মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঢাকাই চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ

আলাউদ্দীন মাজিদ

ঢাকাই চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশেই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য প্রামাণ্য, স্বল্প এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এত বেশিসংখ্যক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে, দেশের বাইরেও তা প্রশংসা কুড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকার ভাষায়, ‘আগামী প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে গৌরব, গর্ব আর বেদনাগাথা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পালন করে যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। দেশটির জন্য সত্যিই এটি আশা ও অহংকারের বিষয়।’ এর বিপরীত বক্তব্যও রয়েছে। চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মতে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়নি। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তাতে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণ চিত্র ফুটে ওঠেনি। খণ্ডচিত্র নিয়েই ছবিগুলো নানা আঙ্গিকে নির্মিত হয়েছে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আজিজুর রহমানের কথায় ‘মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় অংশ ভারতের সহযোগিতার বিষয়টি এ পর্যন্ত নির্মিত কোনো চলচ্চিত্রেই দেখানো হয়নি। কেবলমাত্র পাকবাহিনীর অত্যাচারের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। এসব ছবিকে মোটেও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ চিত্র বলা যায় না। অন্যদিকে প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’-এর প্রযোজক-চলচ্চিত্রকার মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানা বলেন, ‘ওরা ১১ জন’  মোটেও মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নয়। এই ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হয়েছে মাত্র। তাই এটিকে আমি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ডকুফিল্ম বলব।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক বছরেই ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় চারটি চলচ্চিত্র। এগুলো হলো- চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’ (মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র), সুভাষ দত্তের ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, মমতাজ আলীর ‘রক্তাক্ত বাংলা’ এবং আনন্দের ‘বাঘা বাঙ্গালী’। গত ৪৬ বছরে নির্মিত হয়েছে দেড় ডজনেরও  বেশি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। এসব ছবি ও এর নির্মাতারা হলেন- ওরা ১১ জন- চাষী নজরুল ইসলাম, রক্তাক্ত বাংলা- মমতাজ আলী, বাঘা বাঙ্গালী, আনন্দ, জয়বাংলা- ফখরুল আলম, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী- সুভাষ দত্ত, ধীরে বহে মেঘনা- আলমগীর কবীর, আমার জন্মভূমি- আলমগীর কুমকুম, সংগ্রাম- চাষী নজরুল ইসলাম, আবার তোরা মানুষ হ- খান আতাউর রহমান, আলোর মিছিল- নারায়ণ ঘোষ মিতা, বাংলার ২৪ বছর-  মোহাম্মদ আলী, মেঘের অনেক রং- হারুন-উর-রশিদ, কলমিলতা- শহীদুল হক খান, নদীর নাম মধুমতি- তানভীর  মোকাম্মেল, আগামী-  মোরশেদুল ইসলাম, একাত্তরের যীশু- নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, আগুনের পরশমণি- হুমায়ূন আহমেদ, মুক্তির গান- তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ, এখনো অনেক রাত- খান আতাউর রহমান, হাঙ্গর নদী  গ্রেনেড- চাষী নজরুল ইসলাম, মুক্তির কথা- তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ, মাটির ময়না- তারেক মাসুদ, জয়যাত্রা- তৌকীর আহমেদ, শ্যামল ছায়া- হুমায়ূন আহমেদ, মেঘের পরে মেঘ- চাষী নজরুল ইসলাম, ধ্রুবতারা- চাষী নজরুল ইসলাম, খেলাঘর- মোরশেদুল ইসলাম, রাবেয়া- তানভীর মোকাম্মেল, মেহেরজান- রুবাইয়াত হোসেন, খণ্ড গল্প ১৯৭১- বদরুল আলম সৌদ, আমার বন্ধু রাশেদ- মোরশেদুল ইসলাম, গেরিলা- নাছির উদ্দিন ইউসুফ, পিতা- মাসুদ আখন্দ, জীবনঢুলী- তানভীর   মোকাম্মেল, ৭১-এর গেরিলা- মিজানুর রহমান শামীম, ৭১-এর সংগ্রাম- মনসুর আলী, মেঘমল্লার- জাহিদুর রহিম অঞ্জন, অনুক্রোশ- গোলাম মোস্তফা শিমুল, হৃদয়ে ৭১- সাদেক সিদ্দিকী এবং ৭১-এর মা জননী- শাহ আলম কিরণ, সোহেল আরমানের এইতো প্রেম, অনিল বাগচীর একদিন- মোরশেদুল ইসলাম, শোভনের স্বাধীনতা- মানিক মানবিক, ভুবন মাঝি- ফাখরুল আরিফিন প্রভৃতি চলচ্চিত্রের মধ্যে প্রায় সবই জাতীয় ও বাচসাস পুরস্কার, আন্তর্জাতিক ও বোদ্ধা শ্রেণির প্রশংসা কুড়িয়েছে। এসব চলচ্চিত্রে সরাসরি যুদ্ধের ভয়াবহতা উঠে এসেছে। যেমন : ওরা ১১ জন, সংগ্রাম, একাত্তরের যীশু, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড। সেই সঙ্গে কিছু চলচ্চিত্রে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধকে উপস্থাপন না করে পরোক্ষভাবে এর ভয়াবহতাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। উপস্থাপন করা হয়েছে যুদ্ধের শিকার হওয়া শরণার্থী বা পালিয়ে বেড়ানো মানুষের জীবনাবেগকে। এ ধরনের চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে- মুক্তির গান, শ্যামল ছায়া, খেলাঘর। এছাড়াও কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে যুদ্ধ-পূর্বকালীন ও যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রভাব ও রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি এবং বাস্তবতা নিয়ে। এ ধরনের চলচ্চিত্রের মধ্যে আছে, জীবন থেকে নেওয়া, এখনো অনেক রাত (মেঘের অনেক রং), আলোর মিছিল ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন ‘জয় বাংলা’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন কিন্তু তা শেষ করতে পারেননি।

মুক্তিযুদ্ধের আগেই স্বাধীনতার ইঙ্গিত দিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেয়া’। ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রে সংসারের একগোছা চাবির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসন ক্ষমতা বোঝানো হয়। এরপর ৬ দফা আন্দোলন নিয়ে ১৯৭০ সালে ফখরুল আলমের ‘জয় বাংলা’ পাকিস্তান সেন্সর বোর্ড আটকে রাখে। ১৯৭২ সালে এটি মুক্তি পায়। এ দুটো চলচ্চিত্রকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের ভিত্তিপ্রস্তর  বলা যায়।

 

সর্বশেষ খবর