান উৎসবে কলকাতার ছবি প্রদর্শনে নিষেধাজ্ঞা, এসব কারণে দর্শকের অভাবে লোকসান গুনে সিনেমা হল আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সরকার যদি এ বিষয়ে আশু পদক্ষেপ না নেয় তাহলে সমিতি যেন মালিকদের বাঁচাতে সিনেমা হল বন্ধ করে দেয়। সমিতির এই দুই কর্মকর্তা বলেন, সিনেমা হল মালিকদের পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাদের বাঁচাতে সিনেমা হল বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। প্রদর্শক সমিতি জানায়, চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার শোবিজ বিভাগে ‘সিনেমা নির্মাণে ঝোঁক নেই কারও’ এবং ‘চরম সংকটে চলচ্চিত্র’ শিরোনামের দুটি সময়োপযোগী এবং বাস্তবধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। এতে সিনেমা হল এবং চলচ্চিত্র শিল্পের দূরাবস্থার প্রকৃত চিত্র যথাযথভাবে ফুটে উঠেছে। এরপর সরকারকে বলার আর কিছু নেই আমাদের। সুদীপ্ত কুমার দাস বলেন, সরকার চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নে ইতিমধ্যে এফডিসির আধুনিকায়ন, গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু ফিল্ম সিটির উন্নয়ন, ফিল্ম আর্কাইভ ভবন নির্র্মাণসহ বহু কালজয়ী পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছে। অথচ সিনেমা হল নিয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী ২০১০ সালে এক ঘোষণায় সিনেমা হল আধুনিকায়নের কথা বললেও আজ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৮ সালে সিনেপ্লেক্স নির্মাণ ও সিনেমা হল আধুনিকায়নে এফডিসি ২৬২ কোটি টাকার প্রস্তাব পেশ করলেও একনেক থেকে তা ফেরত আসে। এরপর সাবেক তথ্য সচিবের পরামর্শে এফডিসি ৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করে এবং প্রদর্শক সমিতির সহায়তায় তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে সারা দেশের সিনেমা হল মালিকদের এফডিসিতে ডেকে মিটিং করা হয়। এই মিটিংয়ে সিনিয়র অভিনেতা ফারুকসহ চলচ্চিত্র পরিবারের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সেই মিটিংয়ে এফডিসির এমডি জানান, নতুন সচিবের নির্দেশনা মতে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রজেক্টর ও সাউন্ড সিস্টেম ক্রয় করে এফডিসি থেকে সিনেমা হল মালিকদের ভাড়া দেওয়া হবে। এই মর্মে একটি প্রকল্প প্রস্তাবও তৈরি শুরু করে এফডিসি। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের নির্দেশে মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন  কর্মকর্তা দেশের প্রায় সব সিনেমা হল পরিদর্শন করে সংস্কারযোগ্য সিনেমা হলের একটি তালিকাও তৈরি করেন। এরপর প্রদর্শক সমিতির নেতারা তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে মন্ত্রী জানান, সিনেমা হলের উন্নয়নে পেশকৃত প্রকল্প প্রস্তাব সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয় নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করেছে। এতে সিনেমা হল মালিকরা চরম হতাশায় পড়েন। সুদীপ্ত দাস প্রশ্ন তোলেন, সরকার দেশের বিভিন্ন সেক্টরের রুগ্ন শিল্পকে প্রণোদনা দেওয়ার জন্য অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ সাবসিডি হিসেবে প্রদান করেছে। অথচ চলচ্চিত্রের মতো দেশের একটি প্রধান গণমাধ্যমকে টিকিয়ে রাখার জন্য কেন কোনো প্রণোদনা বা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলো না। এটি নির্ভেজাল সত্য যে, পৃথিবীর সর্বোচ্চ পরিমাণ কর এ দেশের সিনেমা হলের ওপর আরোপ করে কোটি কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করা হয়েছে। একজন সিনেমা হল মালিক বা একজন প্রযোজক একটি টিকিট বিক্রি থেকে যে অর্থ অতীতে পেয়েছেন তার বেশি অর্থকর আদায়ের নামে সরকারি তহবিলে জমা হয়েছে। বর্তমানে চলচ্চিত্রের দুর্দিনে সরকারের সব কর্তৃপক্ষ হাত গুটিয়ে বসে আছে; যা সত্যিকার অর্থে দুর্ভাগ্য ও হতাশাজনক বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন সুদীপ্ত কুমার দাস। