শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

রুপালি পর্দায় ববিতার ৫০ বছর

রুপালি পর্দায় ববিতার ৫০ বছর

ভেন্না পাতার ছানি বা রাজপ্রাসাদ নয়, বিশাল এক প্রকৃতির রাজ্যে বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতার বসবাস। গুলশানে ববিতার বাসায় প্রবেশ করলেই ফুলের সৌরভ আর পাখির কলতানে অনাবিল মুগ্ধতায় ভাসতে হয় যে কাউকে। এই স্বর্গীয় প্রকৃতি গড়ে তুলেছেন গ্লামার কুইন নায়িকা-খ্যাত ববিতা নিজেই। ফুল আর পাখির অনাবিল আনন্দে এই মহানায়িকা জানালেন চলতি বছর চলচ্চিত্র জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করলেন তিনি। তার চলচ্চিত্র জীবন নিয়ে আড্ডায় মেতেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

 

চলচ্চিত্রে যাত্রার গল্প...

চলতি বছর আমার চলচ্চিত্র জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হলো। চলচ্চিত্রে আমার যাত্রার গল্পের শেষ নেই, মাত্র ১৩ বছর বয়সে মানে পুতুল খেলার সময় অভিনয়ে এসেছি। ১৯৬৮ সাল। শ্রদ্ধেয় নির্মাতা জহির রায়হানের উৎসাহে ‘সংসার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু। এতটুকু বয়সে বেশি কিছু বোঝার কথা নয়। তারপরও একটি বিষয় আমাকে খুব ভাবাতো, ভোগাতো। তখন দেশ স্বাধীন হয়নি। এ দেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান। এখানে তখন আবদুল জব্বার খান, জহির রায়হান, এহতেশাম, মহিউদ্দিন, সালাউদ্দীন, সুভাষ দত্ত, খান আতা, আমজাদ হোসেন, আজিজুর রহমান মিতা, কামাল আহমেদ, কাজী জহির প্রমুখের মতো গুণী নির্মাতার হাতে শিল্পমানের ছবি নির্মাণ হতো। সেগুলো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ পেত না। আমন্ত্রণ জানানো হতো পশ্চিম পাকিস্তানের ধুম-ধাড়াক্কা বাণিজ্যিক ছবিগুলোকে। আমার ছোট্ট মনে বাংলা ছবির প্রতি এই অবজ্ঞা খুব কষ্ট দিত। এক সময় দেশ স্বাধীন হলো। এই বন্ধ্যত্ব কাটল। এ দেশের ছবি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসার ঝড় তুলতে শুরু করল। পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় তার ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে অনঙ্গ বউ চরিত্রে আমাকে কাস্ট করলেন। ছবিটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঝড় তুলল। ছবিটি নিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করলাম। বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে ছুটে গেলাম বুড়িগঙ্গা থেকে ভলগা হয়ে বিশ্বের আনাচে-কানাছে। সবাইকে জানালাম ববিতা বাংলাদেশের মেয়ে, এসেছি বাংলা ছবির বিশ্বজয়ে। সবাই সাদরে গ্রহণ করল এই দেশের ছবি আর ববিতাকে। রাশিয়ায় তখন বলিউড অভিনেতা রাজকাপুরের জয়জয়কার। বিমানবন্দর থেকে সব জায়গায় তার ছবি ব্লোআপ হতো। একসময় অবাক চোখে দেখলাম রাজকাপুরের ছবির পাশে ববিতার ছবি স্থান করে নিয়েছে। মানে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের সম্মানজনক চিত্র ফুটে উঠেছে। বিশ্বের জনপ্রিয় পত্রিকাগুলো গুরুত্ব দিয়ে আর্টিকেল তৈরি করল সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা ববিতাকে নিয়ে। বিশ্বের প্রধান চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে আমি হয়ে গেলাম ডার্লিং অব দ্য ফেস্টিভাল। ফেস্টিভালের ওপেনিং আর ক্লোজিং হতো আমার হাতে। পৃথিবীর খ্যাতনামা ইউনিভার্সিটিগুলোতে বক্তব্য রাখতে হয়েছে। শিল্পমান ও বাণিজ্যিক ঘরানার ছবিতে অভিনয় করেছি। অনেক সময় দেখেছি একটি ভালো ছবি নির্মাণ করতে গিয়ে নির্মাতা পারিশ্রমিক দিতে পারছেন না। তখন বিনা পারিশ্রমিকে সেই কাজ করে দিয়েই শুধু ক্ষান্ত হইনি; আর্থিক আর অন্য যেভাবে সম্ভব সহযোগিতা করেছি। আমার অভিনয় জীবনের চলার পথে সাংবাদিকদের সহযোগিতা ছিল অফুরন্ত। তাদের গঠনমূলক লেখনীতে নিজের অভিনয়কে আরও শানিত করতে পেরেছি। মায়ের মৃত্যুর পর আমাকে আগলে রেখেছেন বড় বোন সুচন্দা ও ছায়ার মতো পাশে থেকেছে ছোট বোন চম্পা। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অগণিত স্বীকৃতি এবং দর্শক-ভক্তের ভালোবাসায় আমি দেশ, জাতি এবং চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।

