রবিবার, ২৩ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিশ্বসংগীত দিবসের আয়োজন নিয়ে উত্তপ্ত সংগীতাঙ্গন

বিশ্বসংগীত দিবসের আয়োজন নিয়ে উত্তপ্ত সংগীতাঙ্গন
২১ জুন ছিল বিশ্বসংগীত দিবস। ‘সুরের আগুন ছড়িয়ে দেব সব প্রাণে’Ñ এ স্লোগানকে সামনে রেখে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অর্ধশতাধিক কণ্ঠশিল্পী বিভিন্ন দল গঠন করে একে একে পরিবেশন করেছেন ১০টি ভাষার গান। এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। গান পরিবেশনার তত্ত্বাবধানে ছিলেন কণ্ঠশিল্পী দিনাত জাহান মুন্নী। তবে এ আয়োজনকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন ধরে উত্তপ্ত সংগীতাঙ্গন। এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য তুলে ধরেছেন - আলী আফতাব ও পান্থ আফজাল

 

 

আমরা সবাইকে আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছি : লিয়াকত আলী লাকী

এ অনুষ্ঠানের জন্য আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি সিনিয়র শিল্পীকে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছি। তাদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেছি। আমাদের অনুষ্ঠানে অনেক সিনিয়র শিল্পী ও মিউজিশিয়ান উপস্থিত ছিলেন। অনেকে আসতে পারেননি তাদেন নিজেদের কাজের জন্য। যেমন রফিকুল আলম ও আবিদা সুলতানা দেশের বাইরে থাকায় তারা গান পরিবেশন করতে পারেননি।

 

একজন জুনিয়র শিল্পী আমাকে বিষয়টি জানায় : তিমির নন্দী

এ বিষয় নিয়ে কী আর বলব! অন্য বছরগুলোতে আমন্ত্রণ জানায়, এবার জানায়নি। একটা এসএমএস বা ফোনও পাইনি। আমি এ অনুষ্ঠানে পারফরমেন্স না হয় নাই করলাম, অন্তত অনুষ্ঠান দেখতে তো আসতে পারতাম! একটা ফোন করা উচিত ছিল না? শুনেছি বিভিন্ন ভাষায় নাকি অনেকে গান করেছে। কী আর বলব, ডিজি সাহেব তো নিজেই আমার সম্পর্কে ভালো করেই জানেন। আমি অনেক ভাষায় গান করতে পারি। ফেসবুকে এ অনুষ্ঠানের কিছু পারফরমেন্স দেখেছি। হাসির একটা বিষয় হয়েছে, নতুনদের দিয়ে এসব তামাশা কেন করতে হবে? আমি ধিক্কার ও ক্ষোভ জানাই এ আয়োজনের। একজন জুনিয়র শিল্পী আমাকে ফেসবুকে দায়সারাভাবে বিষয়টা জানায়। এটা কি মেনে নেওয়া যায়? সেই শিল্পীর ধারণা করা উচিত ছিল যে সে কাকে আমন্ত্রণ দিচ্ছে! একজন সিনিয়র শিল্পীকে তো এভাবে অপমান করা ঠিক হয়নি। আর শিল্পকলার মতো একটি প্রতিষ্ঠান থেকে আমন্ত্রণ পাওয়ার কথা, তাই না? এবার তো সিনিয়র শিল্পীদের কোনো মূল্যায়নই করা হয়নি। এটা অবশ্য সোহরাব হোসেন ভালো বলতে পারবেন। আর ডিজি সাহেব নতুনদের দিয়ে কী তামাশা করেছেন সেটা তিনিই ভালো জানেন। কী এমন গান করেছে নতুন শিল্পীরা? তরুণদের তো এ সময় কোনো অসুস্থ শিল্পীর পাশেও তেমন করে দেখা যায় না। সুবীর ভাই কিংবা হাবীব ভাইয়ের অসুস্থের সময় অনেক শিল্পীর টিকি পর্যন্ত দেখা যায়নি। আমি ছিলাম সে সময়। ডলি সায়ন্তীর জন্য ফান্ড কালেকশনে যদিও কেউ কেউ ছিল, কিন্তু বিগত সময়ে সিনিয়র অন্য শিল্পীদের পাশে তরুণ শিল্পীদের তেমন করে দেখা যায়নি।

