মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

চিরনিদ্রায় হাসির রাজা আনিস...

শোবিজ প্রতিবেদক

চিরনিদ্রায় হাসির রাজা আনিস...

আনিসুর রহমান আনিস : ১৯৪০-২০১৯

যেভাবে চলে গেলেন আনিস

সবাইকে কাঁদিয়ে প্রখ্যাত কৌতুকাভিনেতা আনিস রবিবার রাতে না ফেরার দেশে চলে যান। অভিনেতা আনিসের জামাতা মোহাম্মদ আলাউদ্দিন শিমুল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘উনি সুস্থ ছিলেন। রাতে নামাজ পড়ে ঘুমাতে গিয়েছিলেন। ওখানেই তার স্ট্রোক হয়।’

রবিবার রাত। পুরান ঢাকার ১৩/১, অভয়দাশ লেন টিকাটুলীর নিজ বাসা কলেজভিউ টাওয়ারের প্রথমতলা। প্রতিদিনের মতো রাত ১০টার দিকে এশার নামাজ শেষ করে রাতের খাবার খেলেন। তারপর ১১টার দিকে ঘুমাতে গেলেন। তাকে ছটফট করতে দেখে কাজের লোক এগিয়ে আসেন। একসময় অচেতন হয়ে পড়েন তিনি। কাজের লোক আনিসের মেয়ে আর মেয়ের জামাইকে খবর দেন। চিকিৎসক এসে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অনাকাক্সিক্ষত দুঃসংবাদটি দেন। হাসি-খুশি আর হাসির রাজা আনিসের চির প্রস্থান ঘটেছে। মুহূর্তের মধ্যে দুঃসংবাদটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ঘরে-বাইরে শুধুই কান্নার রোল।

এ কান্না কখনো থামার নয়। এমন আপন মানুষের মৃত্যু কখনো মেনে নেওয়া যায় না। আনিসের ৭৮ বছরের কর্মজীবন ছিল প্রাপ্তি আর সমৃদ্ধিতে ভরপুর।

 

চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ

ষাটের দশকের শুরুতেই ঢাকায় এলেন আনিস। বড় ভাই লুৎফর রহমান এফডিসিতে চাকরি করতেন। বড় ভাই তাকে বিখ্যাত ফটোগ্রাফার সাঈদুর রহমানের স্টুডিওতে কাজ দিলেন। আনিস শুরু করলেন ফটোগ্রাফির কাজ। বড় ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে আনিস এফডিসিতে সম্পাদনার চাকরি নিলেন। সেখানে পরিচয় হয় ক্যামেরাম্যান সাধন রায়ের সঙ্গে। তিনিই তাকে প্রথম উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দিলেন। তার প্রথম সংলাপ ‘আহ একটা কথা বুঝনা কেন নানী, ওই মাইয়া আমাগো ঘরে আইলে কপাল খুইলা যাইব।’ কিন্তু ক্যামেরাম্যান পরিচালককে বললেন, ‘এই মাল কোত্থেকে আনছেন, না আছে গলা, না  চেহারা’। এই কথা শুনে আনিস পালিয়ে আসেন। পরবর্তীতে জিলুøর রহিমের ‘এইতো জীবন’ চলচ্চিত্র দিয়ে শুরু হয় আনিসের অভিনয় জীবন। এটি ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায়। সেই সময় তিনি চলচ্চিত্রের সম্পাদনার কাজ করতেন প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা এহতেশাম ও মুস্তাফিজের সঙ্গে। অভিনয়ে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় সম্পাদনার কাজ তাকে একসময় ছেড়ে দিতে হলো।

আনিস একাধারে চলচ্চিত্রাভিনেতা, রেডিও আর্টিস্ট এবং নাট্যঅভিনেতা। টিভিতে অভিনয়ের সুযোগ করে দিয়েছিলেন কলিম শরাফী। রেডিওতে অভিনয় করার সুযোগ করে দেন খান আতাউর রহমান। তিনি এহতেশাম ও  মুস্তাফিজের লিও দোসানী ফিল্মসে সহকারী সম্পাদক ও পরিচালক ছিলেন।

