রবিবার, ২ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ইত্যাদি প্রতিটি পরিবারের একজন সদস্য

শোবিজ প্রতিবেদক

ইত্যাদি প্রতিটি পরিবারের একজন সদস্য
প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদ আনন্দের সঙ্গে দর্শকদের জন্য বাড়তি আনন্দ নিয়ে আসছে হানিফ সংকেতের ইত্যাদি। কোনো নির্দিষ্ট বয়স বা শ্রেণির জন্য নয়-সব বয়সী, সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্যই ইত্যাদি। তাই ইত্যাদিকে বলা হয় গণমানুষের অনুষ্ঠান। গত ৩০ বছর ধরে এত চ্যানেলের হাজারো অনুষ্ঠানের ভিড়ে এখনো দর্শক জরিপে শীর্ষে অবস্থান করছে এই ইত্যাদি। ইত্যাদির জনপ্রিয়তা ও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় ইত্যাদি রচনা, পরিচালনা ও উপস্থাপক হানিফ সংকেতের সঙ্গে।

 

তিন দশক ধরেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ইত্যাদি। বর্তমানে এত চ্যানেলের ভিড়েও দর্শকপ্রিয়তায় এখনো এক নম্বর আসন দখল করে আছেন। রহস্যটা কী?

এ প্রশ্নের উত্তর দর্শকই ভালো দিতে পারবেন। আমরা বাগাড়ম্বরে বিশ্বাসী নই। আমরা জানি দর্শক ইত্যাদি দেখার জন্য এখনো অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। আমরা তাদের সেই অপেক্ষার মূল্য দিতে চেষ্টা করি। আমাদের চিন্তা থাকে কীভাবে দর্শক হৃদয়ে স্থান পাওয়া যায়। তাই অনুষ্ঠান নির্মাণে আমাদের আন্তরিকতা, সততা থাকে একশভাগ। আপনারাও বলেন, গণমানুষের অনুষ্ঠান।

 

ইত্যাদিকে নিয়ে গেছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, বাইরে নিয়ে যাওয়ার চিন্তাটা এলো কী করে?

মূলত অনুষ্ঠানের বৈচিত্র্য ও অনুষ্ঠানটিকে বাস্তবে গণমুখী করার জন্যই এই যাত্রা। তবে বাইরে গিয়ে আমরা কোনো স্টেডিয়াম বা খোলা মাঠে ইত্যাদি করিনি। সেখানেও আমাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশকে তুলে ধরা। আমাদের রয়েছে গর্বিত ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, প্রত্ন নিদর্শন ও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। যা আমাদের অনেকেরই অজানা। আমরা সেই স্থানগুলো খুঁজে বের করে তার সামনে অনুষ্ঠান করি এবং সেসব স্থানের সব তথ্য তুলে ধরতে চেষ্টা করি। নতুন নতুন স্থানে করা হয় বলে প্রতিটি অনুষ্ঠানই মনে হয় নতুন। এই কাজটি আমরা করছি দীর্ঘদিন ধরে। আমরা আনন্দিত এখন অনেকেই ইত্যাদিকে অনুসরণ করছে।

 

সব বয়স এবং শ্রেণির মানুষকে নিয়ে অনুষ্ঠান করার চিন্তা করলেন কেন?

টেলিভিশন তো কোনো নির্দিষ্ট পেশার মানুষের জন্য নয়, সবার। তাই ইত্যাদিতে আমরা সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত, কৃষক-শ্রমিক, জেলে, তাঁতী সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা বলি। আমাদের অনুষ্ঠানে উঠে আসে একজন মাঝি, একজন প্রতিবন্ধী, দানশীল ব্যক্তি, সমাজকর্মী, একজন কৃষক বন্ধুর কথা। উঠে আসে দেশের কৃষক-শ্রমিক, জেলে, তাঁতী সব মানুষের সুখ-দুঃখের কথা, উঠে আসে আগামী প্রজন্মের বিজয় ও স্বপ্নের কথা। তাই ইত্যাদি সব শ্রেণির, সব বয়সের মানুষের প্রিয় অনুষ্ঠান।

 

এ অনুষ্ঠানকে মানুষের কাছে প্রিয় করে তোলার মতো কঠিন কাজটি সহজ করেছেন কী করে?