 

ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম

‘মা (বেগম জাহানারা) ডাক্তার ছিলেন। আমিও ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। ছোটবেলায় সুচন্দা আপার সঙ্গে শুটিংয়ে গিয়ে দেখতাম, একই শট তিনি বারবার দিচ্ছেন। খুব বিরক্ত লাগত, বোন এত কষ্ট করছে? সিনেমা করতে এত কষ্ট করতে হয়? সিদ্ধান্ত নিলাম, অভিনয় করব না। এর মধ্যে জহির রায়হান ভাইয়ের সঙ্গে আপার বিয়ে হলো। তিনি বললেন, ‘পপি (ডাকনাম), আমার সিনেমায় তোকে টিনএজ মেয়ের অভিনয় করতে হবে।’ বয়সও তখন ১২-১৩। আমি বেঁকে বসলাম-ভালো লাগে না, করব না। মা-বোন খুব বোঝালেন, দুলাভাই বলছে, কর। ছবিটির নাম ‘সংসার’। রাজ্জাক ভাই আমার বাবা, সুচন্দা আপা মা। শেষ পর্যন্ত ছবিটিতে কাজ করলাম। মানে বড় পর্দায় অভিষেক আমার।

 

যেভাবে ববিতা হলাম

‘সংসার’-এর বছর দুয়েক পর জহির রায়হানের পরের ছবি ‘জ্বলতে সুরজ কি নিচে’তে কাজ করি। ছবির প্রযোজক বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান আফজাল চৌধুরী আর তার স্ত্রী মিলে আমার নাম দিলেন ববিতা।

 

প্রথম ছবির মুক্তির দিনেই মা মারা যান

সংসার ছবির পর জহির রায়হান আমাকে প্রথমবারের মতো নায়িকা করে ‘শেষ পর্যন্ত’ নির্মাণ করলেন। এ ছবির নায়ক ছিলেন রাজ্জাক ভাই। মানে আমার পর্দা জীবনের প্রথম নায়ক তিনি। ছবিটি ১৯৬৯ সালের ১৪ আগস্ট মুক্তি পায়। সেই থেকে ‘নায়িকা ববিতা’র যাত্রা শুরু। দুর্ভাগ্যক্রমে ওই দিনই আমার মা মারা যান। ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবির পারিশ্রমিক পেয়েছিলাম ১২ হাজার টাকা। ওই টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছিলাম। ইচ্ছে ছিল মাকেই প্রথম গাড়িতে চড়াব। সেই ভাগ্য আর আমার হলো না।

 

