শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা
পুনর্জাগরণে কাজ করছে শিল্পকলা একাডেমি

ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত পুতুলনাচ

মোস্তফা মতিহার

ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত পুতুলনাচ

আবহমান বাংলার শিকড়ের সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ পুতুলনাচ। লোককাহিনি ও রূপকথাকে নাচ ও গানের অনন্য পরিবেশনার মাধ্যমে মানুষকে বিনোদিত করার যে ধারা এদেশে প্রচলিত রয়েছে সেটাই পুতুলনাচ। এদেশের গর্ব করার মতো সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত পুতুলনাচের দীপ্তিমান ধারা বর্তমানে ম্রিয়মান হয়ে পড়েছে। নিভু নিভু করে জ্বলে থাকা লোকশিল্পের গর্ব করার মতো এই মাধ্যমটিই বাঙালিকে বিশে^র দরবারে পরিচিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম মূল ভূমিকা পালন করেছে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে কোনো তথ্য দ্রুত প্রচার, জনসচেতনতা তৈরি, গণশিক্ষা প্রসার, পণ্য বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে প্রচারণা ইত্যাদি কাজেও পুতুলনাচের প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিগত কয়েক দশক ধরে সংস্কৃতির এ মাধ্যমটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের কৃষ্ণনগরের বিপিন পাল প্রথম পুতুলনাচের প্রচলন করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ওই সময় তিনি সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে পুতুলনাচ করতেন বলে জানা যায়। বিপিন পালের পথ ধরে পরবর্তীতে একই গ্রামের গিরীশ আচার্য্য, মো. তারু মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মেরুন্ডা এলাকার ধন মিয়া, কালু মিয়া, মো. রাজ হোসেন ও পৌর শহরের কাজীপাড়া এলাকার শরীফ মালদারও এদেশের পুতুলনাচের প্রসার ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যতদূর জানা যায়, পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে পরিচালিত পুতুলনাচ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনপদের এক ঐতিহ্য। বছরের বিশেষ সময়ে মেলায় তারা পুতুলনাচ প্রদর্শন করে থাকতেন। কালের বিবর্তনে ঐতিহ্যবাহী সেই পুতুলনাচ তার ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ ইটকাঠের যান্ত্রিক নগরে বেড়ে উঠা শিশুরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি পুতুলনাচ সম্বন্ধে খুব একটা ওয়াকিবহাল নন। আধুনিকতার ব্যাপক বিস্তৃতির কারণে পুতুলনাচ ছিটকে পড়েছে তার নিজস্ব গতিপথ থেকে। যার কারণে বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচকে সংস্কৃতির মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে এবং বিশ্বদরবারে তুলে ধরার লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় পুতুলনাচের নীতিমালা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুতুলনাচ ও এই শিল্পের শিল্পীদের মূল্যায়ন কর্মকান্ডের অংশ হিসেবে চারজন পুতুলনাচ শিল্পীকে অনুদান দিয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।

একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর পরিকল্পনায় ইতিমধ্যেই পুতুলনাচের চারটি প্রযোজনা নির্মিত হয়েছে যা দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। নির্মিত চারটি প্রযোজনার জন্য চারজন শিল্পীকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদানও দিয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। অনুদানের অর্থ দিয়ে নতুন প্রদর্শনীর ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির এই ধারার মান উন্নয়নে কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন শিল্পীরা। প্রদর্শনীর আয়োজন, কর্মশালা পরিচালনা, মুক্ত আলোচনা এবং আন্তর্জাতিক পুতুলনাচ উৎসবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পুতুলনাচ দলের নিয়মিত অংশগ্রহণ, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুতুলনাচ ও এই শিল্পের শিল্পীদের মূল্যায়ন কর্মকান্ডেরই অংশ। এছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি নিয়মিতভাবে বিশ্ব পুতুলনাচ দিবস উদযাপন করে আসছে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী ও মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর আরও চারটি নতুন প্রযোজনা নির্মাণের জন্য চারজন লেখকের মাধ্যমে স্ক্রিপ্ট তৈরির কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, আবহমান বাংলার সংস্কৃতির এই ধারাকে উজ্জীবিত করতে ও আধুনিক এই সময়ে পুতুলনাচকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে সংস্কৃতিবান্ধব সরকার বেশকিছু পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে। সরকারের আন্তরিকতার ফলেই পুতুলনাচ নতুন করে বিকশিত হচ্ছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় সংস্কৃতির এই মাধ্যমটিতে একটি আশাতীত জাগরণ ঘটতে যাচ্ছে বলেও জানান লিয়াকত আলী লাকী। তিনি আরও বলেন, পুতুলনাচের প্রচার ও প্রসারে শিল্পকলা একাডেমি নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর