রবিবার, ৩০ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভালো নেই চলচ্চিত্রের সহশিল্পীরা

আলাউদ্দীন মাজিদ

ভালো নেই চলচ্চিত্রের সহশিল্পীরা

সহশিল্পী শেফালি এখন ঝালমুড়ি বিক্রেতা

‘ঝালমুড়ি না বেইচ্যা কি করুম কন, ছবির কাজ নাই, কেউ আর ডাকে না। দিনের পর দিন পরিবার নিয়া উপোস থাকি, শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম ঝালমুড়ি বেচার কাজ ধরি, কমপক্ষে একবেলা মুখে দুইটা ভাত তো গুঁজতে পারুম, ধারদেনা কইরা ঝালমুড়ি বেচার সরঞ্জাম কিনছি’- এভাবেই নিজের অসহায়ত্বের কথাগুলো জানালেন চলচ্চিত্রের সহশিল্পী শেফালী। এই শিল্পী এখন এফডিসিতে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। প্রায় ২০ বছর আগে এফডিসিতে পা রেখে কমপক্ষে শতাধিক ছবিতে কাজ করেছেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্রের অবস্থা মন্দ। কাজ হয় না বললেই চলে। ফলে বেকার হয়ে পড়েছেন শেফালীসহ অন্য সহশিল্পীরা। শেফালী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মুড়ি বেচার কাজ কইরা আর কুলাইতে পারতাছি না, আমরা সহশিল্পীরা চেষ্টা করতাছি গার্মেন্টসে চাকরি নেওয়ার, ওইখানে কাজ পাইলে হয়তো দুর্দশা কাইটা যাইব।’

আরেক সহশিল্পী লাভলী বলেন, ‘আমার দুরবস্থার কথা লেইখা কী হইব। আমারে দুইডা ভাত দেন, দিনের পর দিন না খাইয়া আছি, ডায়াবেটিসসহ নানা অসুখে ভুগতাছি, ওষুধ কেনার পয়সাও নাই।’ ৪৩ বছর ধরে এই মাধ্যমে কাজ করছেন তিনি। লাভলী জানান, মাঝেমধ্যে ছবির কাজ হলেও দালালরা বাইর থেকে লোকজন এনে কাজ করায়। পার্টির কাছ থেকে ১ হাজার টাকা নিয়ে কাজ করিয়ে দুই-একশ টাকা ধরিয়ে দেয়। প্রতিবাদ করলে ভয়ভীতি দেখায়, হুমকি দেয়।