অনিককে নিয়ে একাই সংগ্রাম করেছি

১৯৯৩ সালে স্বামী ইফতেখার আলমের অকাল মৃত্যুর পর একাই সংগ্রাম করে আদরের ধন পুত্র অনিককে মানুষ করেছি। ব্যস্ততা যখন প্রবল ছিল, সেই সময়েও মায়ের আদর-ভালোবাসা থেকে অনিককে বঞ্চিত করিনি। জানতাম, যে সন্তান মায়ের আদর-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়, সেই সন্তান জীবনের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়। তাই অভিনয়ে শত ব্যস্ততার মাঝেও সন্তানের জন্য ঠিকই সময় বের করে নিয়েছি। তাই অনিক আজ সুশিক্ষায় শিক্ষিত একজন মানুষ। অনিককে নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে ঘুরতে গিয়েছি। তাকে যে বিষয়টি সবচেয়ে অবাক করত, তা হলো পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য। যেখানেই ঘুরতে গিয়েছি, অনিক শুধু বই কিনতে চাইত। অভিনয় তাকে কখনই টানেনি। যে কারণে আমারও কখনো ইচ্ছে হয়নি তাকে অভিনয়ে দেখার। দেশে আর দেশের বাইরে সবার কাছে ছিলাম একজন অভিনেত্রী, কিন্তু ছেলে অনিকের কাছে শুধুই সংগ্রামী মা। অনিকের বাবা যখন মারা যান, তখন ওর বয়স তিন বছর। শুটিংও ফেলে রাখা যাবে না। এর মধ্যে ভালো ভালো ছবি করার প্রস্তাব ছাড়তে হয়েছে। অনিক যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করে, তখন ওর ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। পরীক্ষার সময় এটা বেশি করতে হতো। এমন হতো, অনিক কোচিং করবে, আমি রাস্তায় গাড়ির মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। ববিতা নায়িকা, ওসব গুল্লি মারো! আমার তখন চিন্তা, ছেলেকে মানুষ করতে হবে। কোচিং শেষে যখন নিচে নামত, তখন ওকে নিয়ে বাসায় ফিরতাম। অনিকের পড়াশোনার চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি শুটিংয়ের সময় সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত করে নিয়েছিলাম। অনেকটা অফিসের মতো। কানাডার ওয়াটার লু ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষে ছেলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম।  অনেক সম্মান পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, স্বপ্নপূরণ হয়েছে, পরিশ্রম সার্থক। অনিকের বয়স তখন ১০-১২ হবে, একদিন স্কুল থেকে ফিরে বলে তার বন্ধুর মা কত ভালো রান্না করেন। এখন উপায়। মাত্র ১৩ বছর বয়সে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করি। কাজের চাপে রান্নাটা ঠিকমতো শেখা হয়নি। কিন্তু ভালো মা হতে হলে যে ছেলের মনে কোনো অপূর্ণতা রাখা যাবে না। কিনে আনলাম সিদ্দিকা কবীরের রেসিপির বই-রান্না, খাদ্য, পুষ্টি। একদিন নিজের হাতে নানা পদের খাবার রান্না করে খাইয়ে অনিককে তাক লাগিয়ে দিলাম। অনিক বেশ খুশি। মা হিসেবে আমি সার্থক।

 

শিশুদের কল্যাণে কাজ করতে পেরে গর্বিত

আন্তর্জাতিক শিশু সাহায্য সংস্থা ডিসট্রেস চিলড্রেন অ্যান্ড ইনফান্টস ইন্টারন্যাশনাল (ডিসিআইআই) ২০১২ সালে আমাকে শুভেচ্ছাদূত মনোনীত করে। তখন থেকে বিশ্বব্যাপী সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও তাদের পরিবারের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছি। বিশ্বের সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও তাদের পরিবারের কল্যাণে নিজেকে যুক্ত করতে পেরে গর্ববোধ করছি। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও তাদের দুঃখ-কষ্ট মোচন করা সবারই দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই দায়িত্ব আজীবন পালন করে যেতে চাই।

 