সে জন্যই আমরা একটু সময় নিয়ে ইত্যাদি করি। একটি অনুষ্ঠান নিয়ে ভাবতে হবে, গবেষণা করতে হবে। লক্ষ্য করে দেখবেন ইত্যাদির অনেকগুলো কাজ এখন মানুষের মুখে মুখে। দেশে ভেজাল নিরোধকল্পে প্রথম মোবাইল কোর্ট চালু হয়েছিল ইত্যাদির উদ্যোগেই। দেশে সব পরিবহনের পেছনে কুরুচিপূর্ণ-অশোভন স্লোগানের পরিবর্তে শিক্ষামূলক স্লোগান লেখা শুরু হয়েছে ইত্যাদির মাধ্যমে, পলান সরকারের মাধ্যমে দেশের গ্রামে-গঞ্জে বই পড়ার আন্দোলন, দেশে প্রথম পরিবেশ পদক প্রাপ্ত গহের আলীর মাধ্যমে বৃক্ষরোপণ আন্দোলন কিংবা কয়েকশ কৃষক সন্তানকে নিয়ে পরিচালিত গ্রিন সেভার্সের ছাদকৃষি কার্যক্রম তুলে ধরেছি। যাদের উদ্যোগে এই ঢাকা শহরেই কয়েক হাজার ছাদবাগান হয়েছে। প্রথম বিষমুক্ত সবজি চাষের প্রচার থেকে শুরু করে কৃষিতে প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত ড. কে এম জাকারিয়াকে ইত্যাদিতেই তুলে ধরা হয়েছে। যার সৃষ্টি ‘ফসলে ডাক্তার’ বা ‘টেলি ক্লিনিক’। প্রচারবিমুখ এসব মানুষ কখনো পুরস্কারের পেছনে ছোটেননি, পুরস্কারই তাদের খুঁজে নিয়েছে। আর এসব কাজের জন্যই ইত্যাদি সাধারণ মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে।

 

দীর্ঘদিন ধরে বিটিভিতেই অনুষ্ঠান করছেন, অন্য কোনো চ্যানেলে নয় কেন?

আমি চাই গ্রামগঞ্জ, শহর সব স্থানের দর্শকই যেন আমার অনুষ্ঠানটি দেখতে পারেন। আর সেটি সম্ভব একমাত্র বিটিভিতেই। কারণ এখনো বাংলাদেশের অনেক গ্রামে ক্যাবল সংযোগ নেই। শহুরে বুদ্ধিজীবীদের বাহবা পাওয়া তো আমার উদ্দেশ্য নয়। প্রতিটি সরকারের আমলেই বিটিভির নির্দিষ্ট একটি চরিত্র থাকে, সেই অনুযায়ীই বিটিভি পরিচালিত হয়।

 

অনেকের কথায় ঈদ আনন্দ মানে ইত্যাদি। কোরবানি ঈদের সময় সেটা বেশি অনুভব করা যায়, কারণ তখন ইত্যাদি থাকে না-মন্তব্য করুন।

ঈদ মানে ইত্যাদি কিংবা ঈদ মানে কোনো অনুষ্ঠান এ কথাটা ঠিক নয়। ঈদ মানে আমাদের একটি প্রধান আনন্দ উৎসব। ঈদের সেই আনন্দে বাড়তি মাত্রা যোগ করে ইত্যাদি। দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে ঈদে প্রতিটি পরিবারেরই প্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি। ইত্যাদি যেন প্রতিটি পরিবারের একজন সদস্য। তাই ঈদে ইত্যাদি না থাকলে মনে হয় পরিবারের কে যেন নেই। যেটা কোরবানির ঈদের সময় অনুভব করেন।

 

প্রতি ঈদেই দেখি, ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ...’ গানটি বিভিন্নভাবে প্রচার হয়, যা অন্যরকম একটি আবহের সৃষ্টি করে। এই সাফল্যের গল্প শুনতে চাই।

এক সময় বিটিভিতে চাঁদ দেখার সময় এই গানটি অল্প কজন শিল্পীকে দিয়ে করা হতো। কিন্তু আমরা ভাবলাম এটি যেহেতু আমাদের ঈদের প্রধান সংগীত, তাই এটি জাঁকজমকপূর্ণভাবে উপস্থাপন হওয়া উচিত। সেই চিন্তা থেকেই মূলত প্রতি বছর আমরা ইত্যাদির চরিত্র অনুযায়ী সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে এই গানটি প্রচার করি। এখন চ্যানেলগুলোতে এই গানটির ব্যাপক প্রচার ইত্যাদিরই অবদান। এ গানটি আমরা হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে নিয়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে করেছি, আবার পাঁচ শতাধিক যন্ত্রীকে নিয়ে করেছি, দেশের ছয়টি বিভাগে গিয়ে করেছি, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কয়েকশ কৃষককে নিয়ে, ১৪টি হাতি নিয়ে সিলেটের পাহাড়ি অঞ্চলে, কখনো কয়েকশ কাওয়ালি শিল্পী, বাউল শিল্পী, যাত্রাশিল্পী, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, সর্বশেষ ২০ হাজার শ্রমজীবী মানুষকে নিয়েও গানটি করেছি। আর এবার নৃত্যজুটি শিবলী-নীপার নেতৃত্বে শতাধিক নৃত্যশিল্পীকে নিয়ে করেছি।

 

দর্শক পর্বের জন্য বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে দর্শক নির্বাচন করা হয়। এ ধরনের উপকরণ দেওয়ার কারণ কী?