 

সংগীত দিবসে সব শিল্পীর অংশগ্রহণ দরকার : শহীদুল্লাহ ফরায়জী

সংগীত দিবস মানে সব শিল্পী ও কলাকুশলীর একটি মিলন মেলা। এখানে সব শিল্পী একত্রিত হলে অনুষ্ঠানটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক বাড়ত। আর বিষয়টি নিয়ে কারও মনে কোনো কষ্ট থাকা উচিত নয়। আমরা চাই আমাদের দেশের সংগীত বিশ্বের দরবারে আরও সুনাম অর্জন করুক। আর এ জন্য আমাদের সবার এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।

 

আমাকে এখানে ডাকা হয়নি : সুজিত মুস্তফা

আমাকে এখানে ডাকা হয়নি। তবে পরে একজন ফোন করে আসার জন্য রিকোয়েস্ট করেছিল, যেতে পারিনি। গেলে অবশ্য দেখতে পেতাম সেখানে কী হয়েছে, কে কে এসেছে। এখন তো মিউজিক সিনিয়রদের হাতে নেই; সবই তরুণদের হাতে চলে গেছে। তবে, সংগীত যে একটা শেখা ও চর্চার বিষয় সেটা ইদানীং অনুপস্থিত। সব কিছু হচ্ছে উল্টা। এখনকার তরুণরা শেখা ও চর্র্চা ছাড়াই সংগীত করছে। সুবীরদার মতো বড়মাপের আর্টিস্ট তো আর কেউ নেই! সুবীরদা বেঁচে থাকা অবস্থায় যেখানে গানের জন্য নিতেন অর্ধলাখ টাকা, সেখানে নতুন নতুন শিল্পী এসে দাবি করছে ২-৩ লাখ টাকা! তবে, সংগীত সেক্টর নিয়ে ব্যর্থতা প্রাইভেট সেক্টরের হলে মেনে নেওয়া যায় কিন্তু শিল্পকলার মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের হলে সেটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। আমরা বিশ্বাস করি, তরুণদের হাতেই আগামীর জয়ের ঝা-া। কিন্তু সেই পতাকা নিতে হলে তো সিনিয়রদের হাত থেকেই নিতে হবে, তাই না? সেটা এবারের আয়োজিত বিশ্ব সংগীত দিবসে হয়নি।

 

 

আমি শুধু আমার দায়িত্বটুকু পালন করেছি : দিনাত জাহান মুন্নি

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এ অনুষ্ঠানটি প্রতি বছর যেভাবে পালন করে, ঠিক একইভাবে এবারও পালন করা হয়েছে। এ আয়োজনের আমি শুধু একটা পার্টের সমন্বয় করেছি। এর মধ্যে একটা পার্ট আছে যেখানে ১০টা বিদেশি গান বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া। আর এ ১০টা দেশের ভাষার গান গেয়েছে আমাদের তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরা। এ অংশের দায়িত্ব আমি পেয়েছি। তাদের সমন্বয়ক হিসেবে আমি কাজ করেছি। কিন্তু পুরো সংগীত দিবস তো শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করেছে।’ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার চলছে, এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমি নাকি সিনিয়র শিল্পীদের অবহেলা করেছি? আমি যখন একটা বিদেশি গান উপস্থাপন করব সেই গানে কি আমাদের সিনিয়র শিল্পীরা পারফর্ম করবেন চার-পাঁচজন মিলে! এটা কি শোভনীয় দেখায়! আমি এ বিষয়টি মাথায় রেখে আয়োজনটি করেছি। আমি কোনো শিল্পীকে ছোট করার জন্য এ কাজ করিনি। কিন্তু আমি জানি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি বাংলাদেশের প্রত্যেক সিনিয়র শিল্পীকে কার্ড দিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমাদের অনুষ্ঠানের ছবি দেখলে জানতে পারবেন ওই দিন সংগীত দিবস অনুষ্ঠানে অনেক সিনিয়র শিল্পী ও মিউজিশিয়ান উপস্থিত ছিলেন। আমার শিল্পী জীবনের শুরু থেকে কেউ বলতে পারবে না আমি কোনো সিনিয়র শিল্পীকে অশ্রদ্ধা করেছি। আর এ বিষয় নিয়ে আমি কেন সিনিয়র শিল্পীদের অবমাননা করতে যাব, বিষয়টি আমার মাথায় আসে না। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আমাকে যতখানি দায়িত্ব দিয়েছে আমি শুধু তা পালন করেছি মাত্র। আর সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে বাজে কথা ছড়াচ্ছে, বিষয়টি আমার কাছে হস্যকর মনে হয়েছে।

 

এর মাধ্যমে শিল্পীদের দুটি ভাগে বিভক্ত করে দেওয়া হয়েছে : আসিফ আকবর

গান আর সংগীতের সব ইভেন্ট নিয়েই আমি পজেটিভ। আর শিল্পকলায় বিশ্বসংগীত দিবস উপলক্ষে গতকাল যে ইভেন্টটি হলো সেটি নিয়ে আলাদা করে বলার কারণ আছে। আমি নিজে অংশগ্রহণ করেছি কি-না সেটা আমার কাছে জরুরি নয়। আমার কাছে জরুরি হচ্ছে এমন আয়োজনে যারা সিনিয়র শিল্পী রয়েছেন তারা অংশগ্রহণ করছেন কিনা। শুধু শিল্পী কেন দেশের জীবন্ত কিংবদন্তি অনেক সংগীতজ্ঞ রয়েছেন, তারাও এখানে অনুপস্থিত। বিশ্ব সংগীত দিবসে জাতীয় পর্যায়ের এমন একটি আয়োজনের এ দৈন্যদশা কিছুতেই মেনে নেওয়ার নয়। এ আয়োজনে উপস্থিত শিল্পীদের তালিকা দেখলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে। এমন একটি বড় আয়োজনের শিল্পী তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব যাকে দেওয়া হলো, তার নিজের গ্রহণযোগ্যতা? সংগীত জগৎকে বিভক্ত করার যে নীল নকশা প্রণয়ন করা হয়েছিল এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০১৫ সালে আমরা গান মেলার আয়োজন করেছিলাম। তখন লিয়াকত আলী লাকী সাহেব হাসান মতিউর রহমান ও জি সিরিজের নাজমুল হক ভূঁইয়া খালেদকে নিয়ে সে আয়োজন বানচাল করে দেন। আমাদের পরিকল্পনা ছিল গানমেলা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া। এর মাধ্যমে ট্যালেন্ট খুঁজে নিয়ে দেশের সংগীতকে সমৃদ্ধ করা। কিন্তু সে উদ্যোগ বানচাল করে দেওয়া হয়। আর এবার যখন শিল্পকলায় সংগীত দিবস পালন হচ্ছে তখন এ দেশের সংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্বরাই সেখানে অনুপস্থিত। শিল্পীদের কেউ কেউ সিনিয়রদের অনুপস্থিতির প্রতিবাদে অনুষ্ঠান বয়কট করেছেন। আবার তরুণদের অনেকেই ভয়-দ্বিধা নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। আসলে এর মাধ্যমে শিল্পীদের দুটি ভাগে বিভক্ত করে দেওয়া হয়েছে। যেটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার নয়। আমি বরাবরই অনিয়ম আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। এ কারণেই এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সোচ্চার হয়েছি।

সর্বশেষ খবর