রবিবার, ৯ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

নাগরিকত্ব বিতর্কে অঞ্জু ঘোষ

আলাউদ্দীন মাজিদ

নাগরিকত্ব বিতর্কে অঞ্জু ঘোষ

ভারতের রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ‘নাগরিকত্ব’ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ চলচ্চিত্র খ্যাত অভিনেত্রী অঞ্জু ঘোষ। এ অভিনেত্রী এখন বলছেন তার জন্মস্থান কলকাতায়। অথচ তার জন্মস্থান তিনি নিজেই এক সময় জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের ফরিদপুরের ভাঙ্গার কথা। সম্প্রতি ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর অঞ্জুর নাগরিকত্ব প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

অঞ্জু এবং বিজেপির দাবি, অঞ্জু ভারতীয় নাগরিক। অথচ ১৯৮২ সালে এফ কবির চৌধুরী পরিচালিত ‘সওদাগর’ ছবির মাধ্যমে ঢাকাই চলচ্চিত্রে আসা এ অভিনেত্রী ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ রচিত ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস’ শীর্ষক গ্রন্থের জন্য দেওয়া তথ্যে জানিয়েছিলেন তিনি ফরিদপুরের ভাঙ্গায় ৮ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। আর এখন বলছেন তার জন্ম ১৯৬৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর কলকাতার ইস্ট অ্যান্ড নার্সিং হোমে। কলকাতা পৌর কর্তৃপক্ষের সনদেও অঞ্জু ঘোষের জন্মতারিখ লেখা হয়েছে ১৯৬৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। আবার কলকাতায় তার যে প্যান কার্ড রয়েছে, সেখানে তার জন্ম সাল ১৯৬৭। এতে অঞ্জুর জন্মস্থান ও তারিখ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন  উঠেছে, এক এক জায়গায় তার এক এক রকম জন্মতারিখ কেন? বৃহস্পতিবার কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে অঞ্জুর পক্ষে একাধিক নথি পেশ করে বিজেপি। সেই নথিতে একাধিক অসংগতি দেখা গেছে। সংবাদ সম্মেলনে অঞ্জুর জন্মসনদ, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড এবং পাসপোর্টের কপি দাবি করে, তিনি ভারতীয়। অঞ্জুর দাবি ১৯৬৬ সালে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তার জন্ম। এর পক্ষে বিজেপি পেশ করেছে ২০০৩ সালে কলকাতা পৌরসভার থেকে প্রকাশিত তার জন্মের প্রত্যয়নপত্র। তবে অনলাইনে অঞ্জুর জন্মের প্র্রত্যয়নপত্রের রেজিস্ট্রেশন নম্বরের সঙ্গে করপোরেশনের রেজিস্ট্রেশন নম্বরে গরমিল দেখা গেছে। একই নামে দুটি রেজিস্ট্রেশনও পাওয়া গেছে। প্রশ্ন উঠছে, ১৯৬৬ সালে যার জন্ম, তার জন্মের প্রত্যয়নপত্র ২০০৩ সালে দেওয়া হলো কেন? এখানেই শেষ নয়। ইতিপূর্বে বাংলাদেশের একাধিক গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অঞ্জু বাংলাদেশকেই ‘মাতৃভূমি’ বলে দাবি করেছিলেন। এমনকি, একটি সাক্ষাৎকারে সাংবাদিকের ভুল শুধরে বলেন, ‘আমার জন্ম কিন্তু চট্টগ্রামে নয়, ফরিদপুরে। তবে বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে।’ উল্লেখ্য, সত্তর দশক থেকে চট্টগ্র্রামের বিভিন্ন মঞ্চে স্থানীয় জনপ্রিয় মঞ্চ অভিনেতা পংকজ বদ্যের (চলচ্চিত্রে এসে যার নাম হয় সুজন) সঙ্গে জুটি বেঁধে আঞ্চলিক নাটকে দীর্ঘদিন জনপ্রিয়তার সঙ্গে অভিনয় করে যান অঞ্জু ঘোষ। ১৯৮২ সালে চলচ্চিত্রে আসেন তিনি। ১৯৮৬ সালে তার অভিনীত ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ ছবিটি ঢাকাই চলচ্চিত্রের সেরা ব্যবসা সফল ছবির স্থান দখল করে নেয়। আশির দশকের শেষের দিকে ঢাকাই চলচ্চিত্রে তার ক্যারিয়ার যখন পড়তির মুখে এবং কাজের অভাবে দুঃসময়ে পড়েন তখনই তিনি ১৯৯১ সালে কলকাতা চলে যান এবং সেখানকার চলচ্চিত্র ও যাত্রা মঞ্চে নিয়মিত হন। কলকাতা যাওয়ার দীর্ঘ ২৭ বছর পর গত বছর প্রথম বাংলাদেশে আসেন তিনি। তখন কলকাতার পাসপোর্ট নিয়েই তার এদেশে আগমন হয়। এরপর প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা আবু সাইয়িদের নির্মিতব্য ‘মধুর ক্যান্টিন’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য চলতি বছরের শুরুর দিকে আবারও বাংলাদেশে এলে তার ভারতীয় ভিসায় ‘বাংলাদেশের ছবিতে কাজ করতে গেলে ভারত সরকারের অনুমতি নিতে হবে’ এমন শর্ত উল্লেখ থাকায় ছবিটিতে কাজ না করে এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হয় তাকে। এদিকে, কলকাতার সংবাদ সম্মেলনে অঞ্জুর ভারতীয় যে পাসপোর্ট দেখানো হয়েছে, সেটির মেয়াদ শুরুর তারিখ ২০১৮ সালে। যে অভিনেত্রী দীর্ঘদিন ভারতে অভিনয় করেছেন, তার পাসপোর্ট ২০১৮ সালের হয় কী করে? বিজেপির দাবি, এটি তার শেষ জারি হওয়া পাসপোর্ট। প্রশ্ন উঠছে, তা হলে প্রথম পাসপোর্টের তথ্য কোথায়? যদি তিনি নাগরিকত্ব বদলে থাকেন, তাহলে কলকাতার জন্মের সনদ আসে কোথা থেকে? বিজেপি তার যে ভোটার কার্ড দাখিল করেছে, সেটির ইস্যুর তারিখ ২০০২ সাল। অঞ্জু যদি ভারতেরই নাগরিক হবেন, তা হলে ভোটার কার্ড পেতে এত সময় লাগল কেন? এদিকে আরেকটি সূত্র জানায়, ভারতীয় পৌরসভার জন্ম, রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, আধার কার্ড আর ভারতীয় পাসপোর্ট অনুযায়ী অঞ্জুর জন্ম ১৯৬৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। আবার আয়কর দফতরের পারমানেন্ট অ্যাকাউন্ট নাম্বারে জন্ম তারিখ লেখা আছে ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৭। তার দুটি পৃথক জন্মতারিখ কীভাবে হলো বিজেপি এখন পর্যন্ত তার কোনো জবাব দেয়নি। ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনের সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশি নায়িকার ভারতীয় নাগরিকত্বের বিষয়ে তাদের কিছু জানা নেই। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, অঞ্জু ঘোষ দীর্ঘদিন কলকাতায় তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদানের জন্য দৌড়ঝাঁপ করেন। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গেও দেখা করেছিলেন তিনি। একই সময় কলকাতার বিজেপি নেতা পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি দীলিপ ঘোষকে প্রায়ই অঞ্জুর কলকাতার সল্ট লেকের বাসায় যাতায়াত করতে দেখা যেত। এতে সবাই কনফিউজড ছিলেন আসলে অঞ্জু ঘোষ তৃণমূলে নাকি বিজেপিতে যোগ দিতে যাচ্ছেন। অবশেষে ভারতের সাম্প্রতিক জাতীয় নির্বাচনে বিজেপির নিরংকুশ বিজয়ের পর অঞ্জু বিজেপিতে যোগ দিলেন। অঞ্জুর বিজেপিতে যোগদানকে মোটেও ভালো চোখে দেখছে না তৃণমূল কংগ্রেস। কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘দেশের মানুষ আর বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন না। তাই বাংলাদেশ থেকে লোক নিয়ে আসতে হচ্ছে বিজেপিকে। এটি সম্পূর্ণ অবৈধ।’ অঞ্জু ঘোষের বিজেপিতে যোগদান নিয়ে  প্রশ্ন ওঠায় দলটির পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি দীলিপ ঘোষ বলেছেন, এই চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর ভারতীয় নাগরিকত্বের পাশাপাশি তার জন্মও হয়েছে সেদেশে। নিজের এই বক্তব্যের পক্ষে অঞ্জু ঘোষের জন্মসনদও প্রকাশ করেছেন তিনি। অঞ্জু ঘোষ গত বুধবার কলকাতায় বিজেপির প্রধান কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দলটিতে যোগ দেন। অঞ্জুর হাতে দলীয় পতাকা তুলে দিয়েছিলেন দীলিপ ঘোষ। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা অঞ্জু ঘোষের কাছে তার নাগরিকত্বের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি সেটি এড়িয়ে যান বলে উল্লেখ করে ভারতীয় গণমাধ্যম। বিজেপিতে বাংলাদেশি অভিনেত্রী অঞ্জুর যোগ দেওয়ার খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ হয় দেশটির সংবাদমাধ্যমে। তার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সেখানকার অনেকে।

সর্বশেষ খবর