২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শতাধিক ছবিতে  কৌতুকের মতো কঠিন অভিনয়টি সহজ ও সাবলীলভাবে করে অনবরত দর্শক হৃদয়কে নাড়া দিয়ে গেছেন তিনি। নবাব সিরাজ-উদ- দৌলা নাটকে গোলাম হোসেন চরিত্রে অভিনয় করে তিনি মঞ্চে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

 

জন্ম ও পারিবারিক জীবন

আনিসের জন্ম ১৯৪০ সালে জলপাইগুড়িতে। বাবা মরহুম আমিনুর রহমান চা-বাগানের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়ার দক্ষিণ বল্লবপুরে। আনিসের বাবা আমিনুর রহমানের চা-বাগানের ব্যবসা ছিল জলপাইগুড়িতে। বাবার ব্যবসার কারণে ফেনীর আমিনুর রহমানকে ওখানেই থাকতে হতো। তাই আনিসের জন্মও হয় সেখানেই। একটু বেশি দেরিতে দাঁত উঠেছিল বিধায় পরিবারের অনেকেই আনিসকে বুড়া বলে ডাকতেন। একসময় জলপাইগুড়ি ছেড়ে আনিসদের পরিবারকে গ্রামে চলে আসতে হলো। সেখানেই আনিসের পড়াশোনা শুরু। স্কুলজীবনে ‘ড্রেস এজ ইউ লাইক’ অনুষ্ঠানে আনিস নিজে মনের মতো সাজতেন।

পুরস্কার হিসেবে পেতেন ৫০-৬০ টাকা।

সেই টাকা স্কুলের পিয়নদের দিয়ে দিতেন।

১৯৬৫ সালে খালাতো বোন কুলসুম আরা  বেগমকে ভালোবেসে বিয়ে করেন আনিস। ৪৯ বছর একসঙ্গে সংসার করেছেন তারা। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে এতটুকু ছেদ পড়েনি তাদের ভালোবাসায়।

আনিসের বড় মেয়ে ফারহা দীবা থাকেন আমেরিকায়।

তার স্বামী তারেক হোসেন সেদেশে ব্যবসা করেন। ছোট মেয়ে ফাতেমা রহমান রিমি কুমিল্লায় থাকেন। তার স্বামী আলাউদ্দীন  সেখানে ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কর্মরত। রিমি ইংরেজিতে মাস্টার্স করেছেন।

আগে ফরিদপুরের একটি কলেজে অধ্যাপনা করতেন। সন্তান জন্মের পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। মায়ের মৃত্যুর পর মেয়েরা

বাবার কাছে চলে আসেন।

 

অন্তিম যাত্রা

সোমবার সকাল ৯টায় টিকাটুলী জামে মসজিদে তার প্রথম নামাজে জানাজা, বেলা সাড়ে ১১টায় প্রিয় কর্মস্থল এফডিসিতে দ্বিতীয় এবং বাদ আসর ফেনীর ছাগলনাইয়া থানার বল্লবপুর গ্রামে সর্বশেষ জানাজা শেষে নিজ গ্রামের মানুষের অশ্রুজল আর ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়ে চিরদিনের মতো শুয়ে পড়েন পারিবারিক কবরস্থানে।             

  

অজানা কিছু তথ্য

যে কারণে অভিনয় ছেড়েছিলেন

২০১৫ সাল। কথা ছিল প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে ঘটা করে পরের বছর ৫০তম বিবাহবার্ষিকী পালন করবেন হাসির রাজা আনিস। সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। তার আগেই আনিসকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন স্ত্রী কুলসুম আরা  বেগম। ২০১৫ সালের ঈদুল আজহার তিন দিন আগে হঠাৎ করেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

স্ত্রীকে হারানোর শোকে মুহ্যমান কৌতুকাভিনেতা আনিস আর কখনো ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন না বলে ঘোষণা দেন। অসময়ে স্ত্রীকে হারিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এই অভিনেতা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে তখন তিনি বলেন, ওর অনুপ্রেরণাতেই অভিনেতা আনিস এবং সফল স্বামী ও বাবা হতে  পেরেছি। যে আমাকে পথ দেখিয়ে আজকের এ অবস্থানে নিয়ে এসেছে সে-ই যখন রইল না তখন আর অভিনয় করে কী হবে।