নিয়মিত ইত্যাদিতে আমরা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে দর্শক নির্বাচন করে থাকি। কিন্তু ঈদ অনুষ্ঠানগুলোতে বৈচিত্র্য আনার জন্য বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে থাকি। পাশাপাশি কিছুটা শিক্ষণীয় বিষয়ও থাকে। প্রত্যেকটি উপকরণের একটি বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন-ইতিপূর্বে দর্শকদের কাকতাড়–য়া দিয়ে বলেছিলাম, ‘কাকতাড়–য়া শুধু কাকের হাত থেকেই নয়-ফসল নষ্ট করা পাখি থেকে শুরু করে অশুভ সবকিছুকে তাড়ানোর জন্য। ঠিক তেমনি ঈদের আনন্দময় মুহূর্তে আমরা সবাই চাই,-যা কিছু অশুভ, যা কিছু অশোভন তার সবকিছুই আমাদের জীবন থেকে দূর হয়ে যাক।’ আবার মুখোশ দিয়ে বলেছি, মুখোশের আড়ালে মুখ বা মুখের ওপর মুখোশ দুটোরই উদ্দেশ্য আসল রূপ গোপন করা। অর্থাৎ মুখোশটা খুলে গেলেই বেরিয়ে পড়ে আসল চেহারা।’ আবার প্রতীকী অ্যাওয়ার্ড দিয়ে বলেছি, ‘এখন অ্যাওয়ার্ডের মান নেমেই চলেছে। এসব অ্যাওয়ার্ডের সঙ্গে মানির সম্পর্ক থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানের সম্পর্ক থাকে না।’ এবারও রয়েছে একটি বিশেষ উপকরণ।

 

ইত্যাদির কিছু নতুন বিষয় দেখলাম-ছন্দে ছন্দে আড্ডা, মিউজিক্যাল ড্রামা ইত্যাদি, তা কেন?

বলতে পারেন, এগুলো ঈদ ইত্যাদির আবিষ্কার এবং আকর্ষণ। কারণ কাজগুলো খুবই জটিল এবং ব্যয়বহুল। এবার একটি জনপ্রিয় আরব্য উপন্যাসের গল্প অবলম্বনে রয়েছে দলীয় সংগীত, লোকসংগীতের সুরে তারকাদের নিয়ে বক্তব্যধর্মী গান, দেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠানের শেষে দেশাত্মবোধক গান। প্রতিটি পর্বেই তারকা শিল্পীদের সঙ্গে শতাধিক শিল্পী অংশগ্রহণ করেছেন।

 

ঈদ ইত্যাদির একটি জনপ্রিয় পর্ব হচ্ছে বিদেশিদের দিয়ে অভিনয়। প্রতিবার এত বিদেশি কীভাবে জোগাড় করেন? এই পর্বের নির্মাণ সম্পর্কে জানতে চাই।

জোগাড় করতে হয় না-দর্শক যেমন এই পর্বটির জন্য অপেক্ষায় থাকেন, তেমনি ঢাকায় বসবাসরত বিদেশিরাও অপেক্ষা করতে থাকেন কখন তাদের ডাক পড়বে ইত্যাদি থেকে। তারা মনে করেন এটি তাদের জীবনে একটি নতুন অভিজ্ঞতা এবং আনন্দ। তাই তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই পর্বটিতে অংশগ্রহণ করেন। মে-জুন মাস এলেই অনেক বিদেশি বন্ধু আমাকে মেইল করেন। ইত্যাদির জন্য অনেক বিদেশি তাদের ছুটিও ভোগ করেন না। আমাদের এখানে অনেকেই যখন মিডিয়াতে ‘বাংলিশ’ উচ্চারণে পরাশ্রয়ী সংস্কৃতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে, আমাদের ভাষার বিকৃতি চলছে, আমাদের লোক সংস্কৃতি ও গ্রামীণ খেলাধুলাগুলোর বিকৃতি চলছে, তখন বিদেশিদের দিয়ে বাংলা ভাষায় গ্রামের সহজ-সরল মানুষের চরিত্রে অভিনয় করিয়ে আমরা তুলে ধরতে চেষ্টা করি আমাদের লোকজ সংস্কৃতি। ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন গ্রামীণ খেলা। প্রতিটি পর্বেরই পরিসমাপ্তি ঘটে চমৎকার একটি মেসেজের মাধ্যমে। আর বিদেশিদের মাধ্যমে আমাদের সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে সারাবিশ্বে।

 

অনুষ্ঠানের পর যখন দর্শকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পান, তখন কেমন লাগে?

মনে হয় আমাদের পরিশ্রম স্বার্থক। আর দর্শকদের এই প্রতিক্রিয়া তো অন্তর থেকে দেওয়া, এটি কোনো প্রাইভেট চ্যানেলের লোগো লেখা মাইক্রোফোন বাড়িয়ে দিয়ে আত্মপ্রচারের জন্য শিখিয়ে দেওয়া প্রতিক্রিয়া নয়। ইত্যাদির জন্য থাকে মানুষের অন্তর নিংড়ানো ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসায় ধন্য হয়েই আমরা তিনটি দশক পাড়ি দিয়েছি। আমরা জানি দর্শক ইত্যাদিকে ভালোবাসেন। আমরাও দর্শকদের ভালোবাসি। সবাইকে ঈদ মোবারক।

সর্বশেষ খবর