চলচ্চিত্রের দৈন্যদশায় আমি উদ্বিগ্ন

চলচ্চিত্রের বর্তমান অচলাবস্থা নিয়ে আমি গভীর উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার শোবিজ বিভাগে একটি সংবাদ দেখে আমি আশাহত ও ভীত হয়েছি। সংবাদটি হলো- দেশের ২৫টিরও বেশি জেলা শহরে কোনো সিনেমা হল নেই। ছবির অভাবে লোকসান গুনে মালিকরা সিনেমা হলগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। দেশে মাত্র ১৭০টির মতো সিনেমা হল আছে। চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। কলকাতার ছবি আমদানি করেও সিনেমা হলে দর্শক আনা যাচ্ছে না। মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যাও কমেছে। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে চলচ্চিত্র থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। একটি দেশের প্রধান গণমাধ্যম হলো চলচ্চিত্র। দেশ যদি এই মাধ্যম শূন্য হয়ে পড়ে তাহলে সমাজে নানা অপরাধ বাড়বে। দেশ, সমাজ ও পারিবারিক সচেতনতামূলক নানা ম্যাসেজ বিনোদনের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়। মফস্বল শহরে সিনেমা ছাড়া বিনোদনের তেমন কোনো উপাদান নেই।  সিনেমার অভাবে সেখানে যুবসমাজের মধ্যে অপরাধ বাড়ছে।

 

এখন প্রকৃতির রাজ্যে আমার বসবাস

ছোটবেলা থেকে প্রকৃতি আমাকে খুব কাছে টানে। মনে হয় যেন ইশারায় শিস দিয়ে ডাকছে। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বারে বারে প্রকৃতির কাছে ফিরে যাই। একসময় ভাবলাম প্রকৃতিকে নিজের ঘরে নিয়ে এলে কেমন হয়? ইট, কাঠের এ শহরে নৈসর্গিক প্রকৃতির দেখা চাইলেই তো আর মিলবে না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগে যখন-তখন গ্রামেগঞ্জেও ছুটে যেতে পারি না। এ ভাবনা থেকে নিজের ঘরেই গড়ে তুলেছি এক অপরূপ নৈসর্গিক পরিবেশ। চমৎকার ফুল, ফল আর সবজির বাগান। সঙ্গে আছে হরেকরকম পাখি। আমার গুলশানের বাড়ির ছাদ যেন এখন এক স্বর্গীয় সুখের আধার। চারদিকে রং বেরঙের ফুলের মহাসমারোহ। সঙ্গে আছে পাখির কলতান। সব মিলিয়ে চোখ জুড়ানো পরিবেশ। গাছের প্রতি আমার এ ভালোবাসা বংশগত। বাবার হাতে গাছ বেশ ভালো হতো। তিনি যেখানে যেতেন সঙ্গে করে গাছ নিয়ে আসতেন। তা দেখে সেই একরত্তি বয়স থেকেই প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যাই। মেয়েরা শপিংয়ের প্রতি দুর্বল হয়। আমি কিন্তু দেশে-বিদেশে প্রথমে খবর নেই কোথায় নার্সারি আছে। ফুল-ফলের গাছ সংগ্রহ করি। এগুলো আমার কাছে শাড়ি-চুড়ি-গহনার চেয়েও অনেক দামি। ফজরের নামাজ পড়ে ছুটে যাই বাগানে। নিজ হাতে পরম মায়ায় প্রিয় গাছের যত্ন নেই। বিকালে যখন বাগানে পায়চারি করতে যাই তখন আমার প্রিয় টিয়া পাখিটি এসে আমার কাঁধে না হয় মাথায় বসে। আমার সব কথা বোঝে আর শুনে। যে গাছটিকে অতি যতেœ বড় করে তুলি সে আমাকে সুন্দর ফুল দিয়ে মুগ্ধ করে। আমার সব একাকিত্ব দূর করে দেয়। পরমানন্দে সময় কেটে যায়...।

 

