শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

শেষ হয়ে গেল যাত্রাশিল্প

পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, অশ্লীলতা, জুয়াসহ নানা কারণে যাত্রাশিল্প তার ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে

মোস্তফা মতিহার

শেষ হয়ে গেল যাত্রাশিল্প

বাংলাদেশের সংস্কৃতির নিজস্ব রূপ যাত্রাপালা। উচ্চ শব্দে, চড়া গলায় সংলাপ প্রক্ষেপণের মাধ্যমে ঐতিহাসিক গল্পগুলো তুলে ধরে যাত্রাশিল্পীরা যুগের পর যুগ দর্শকদের মনের খোরাক দিয়ে আসছিলেন। আলো ঝলমলে মঞ্চে নর্তকীদের উন্মাতাল নৃত্য দেখে শিস বাজানো দর্শকরাই বিবেকের গান ও শানাইয়ের করুণ সুরে অশ্রুসজল হয়ে পড়তেন। সবুজ-শ্যামল রূপে অপরূপ বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি যাত্রাশিল্প বর্তমানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অথচ লোকসংস্কৃতি ও রূপকথার গল্পগুলোকে তুলে ধরার পাশাপাশি যে কোনো সংকটেই বাঙালির পাশে ছিল যাত্রাশিল্প ও যাত্রাশিল্পীরা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তির সঙ্গে পৃথিবী এগিয়ে গেলেও প্রত্যেক দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি তাদের কাছে একটি সম্মানজনক পর্যায়ে রয়েছে। হিপহপ, জ্যাজ, মেটাল ও রক মিউজিকের এই আধুনিক সময়েও আমেরিকা তাদের আদি সংস্কৃতি অপেরাকে এখনো শেষ হতে দেয়নি। কিন্তু দেশের প্রাচীন এই সংস্কৃতিকে রক্ষায় সাংস্কৃতিকজনরা তেমন কোনো পদক্ষেপ নেননি বলে এই যাত্রাশিল্প ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বর্তমানে দারুণভাবে অবহেলিত। বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে দল চালাতে ব্যর্থ হয়ে অনেক মালিকই ইতিমধ্যে তাদের দলগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন। গর্ব করার মতো বৈচিত্র্যময় যাত্রাশিল্প দিন দিন খাদের কিনারে চলে গেলেও এই শিল্পকে রক্ষায় শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষের তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, জীবন ও জীবিকার তাগিদে যাত্রার শিল্পী ও কলাকুশলীরা অন্য পেশায় ঢুকে পড়েছেন। তবে এ বিষয়ে কেউ দুষছেন যাত্রাদলের মালিকদের, কেউ অভিযোগের তীর ছুড়ছেন স্থানীয় প্রশাসনের দিকে, আবার কেউ কেউ আয়োজকদের মানসিকতাকেও দুষছেন। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, অশ্লীলতা, জুয়াসহ নানা কারণে যাত্রাশিল্প তার ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে বলে মনে করেন সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ। যাত্রাশিল্প ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাওয়ার কারণ ও এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় কি? এমন প্রশ্নের উত্তরে যাত্রাব্যক্তিত্ব তাপস সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগে স্কুল-কলেজ যাত্রাপালার আয়োজনের মধ্য দিয়ে তাদের ফান্ড তৈরি করত, কিন্তু এখন সেটি আর করা হয় না। যাত্রাশিল্পে অশ্লীলতা ঢুকে পড়েছে বলেই এই শিল্পকে নিয়ে আজ নানাজনে নানা কথা বলছেন এবং দারুণভাবে অবহেলার শিকার বাঙালির শিকড়ের সঙ্গে মিশে থাকা এই শিল্প।