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী শোয়েব রশিদ উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, সরকার চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করেছেন সত্যি, কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এর পরও সিনেমা হল মালিকরা শিল্পের কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না। বিশেষত সিনেমা হলের বিদ্যুৎ বিল এখনো শিল্প হারের পরিবর্তে বাণিজ্যিক হারে আদায় করা হচ্ছে। সিনেমা প্রদর্শনের মূল সময় বিকাল ৫টা থেকে রাত ১০টাকে পিক আওয়ার ধরে নিয়ে এ সময়ের জন্য কয়েকগুণ বেশি বিদ্যুৎ বিল আদায় করা হচ্ছে। সিনেমা হল দর্শকপূর্ণ কিংবা শূন্য থাকুক বিদ্যুৎ বিল যথারীতি হচ্ছে এবং পরিশোধও করতে হচ্ছে। সিনেমা হলের সংস্কার এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানির সময় শুল্ক হার আগের মতোই রয়ে গেছে। এ বিষয়ে প্রদর্শক সমিতি সরকারের কাছে অনেক আবেদন-নিবেদন করলেও তা শুধু আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ আছে। সুদীপ্ত কুমার দাস আরও বলেন, গত বছর দেশে নির্মিত ও মুক্তিপ্রাপ্ত ৪৫টি ছবির মধ্যে মাত্র দুটি ব্যবসাসফল আর ৩-৪টি মোটামুটি ব্যবসা করেছে। আমদানিকৃত কলকাতার ৮টি বাংলা ছবির মধ্যে মাত্র দুটি ব্যবসা করেছে। সরকারি জটিলতায় কলকাতায় মুক্তির অনেক পরে ছবিগুলো এখানে মুক্তি পাওয়ায় তা দর্শক আকর্ষণ হারিয়েছে। সুদীপ্ত দাস বলেন, ২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের আমদানি নীতি আদেশ ২০১২-২০১৫ এর ২৬(৪৮) (গ) ধারায় নতুন একটি বিধান সংযোজন করা হয়। এতে বাংলাদেশ থেকে একটি ছবি রপ্তানির বিপরীতে সাফটাভুক্ত যে কোনো দেশ থেকে একটি ছবি আমদানি করা যাবে। এ বিধানটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সংযোজন করা হয় মূলত প্রদর্শক সমিতির আবেদন এবং জোর প্রচেষ্টার করাণে। কিন্তু এই বিধানের আওতায় ছবি আমদানি করতে গিয়েও সিনেমা হল মালিকরা তথ্য মন্ত্রণালয়ের আরোপিত অহেতুক শর্তে বাধাগ্রস্ত হন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়ে ছবি মুক্তি প্রদানে অনুমতি লাভ করলেও দীর্ঘ এক বছরের অহেতুক বিলম্বের কারণে ছবির ব্যবসায়িক মান মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। পরে অর্থাৎ আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-১৮-তে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ছবি আমদানির ক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতির (এনওসি) বিধান সংযোজন করায় ছবি আমদানি করে সময়মতো মুক্তিদান বিঘিœত ও বিলম্বিত হওয়ায় ছবির ব্যবসায়িক মান পড়ে যাওয়ায় আমদানিকারক ও সিনেমা হল মালিক উভয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এর ওপর আবার বছরে চারটি উৎসবে দেশীয় ছবি চালানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করায় সিনেমা হল মালিকরা আরও হতাশ হয়ে পড়েন। সর্বোপরি ২০০২ সাল থেকে যখন সিনেমা হল বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন থেকেই চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি দেশীয় ছবির অভাব পূরণে অবাধে বিদেশি ছবি আমদানির দাবি জানায়। সরকার সিনেমা হল মালিকদের ক্রমাগত আশ্বস্ত করে যে, মেধাসম্পন্ন নতুন চিত্র পরিচালক আসছেন, তারা ভালো ছবি তৈরি করছেন এবং দেশীয় চলচ্চিত্র ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্ত বাস্তব চিত্র একবারেই বিপরীত। ক্রমাগত সিনেমা হল বন্ধের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। ১৩০০ সিনেমা হলের স্থলে বর্তমানে রয়েছে মাত্র ১৭৪টি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গোনার চাইতে একেবারে মৃত্যুবরণ করাই শ্রেয়। তাতে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মেলে। এ কারণেই ভেবেচিন্তে বিভিন্ন অঞ্চলের সিনেমা হল মালিকদের সঙ্গে আলাপ করে ও তাদের অনুরোধে শিগগিরই দেশের সিনেমা হলগুলো একযোগে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে যাচ্ছে বলে জানায় প্রদর্শক সমিতি।

সর্বশেষ খবর