বাবার কবরেই যেন আমাকে দাফন করা হয়

আমার বিয়ের মাত্র চার মাস পরই আব্বা এএসএম নিজাম উদ্দিন আতাউব ইন্তেকাল করেন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। আমার জীবনের সাফল্যের মূলমন্ত্র কিন্তু আব্বার কাছ থেকেই পাওয়া। এই যে আমি এত পরিপাটি থাকি, গুছিয়ে থাকার চেষ্টা করি, এটা আব্বার কাছ থেকেই পাওয়া। আব্বা যখন অফিস থেকে আসতেন, তখন আমরা সবাই আব্বাকে পান বানিয়ে খাওয়াতাম। আব্বা তখন বেশ আয়েশ করে পান খেতেন। আব্বার পা টিপে দিতে দিতে তখন সব আবদার করতাম। আব্বা আমাদের সেই আবদার রাখতেন। আবার আব্বা অনেক সিনেমা দেখতেন। সিনেমা দেখে আমাদের মজার মজার গল্প বলতেন এবং সেসব গল্পে আব্বা আমাদের অভিনয় করতে বলতেন। সেখান থেকেই কিন্তু অভিনয়ে আমার অনুপ্রেরণা আসা। পরে যখন আমি সিনেমার নায়িকা হিসেবে কাজ শুরু করি, তখনো আব্বা আমাকে অনেক অনুপ্রেরণা দিতেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ সিনেমায় অভিনয়ের আগে আব্বাই সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে চিঠি আদান-প্রদান করতেন ইংরেজিতে। শুটিংয়ের সময় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আব্বার চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। আমার ইংরেজি শেখার খুব শখ ছিল বিধায় আব্বা আমাকে ছোটবেলায় একটি ডিকশনারি কিনে দিয়েছিলেন। আমি তখন প্রথম শ্রেণিতে পড়ি। বাগেরহাটে থাকি সবাই। সবাই আমাকে রেখে মামার বাড়ি যাবে বেড়াতে। আমি বুদ্ধি করলাম কীভাবে আব্বাকে রাজি করানো যায়। আব্বা সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় ফেরার সময় আমিই হারিকেন নিয়ে আব্বাকে এগিয়ে আনতে গেলাম। আমাকে দেখে আব্বা ভীষণ খুশি, কারণ তখন বিদ্যুৎ ছিল না। অন্ধকারে আব্বাকে এগিয়ে আনতে গিয়েছিলাম। আব্বা তখন খুশি হয়ে বললেন, কী চাও মা? আমি বললাম, আমাকেও সঙ্গে করে মামার বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। আব্বা রাজি হলেন। আমার পপি নামটি আব্বা এবং মা ডা. বেগম জাহানারা উভয়ে মিলেই রেখেছিলেন। আব্বা আমার জীবনের আদর্শ। তাই আমার ইচ্ছা, আমার মৃত্যুর পর যেন বনানী কবরস্থানে আব্বার কবরেই আমাকে দাফন করা হয়।

 

আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও সম্মাননা

বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে সবচেয়ে বেশিবার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং পুরস্কৃত হয়েছেন ববিতা। তিনি প্রায় ৩০০ ছবিতে অভিনয় করেছেন। বাদী থেকে বেগম (১৯৭৫), নয়নমনি (১৯৭৬), বসুন্ধরা (১৯৭৭), রামের সুমতি (১৯৮৫) এবং পোকামাকড়ের ঘর বসতি (১৯৯৬) ছবির জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে ‘হাছন রাজা’, ‘খোদার পরে মা’ ও ‘কে আপন কে পর’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার এবং সর্বশেষ জাতীয় পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা লাভ করেন। তার অভিনীত সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি নারগিস আক্তারের ‘পুত্র এখন পয়সাওয়ালা’ (২০১৫)। নিজের প্রযোজনা সংস্থা ববিতা মুভিজ থেকে নির্মাণ করেছেন ‘ফুলশয্যা’, ‘আগমন’, ‘পোকামাকড়ের ঘর বসতি’র মতো জনপ্রিয় ও জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত ছবিগুলো। পোকামাকড়ের ঘরবসতি ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ প্রযোজকের জাতীয় পুরস্কারও পান তিনি। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত অশনি সংকেত (১৯৭৩) চলচ্চিত্রে ‘অনঙ্গ বৌ’ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক শিল্পীর মর্যাদা লাভ করেন। ১৯৫৩ সালের ৩০ জুলাই যশোরে ববিতার জন্ম। পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় তার বেড়ে ওঠা। প্রকৃত নাম ফরিদা আক্তার পপি। ববিতার একমাত্র ছেলে অনিক কানাডায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স শেষ করে বর্তমানে সেখানে একটি প্রতিষ্ঠানে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছেন।

সর্বশেষ খবর