 

যেভাবে কেটেছিল শেষ দিনগুলো

২০১৫ সালে প্রিয়তমা স্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর পর টিকাটুলীর অভয়দাশ লেনের বাসায় বড় অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন হাসির রাজা আনিস। যে অভিনেতা কখনো কাঁদতে জানেননি, সবাইকে শুধু হাসিয়েছেন স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি শুধু কেঁদেছেন। সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ জানিয়েছেন এবং সবার কাছে দোয়া চাইতেন জীবনসঙ্গিনী কুলসুম আরা যেখানেই থাকুক যেন ভালো থাকে। বাসা থেকে তেমন একটা বের হতেন না। নামাজ রোজা নিয়মিত আদায় করতেন। বেশির ভাগ সময় বিমর্ষ হয়ে থাকতে দেখা যেত তাকে।

 

উল্লেখযোগ্য ছবি

‘এইতো জীবন’, ‘পয়সে’, ‘মালা’, ‘জরিনা সুন্দরী’, ‘জংলী মেয়ে’, ‘মধুমালা’, ‘ভানুমতি’, ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘সূর্য ওঠার আগে’, ‘অধিকার’ ‘অঙ্গার’, ‘বারুদ’, ‘ঘর সংসার’, ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’, ‘পুরস্কার’ ‘লাল কাজল’, ‘নির্দোষ’, ‘সানাই’, ‘উজান ভাটি’, ‘তালাক’ ইত্যাদি।

 

 

সবাই কেন এভাবে চলে যাচ্ছেন

-------- সুচন্দা

আমরা যারা একসঙ্গে কাজ করতাম সবাই কেন জানি একে একে চলে যাচ্ছেন। আজ আনিস ভাইয়ের মতো একজন প্রখ্যাত অভিনেতাও চলে গেলেন। এই শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তার মতো অমায়িক আর পরোপকারী মানুষ খুব কম দেখেছি। তিনি যেখানেই থাকুন সৃষ্টিকর্তা যেন তাকে ভালো রাখেন এই দোয়াই করি।

 

 

 

একজন মানবিক মানুষকে হারালাম

 ------  সোহেল রানা

আনিস ভাইয়ের মধ্যে যে মানবিক গুণাবলি ছিল তা খুব কমই দেখা যায়। দেশের বড় সব চিকিৎসকের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। কেউ অসুস্থ হলে তাকে দ্রুত সিরিয়াল নিয়ে অনেক সময় নিজ খরচে নিয়ে যেতেন। তাকে কখনো রাগতে বা দুর্ব্যবহার করতে দেখিনি। একজন মহৎ মানুষকে হারালাম। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

 

 

 

তার জন্য সবাই দোয়া করবেন

------ আলমগীর

আনিস ভাই অভিনয় দিয়ে শুধু বিনোদন দিতেন না, সবার দুঃখে ছায়ার মতো পাশে এসে দাঁড়াতেন। তার চলে যাওয়াটা  অনেক কষ্টের। তার মতো একজন ভালো অভিনেতা ও মানুষ আর আসবে না। তার সঙ্গে আমার প্রচুর স্মৃতি জমে আছে। আজ এসব বলব না। সবার কাছে শুধু অনুরোধ করব আপনারা তার আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করবেন।

 

 

 

তার কোনো বিকল্প নেই

------- হানিফ সংকেত

আনিস ভাই সবার শ্রদ্ধার পাত্র শুধু নন, সদা হাস্যোজ্জ্বল ভালো মনের মানুষ ও শিল্পী ছিলেন। ভালোত্বের দিক দিয়ে তার  বিকল্প ছিল না। ইত্যাদিতেও তিনি কাজ করেছেন। সকালে তার মেয়ের জামাই আমাকে যখন এই দুঃসংবাদটি দিলেন আমি তখন হতভম্ব হয়ে গেলাম। তার আত্মার শান্তি কামনা ও পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।

সর্বশেষ খবর