১৯৭৩ সাল থেকে আমি যাত্রা করি। অমলেন্দু বিশ্বাস ও জ্যোৎস্না বিশ্বাসদের মতো গুণীদের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। যাত্রায় কাজ করতে পেরে আমি নিজেকে নিয়ে একসময় গর্ব করতাম। অনেক স্বপ্নের এই শিল্প বর্তমানে হারিয়ে যাওয়ার পথে, তাই আমি দারুণভাবে মর্মাহত ও ব্যথিত। শিল্পকলা একাডেমি যাত্রাশিল্প নিয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। সে অনুযায়ী কাজের চেষ্টা চলছে। গত বছর তিনটি দলকে তারা তিন লাখ টাকা দিয়েছে। এছাড়া জেলা শিল্পকলা একাডেমিকেও যাত্রার উন্নয়নে ৫০ হাজার টাকা করে দিয়েছে সরকার। আমি মনে করি এই টাকা যৎসামান্য।  অশ্লীলতার মাধ্যমে বেশি আয়-রোজগার করতে গিয়ে অহংকার করার মতো যাত্রাশিল্পকে ধ্বংস করে ফেলছেন যাত্রার মালিকরা। কিছু বিকৃত মানসিকতার মানুষের কারণেই যাত্রাশিল্পীরা তাদের শিকড় থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। যাত্রাশিল্পকে ধ্বংস করার পেছনে স্থানীয় কিছু বিকৃত রুচির মানুষও দায়ী। যে অঞ্চলে যাত্রা হচ্ছে সে অঞ্চলের মানুষের বিকৃত রুচির কারণেই যাত্রাশিল্পে অশ্লীলতা ঢুকে পড়েছে। যাত্রাশিল্প শিকড়ের সংস্কৃতির কদর করে আসছে বলেই রুচিশীল দর্শকদের কাছে যুগের পর যুগ বেঁচে থাকবে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ও রহিম-রূপবান’-এর মতো অনন্য যাত্রাপালা। প্রাচীন যাত্রাশিল্পকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষায় কি করণীয়-  এমন প্রশ্নের উত্তরে যাত্রাব্যক্তিত্ব মিলন কান্তি দে বলেন, যাত্রাশিল্প শেষ হয়ে যাচ্ছে এই বিষয়টি আমি মানি না। যাত্রা কখনো শেষ হওয়ার নয়। এটি কখনোই বিলুপ্ত হবে না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবে, তবু যাত্রাশিল্প শেষ হবে না। তবে মূল্যবোধের অভাবের কারণে বর্তমানে এই শিল্পের দুরবস্থা। শিল্পকলা একাডেমি এ নিয়ে প্রচুর কাজ করছে। তারা একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। সেই অনুযায়ী দলগুলো নিবন্ধিত হচ্ছে। তবে মাঠপর্যায়ে কাজ করা শিল্পকলা একাডেমির দায়িত্ব নয়। সেটা করবে  জেলা প্রশাসন।

যাত্রার নামে অশ্লীলতা হচ্ছে- এমন অজুহাতে ডিসিরা তাদের জেলায় যাত্রার অনুমতি দিচ্ছেন না। যার কারণে যাত্রার পথচলা থমকে যাচ্ছে। এখনকার ডিসিরা তো যাত্রা বোঝেনও না। যাত্রা বলতে তারা মনে করেন অশ্লীলতা। কারণ তারা যখন ডিসি হয়েছেন তখন যাত্রার নামে অশ্লীলতাই ছিল। তবে কেউ কেউ ভালোও আছেন। জাতীয় পর্যায়ে একটি যাত্রামঞ্চ তৈরি করা, শীতকালে যাত্রা উৎসবের আয়োজন করা ও ৬৪টি জেলায় যাত্রা উৎসবের আয়োজনে প্রজ্ঞাপন জারি করা- সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাছে আমরা এই তিনটি দাবি রেখেছি। এগুলো বাস্তবায়িত হলে খুঁড়িয়ে চলা যাত্রাশিল্প দ্রুতগতিতে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে বলেই আমি মনে করি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর