বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

শিশুতোষ চলচ্চিত্র কেন উপেক্ষিত

আলাউদ্দীন মাজিদ

শিশুতোষ চলচ্চিত্র কেন উপেক্ষিত

চিলড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশ সংগঠনের কর্মকর্তা মুনিরা মোরশেদ আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘শিশুদের চলচ্চিত্র এখন আমাদের দেশে উপেক্ষিত। নির্মাতা থেকে শুরু করে সমাজের সবাই মনে করেন, এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়। আমাদের অনুরোধে প্রধানমন্ত্রী অনুদানের চলচ্চিত্রে একটা করে শিশু চলচ্চিত্র বানানোর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন। অথচ পরে এ বিষয়টি আর জোর পায়নি।’ মুনিরা মোরশেদের আক্ষেপের সুর ধরেই বলা যায় সত্যিই এখন ঢাকাই নির্মিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র উপেক্ষিত। শিশু-কিশোরদের জন্য প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন মাসিক ‘সিনেমা’র সম্পাদক ফজলুল হক। তার স্ত্রী লেখিকা রাবেয়া খাতুনের কাহিনি নিয়ে তিনি নির্মাণ করেন ‘সান অব পাকিস্তান’। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা দফতরের প্রযোজনায় চলচ্চিত্র সংসদকর্মী ও পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটের তত্ত্বাবধানে সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী নির্মাণ করেন ‘অংকুর’ চলচ্চিত্রটি। পরে তিনি শিশু একাডেমির প্রযোজনায় নির্মাণ করেন আরেকটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘গল্প দাদুর গল্প কথা’। এরপর ১৯৮০ সালে আরেক চলচ্চিত্র সংসদকর্মী বাদল রহমান সরকারি অনুদানে নির্মাণ করেন ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’। ছবিটি সেরা ছবি হিসেবে ও বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র ও বাচসাস পুরস্কার লাভ করে। এরপর খান আতাউর রহমানও শিশু একাডেমির প্রযোজনায় নির্মাণ করেন ‘ডানপিটে ছেলে’। এই ছবিটিও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। স্বাধীনতার পর সরকারি পর্যায়ে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলে তাতে সিদ্ধান্ত ছিল সরকারি অনুদানে নির্মিত তিনটি ছবির মধ্যে অবশ্যই একটি শিশুতোষ হতে হবে। সত্তর দশকের শেষের দিকে ড. আশরাফ সিদ্দিকীর   লেখা গল্প ‘গলির ধারের ছেলেটি’ অবলম্বনে সুভাষ দত্ত তৈরি করেছিলেন ‘ডুমুরের ফুল’ শিশুতোষ চলচ্চিত্রটি। এরপর আজিজুর রহমানের ‘অশিক্ষিত’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, সিবি জামানের ‘পুরস্কার’ শিশুতোষ ছবিগুলোও জাতীয় পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা এবং সর্বস্তরের মানুষের প্রশংসা কুড়ায়। সত্তর ও আশির দশকে সংখ্যায় কম হলেও ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে  পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়েছিল। পরিতাপের বিষয়, নব্বই দশক থেকে যখন ভারতের চলচ্চিত্রের মান ক্রমে বেড়ে হলিউডের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার পর্যায়ে চলে গেছে সেখানে আমাদের শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ থমকে গেছে। কালেভদ্রে এ জাতীয় ছবি নির্মাণ হলেও এর সংখ্যা হতাশাজনক। ২০০৯ সালে নির্মাণ হয় দেশের প্রথম শিশুতোষ ডিজিটাল চলচ্চিত্র ‘দূরবীন’। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস দূরবীনের আলোকে নির্মিত এই ছবিটির জন্য পরিচালক জাফর ফিরোজ মুম্বাই ফিল্ম একাডেমি থেকে আন্তর্জাতিক ক্যাটাগরিতে সেরা চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে পুরস্কার অর্জন করেন। বাংলাদেশি নির্মাতাদের মধ্যে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণে সবচেয়ে সফলতা দেখিয়েছেন মোরশেদুল ইসলাম। তার নির্মিত ‘দীপু নাম্বার টু’ (১৯৯৬), ‘দূরত্ব’ (২০০৪) ও ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ (২০১১), ‘আঁখি ও তার বন্ধুরা’ (২০১৭) শিশু-কিশোরদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। দুঃখের বিষয় হলো ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি’ এ যাবৎ পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য মিলিয়ে মাত্র বিশটির মতো শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে। তথ্য-প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নে এবং বিশ্বায়নে পুরো পৃথিবী হাতের মুঠোয় চলে আসায় স্বভাবতই উন্নত বিশ্বের তৈরি হাইটেক শিশুতোষ মুভি শিশুদের এবং অভিভাবকদের এখন অতিমাত্রায় আকর্ষণ করছে। ২০০০ সালে ‘মন্টু মিয়া অভিযান’ নামে এনিমেশন একটি মুভি তৈরি করা হয়। প্রচার হয় একুশে টিভিতে। এর তিনটি পর্ব নির্মাণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশে আর কোনো সম্পূর্ণ শিশুতোষ এনিমেশন মুভি নির্মাণের তথ্য নেই। সবমিলিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকাই ছবিতে শিশুতোষ চলচ্চিত্র রয়ে গেছে উপেক্ষিত। যা সত্যিই হতাশাজনক। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আজিজুর রহজমান বলেন, শিশু-কিশোরদেরও অবশ্যই একটি নিজস্ব জগৎ আছে। তাদের নিজস্ব ধরন আছে। তাদের চলচ্চিত্র তাদের নিজস্বতার মাপেই হওয়া উচিত। যে কারণেই শিশুতোষ চলচ্চিত্র একটি আলাদা গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য। টেকনো যুগে ডিজিটাল মিডিয়ার প্রভাব অনস্বীকার্য। আর সে কারণেই সবাক চলচ্চিত্র শিশুর মনন গঠনে সময়ের সবচেয়ে কার্যকর উপকরণ। একটা সময় কমিকস আর রূপকথার বইগুলোই মূলত ছিল শিশুদের কল্প জগতের খোরাক। হলিউড শিশুদের প্রিয় প্রতিটি কমিকস আর রূপকথার ক্যারেকটারকে ডিজিটাল পর্দায় নিয়মিত হাজির করেই চলেছে। শিশু কিশোররা আকৃষ্ট হচ্ছেই। বাণিজ্যও হচ্ছে প্রচুর। শিশুতোষ চলচ্চিত্র বানিয়ে পরিচালক-প্রযোজককে লগ্নি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। অথচ আমাদের দেশে চলছে এর ভিন্নতা। সরকারি অনুদান পেলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ জাতীয় ছবি নির্মাণ অধরাই রয়ে যায়। শিশুতোষ চলচ্চিত্র এখন এখানে প্রায় উপেক্ষিত বলা যায়। যা দুঃখজনকও বটে।

সর্বশেষ খবর