অনেকে বাঁচার তাগিদে অনৈতিক পথের আশ্রয় নিয়েছেন। এফডিসির ৮ নম্বর ফ্লোরের পেছনের দেয়াল ঘেঁষে বসে আছেন কয়েকজন সহশিল্পী। তাদের কাছে যেতেই অনেকটা ক্ষিপ্ত হয়ে একজন বলে উঠলেন- ‘সাংবাদিক সাব আমাগো নিয়া লেখা বাদ দেন, কাজ- কাম দেন, আর পারতাছি না। বয়স প্রায় ৪০-এর কোঠায় থাকা এই সহশিল্পী অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলেন, বহুত আশা কইরা এই জগতে পা দিছিলাম, দিনকাল ভালোই চলতাছিল, এক সময় যখন ছবির কাজ কইমা আসে তখন অনেকে ফুর্তি করার লাইগ্যা ডাকত, পেটের ক্ষুধা দূর করতে বাধ্য হইয়া যাইতাম, এভাবেও মোটামুটি চলতাছিল, কিন্তু এখন রূপ যৌবনে ভাটা পড়ায় বেডারা আর কাছে আসে না’। (সঙ্গত কারণে তার নাম প্রকাশ করা হলো না)। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সহশিল্পী বলেন, ৩০ বছর ধরে কাজ করছি, কান্না করতে করতে তিনি বলেন, শিল্পী সমিতি কখনো আমাদের দিকে ফিরে তাকায় না। আমাদের নিজস্ব একটি সংগঠন ছিল। সেটিও নেই। ৪১ বছর ধরে কাজ করা শিল্পী সুফিয়ারও একই অবস্থা। রাস্তা থেকে কাগজ বোতল কুড়িয়ে জীবনটা কোনোভাবে টিকিয়ে রেখেছেন। নূপুর, বয়স পঞ্চাশের বেশি। ১৫-১৬ বছর বয়সে সহশিল্পী হন। পিতৃহারা সন্তানকে মানুষ করতে পরিচালক সমিতিতে ঝাড়ুদারের কাজ বেছে নিতে হয়। সহশিল্পী নাসির এখন এফডিসিতে পান-সিগারেট বিক্রি করেন। ষাটোর্ধ্ব নাজমা আক্তার একসময় ডাক্তারের চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। দিনে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আয় ছিল। আলেয়া বুড়ি, দিলবাহারী, শুকুর জাহান, নূপুর, সুফিয়া, রাবেয়া, আলেয়া, রেবেকা, জাহাঙ্গীর, সেলিম, মেরিসহ প্রায় তিনশ সহশিল্পীর জীবনকাহিনী এমনই মানবেতর। সহশিল্পীদের নিয়ে জুনিয়র আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠনও ছিল। সাড়ে ৩০০ সদস্যকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয় সংগঠনটি। সামান্য আয়ের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ তুলে দিতে হয় দালাল ও চাঁদাবাজদের হাতে। অভিনয় করতে গিয়ে আহত হলে চিকিৎসা পান না নির্মাতা কিংবা সংগঠনের পক্ষ থেকে। এখন চলচ্চিত্রে আইটেম গান যুক্ত হয়েছে। নায়ক-নায়িকার সখা-সখী বা গানের দৃশ্যে নির্মাতা নিজের মানুষ বা ড্যান্স গ্রুপের সদস্যদের আনেন। এতে প্রকৃত সহশিল্পীরা বেকার হয়ে পড়েছেন। এফডিসি প্রতিষ্ঠার পর ‘আমগাছতলা’ খ্যাত স্থানে সহশিল্পীদের কাজের জন্য প্রতীক্ষার নির্দিষ্ট ঠিকানা গড়ে ওঠে। সহশিল্পী নাজমা আক্তার বলেন, একসময় সাড়ে তিন হাজার টাকা ঘরভাড়া দিতাম। এখন বস্তিতে থাকি। তখন আয়ের টাকা দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, এখন উপোস করি। শাহানা জানান, ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি। মা, বোন, ভাবী চরিত্রে অভিনয় করেছেন।  বীণা এসেছেন রামপুরা থেকে। কথা বলতে গেলে বিরক্ত হন। তিনি বলেন, ‘কাজ পাওনের লাইগ্যা বইস্যা থাকতে হয়। আগে তো প্রায় প্রতিদিনই নায়িকার বান্ধবী বা অন্য রোলে অভিনয়ের ডাক পাইতাম। এখন দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকি। কাজ আর পাই না।’ প্রায় অর্ধশত সহশিল্পীর জীবনকাহিনী এমনই মানবেতর। এ দুর্দশার ঘানি টানতে না পেরে

দেহ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া এক সহশিল্পী জানান, তার স্বপ্ন ছিল নায়িকা হওয়ার। তার পছন্দের নায়িকা কারিনা কাপুর। আর নিজের আয়নায় নিজেকে তিনি সেভাবেই দেখতেন। আর সে লক্ষ্য নিয়েই এফডিসিতে আসেন। তার আক্ষেপ তিনি জানতেন না, চলচ্চিত্রের রঙিন দুনিয়াটা বাইরে থেকে যতটা উজ্জ্বল, ভিতরে ঠিক ততটা ফ্যাকাশে। একসময় সহশিল্পী হিসেবে কাজ করলেও ছবি নির্মাণ কমে যাওয়ায় তারও কাজ কমে যায়। নায়িকা হওয়া আর হয়ে ওঠে না। স্বপ্নের মৃত্যু সেখানেই। তারপর বাঁচার তাগিদে এই অনৈতিক পথ বেছে নেওয়া তার।

ছবি : রাফিয়া আহমেদ

সর্বশেষ খবর