রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিষয়ভিত্তিক ছবির সংকট

আলাউদ্দীন মাজিদ

বিষয়ভিত্তিক ছবির সংকট

‘মাস্টারসাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই, কোনোদিন কেউ যেন বলতে না পারে আমার কোনো বিদ্যা নেই... ও মাস্টার সাব...’ গানটি প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমানের ‘অশিক্ষিত’ ছবির। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া সুপারহিট এ ছবিটি ছিল নিরক্ষতা দূরীকরণের স্লোগান নিয়ে নির্মিত বিষয়ভিত্তিক ছবি। ছবিটি কয়েকটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ ও বোদ্ধাশ্রেণীর প্রশংসা কুড়ায়। এ ছবির নির্মাতা আজিজুর রহমান ছাড়াও সাধারণ মানুষেরও ক্ষোভ এ ধরনের জনসচেতনতামূলক ছবি এখন আর নির্মাণ হয় না। খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার মতিন রহমান বলেন, চলচ্চিত্র মানে জীবনের ছায়া। যেখানে মানুষ তার পারিপার্শ্বিকতার চিত্র এবং বিনোদনের সঙ্গে সচেতনতামূলক বাণী পেয়ে চলার পথে সঠিক সন্ধান পাবে। দেশ ও সমাজ উপকৃত হবে। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, মূলত আশির দশকের শেষভাগ থেকে এ ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ আর হয় না। ফলে দেশে অবক্ষয় বেড়েই চলছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বিষয়ভিত্তিক ছবি এখনো প্রচুর নির্মিত হচ্ছে এবং দেশ-বিদেশে পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি ছবির নাম নির্দ্ধিধায় উল্লেখ করা যায়। যেমন অমিতাভ বচ্চন অভিনীত ‘পিংক’, অক্ষয় কুমারের ‘প্যাডম্যান’, ‘টয়লেট এক প্রেম গাঁথা’ রানী মুখার্জির ‘হিছকি’, আমির খানের ‘লাগান’, ‘তারে জামিন পার’, ‘পিকে’, অমিতাভ বচ্চনের ‘ব্ল্যাক’, ‘পিকু’, শ্রীদেবীর ‘ইংলিশ-ভিংলিশ’ ইত্যাদি। নির্মাতা হাসিবুর রেজা কল্লোল বলেন, ‘আমার নির্মিত ‘সত্ত্বা’ ছবিটি ছিল নারী নির্যাতনের প্রতিবাদের গল্প।’ ছবিটি সাধারণ দর্শক থেকে সুধীসমাজ ব্যাপকহারে দেখেছে এবং প্রশংসা কুড়িয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা এখন এ ধরনের জনসচেতনতামূলক ছবি নির্মাণ বাদ দিয়ে বিনোদনের নামে মাসলাদার ছবি বানাচ্ছি যা দেশ ও সমাজের কোনো কল্যাণে আসে না বরং নানা অপরাধ বৃদ্ধি করছে। বাণিজ্যিক ছবির ক্ষেত্রে এটি বেশি হচ্ছে। কিছু অবট্র্যাক মুভি এখনো বাণীসমৃদ্ধ হয়ে নির্মিত হচ্ছে এবং দেশ-বিদেশে পুরস্কৃত ও প্রশংসিত হচ্ছে। এমন কিছু ছবির মধ্যে রয়েছে ‘মৃত্তিকা মায়া’, ‘জালালের গল্প’, ‘গাড়িওয়ালা’, ‘বাপজানের বায়স্কোপ’, ‘মাটির ময়না’, ‘পিতা’, ‘রানওয়ে’ প্রভৃতি। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ বলেন, আশির দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এ দেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা ভাবতেন কী করে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিনোদনের পাশাপাশি সমাজ সচেতনমূলক বাণী দর্শকের কাছে পৌঁছে দিয়ে দেশ ও সমাজের উন্নয়ন করা যায়। এমন ভাবনা এখন আর নেই। কল্যাণকর এসব ছবির মধ্যে কয়েকটির নাম উল্লেখ করতেই হয়। যেমন- তিতাস একটি নদীর নাম, নয়নমনি, গোলাপী এখন ট্রেনে, কসাই, সুন্দরী, অশিক্ষিত, ছুটির ঘণ্টা, দুই পয়সার আলতা, ভাত দে, সারেং বউ,  জীবন থেকে নেয়া, আবার তোরা মানুষ হ, আলোর মিছিল, লাঠিয়াল, সুপ্রভাত, নোলক, পালংক, মেঘের অনেক রং, সীমানা পেরিয়ে, সূর্যকন্যা, ডুমুরের ফুল, ডানপিটে ছেলে, এখনই সময়, দি ফাদার. খোকন সোনা, জন্ম থেকে জ্বলছি, লাল কাজল, বড় ভালো লোক ছিল, পুরস্কার এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। ২০১৬ সালে নির্মিত হয় স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আমি একজন পাগল বলছি’। ছবিটি প্রসঙ্গে সাংবাদিক দেওয়ান পারভেজ ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে বলেন, নগর জীবনে সবাই যখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন একজন বৃদ্ধ মলিন কাপড়ে শহরময় ছুটে চলেছেন। তারপর হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেলেন সড়কের পাশের আইল্যান্ডে, হাতে তুলে ধরলেন একটি প্ল­্যাকার্ড। যাতে লেখা রয়েছে ‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দিবস চাই’। ফরিদ চাচার গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু নির্মাতা রায়হান রাফী সেটাকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। ছবিতে দেখা যায়, শহরময় ঘুরে সবাইকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দিবস পালনের আহ্বান জানাচ্ছেন এক বৃদ্ধ। কিন্তু কেউ তাতে কর্ণপাত করছে না। সবাই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। নাছোড়বান্দা ফরিদ চাচা পুলিশ থেকে নগরপিতা সবার কাছেই ছুটে গিয়েছেন একটি মাত্র আবদার নিয়ে। বিনিময়ে মিলেছে দারোয়ানের গলাধাক্কা আর পাগলের খেতাব। অগত্যা আবারও প্ল­্যাকার্ড হাতে রাস্তায় নামেন ফরিদ চাচা। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্ররা তখন তার সঙ্গে ছবি তুলতে ছুটে আসে, অনেকে আবার তাচ্ছিল্যও করে। কিন্তু অনড় ফরিদ চাচা ঠায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন এক দফা এক দাবি নিয়ে। এ সময় হঠাৎ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন বৃদ্ধ। সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু চুপচাপ দেখছিলেন শামীম। এখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না, ফরিদ চাচাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। তারপরই ঘটল আসল ঘটনা। শামীম ফরিদ চাচার গল্পটা ফেসবুকের মাধ্যেমে ছড়িয়ে দিলেন। ফলাফল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দিবস পালনের জন্য সবাই রাস্তায় নেমে এলেন।  স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আমি একজন পাগল বলছি’ ইউটিউবে প্রকাশের পরপরই ভাইরাল হয়ে যায়। তিন মিনিট কুড়ি সেকেন্ডের ভিডিওটি প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় নব্বই লাখ মানুষ দেখেছে। চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পেছনের গল্প বলতে গিয়ে নির্মাতা রায়হান রাফী বলেন, শুধু দিবস পালনের মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা সম্ভব নয়। তবে এর মাধ্যমে একটি অভ্যাস গড়ে তোলার প্রয়াস থেকেই আমার চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা। দর্শক এমন চলচ্চিত্রই এখন আশা করছে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর