বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

হারিয়ে যাচ্ছে সেই সব চলচ্চিত্র

আলাউদ্দীন মাজিদ

হারিয়ে যাচ্ছে সেই সব চলচ্চিত্র

তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘চাঁপা ডাঙ্গার বউ’ সেলুলয়েডের ফিতায় এনে দর্শকের অশ্রু ঝরিয়েছেন নায়করাজ রাজ্জাক। মানে সাহিত্যনির্ভর ছবিতে মুগ্ধ দর্শক। এই মুগ্ধতা বেশি ছড়িয়েছেন প্রয়াত নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম। ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত প্রচুর সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এ দেশে এবং সবই সফল হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ও ছিল সাহিত্যনির্ভর। চলচ্চিত্রকার আবদুল জব্বার খান নিজের লেখা ‘ডাকাত’ গল্প অবলম্বনে এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। দুঃখের বিষয়, এখন আর সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় না। বোদ্ধাশ্রেণির মতে, দেশীয় চলচ্চিত্রে মন্দাবস্থার অনেক কারণের মধ্যে এটি একটি। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও গবেষক অনুপম হায়াৎ বলেন, ‘এখন তো মোবাইলে ছবি দেখার কালচার চলছে। ছেলে-বুড়ো সবাই নেটে বিদেশি ছবি দেখতে ব্যস্ত। সিনেমা হলে যেতে চায় না। এ কারণে কোনো প্রযোজক সাহস করে সাহিত্যনির্ভর তো দূরে থাক, পারিবারিক গল্পের ছবিও নির্মাণ করতে চান না। কিছু নির্মাতা তামিল, তেলেগু বা বিদেশি ছবি কপি করে শুধুই ব্যবসা করার প্রবৃত্তি দেখিয়ে যাচ্ছেন। চলচ্চিত্র  সবচেয়ে বড় শিল্পমাধ্যম এবং এর মূল উপাদান হলো সাহিত্য- এই ভাবনা এখন আর কারও মধ্যে নেই। অথচ আমাদের দেশে নির্মিত প্রতিটি সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র দর্শক সাদরে গ্রহণ করেছে এবং জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।’

এ দেশে সবচেয়ে বেশি সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন প্রয়াত নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম। তিনি ১০টি সাহিত্যধর্মী ছবি নির্মাণ করে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছেন। তার নির্মিত এসব ছবি হলো- দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা, বেহুলা লক্ষীন্দর, বিরহ ব্যথা, হাঙর নদী গ্রেনেড, হাছন রাজা, মেঘের পরে মেঘ, শাস্তি এবং সুভা। শুভদা ছবিটি ১১টি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। নায়করাজ রাজ্জাক ‘চাঁপা ডাঙ্গার বউ’-এর পর নির্মাণ করেন শরৎচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায়ের কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাস অবলম্বনে ‘সৎ ভাই’ ছবিটি। এটিও দর্শকপ্রশংসা কুড়ায়। অভিনেত্রী সুচন্দা নির্মাণ করেন জহির রায়হানের উপন্যাস অবলম্বনে ‘হাজার বছর ধরে’ ছবিটি। এটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা ছবিসহ একাধিক সম্মাননা লাভ করে। সুচন্দা আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের দেশে স্বনামধন্য লেখকদের প্রচুর কাব্য রয়েছে। অথচ এগুলো নিয়ে ছবি নির্মাণের মানসিকতা কারও নেই। কোনো প্রযোজক অর্থলগ্নিও করতে চান না। সবাই শুধু বাণিজ্যের পেছনে ছুটছেন। শিল্পকে বাদ দেওয়ায় চলচ্চিত্র এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। সরকারি অনুদান যা দেওয়া হয় তা দিয়ে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আমার ইচ্ছা ছিল জহির রায়হানের ‘বরফ গলা নদী’ উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ করার। লগ্নিকারকের অভাবে কাজটি আর হয়ে উঠছে না।’ প্রখ্যাত লেখিকা সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে অভিনেত্রী ববিতা নির্মাণ করেন ‘পোকামাকড়ের ঘর বসতি’ ছবিটি। এটি জাতীয় পুরস্কারে সেরা ছবিসহ একাধিক সম্মান কুড়ায়। ববিতার কথায়- ‘চলচ্চিত্রের সোনালি দিন এখন অতীত। চলচ্চিত্রকে একসঙ্গে  শিল্প ও বাণিজ্যের দৃষ্টিতে দেখে একসময় সাহিত্যনির্ভর ছবি নির্মাণ হতো বলে জহির রায়হান, আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল ইসলাম,  মহিউদ্দীন শাকের, শেখ নেয়ামত আলী, ঋত্বিক কুমার ঘটক প্রমুখ নির্মাতারা তাদের সৃষ্টি নিয়ে আজও কালজয়ী হয়ে আছেন।’ প্রয়াত শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস নিয়ে প্রখ্যাত ও প্রয়াত নির্মাতা আবদুল্লাহ আল মামুন ‘সারেং বউ’ ছবিটি নির্মাণ করে ঢাকাই চলচ্চিত্রে ইতিহাস গড়েছেন। আরেক প্রখ্যাত নির্মাতা কাজী হায়াৎ নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথের অন্যতম সেরা সৃষ্টি ‘কাবুলীওয়ালা’। এটিও প্রশংসা এবং জাতীয় সম্মান অর্জন করে। প্রয়াত লেখক সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘লালসালু’ বড় পর্দায় আনার মতো মুন্সিয়ানা দেখালেন তানভীর মোকাম্মেল। তার কথায়, ‘চলচ্চিত্র এখন আর শিল্পের পর্যায়ে নেই। এটিকে শতভাগ বাণিজ্যিক করে ফেলায় এখন আর প্রকৃত চলচ্চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় না।’ অভিনেতা নির্মাতা তৌকীর আহমেদ প্রয়াত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের রচনা নিয়ে ‘জয়যাত্রা’ ছবিটি নির্মাণ করে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। আমজাদ হোসেন ৭০-এর দশকে তার ‘নিরক্ষর স্বর্গে’ উপন্যাস নিয়ে ‘নয়নমণি’ ছবিটি নির্মাণ করে স্বাধীন দেশে প্রথম হীরকজয়ন্তীর মর্যাদা বয়ে আনেন। প্রয়াত প্রথিতযশা লেখক আবু ইসহাকের উপন্যাস অবলম্বনে শেখ নেয়ামত আলী ও মহিউদ্দীন শাকের নির্মিত ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ জাতীয়ভাবে এখনো ইতিহাস হয়ে আছে। প্রখ্যাত ও প্রয়াত নির্মাতা সুভাষ দত্ত নির্মাণ করলেন বরেণ্য সাহিত্যিক আলাউদ্দীন আল আজাদের ‘তেইশ নাম্বার তৈলচিত্র’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘বসুন্ধরা’ ছবিটি। এটিও জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে। প্রয়াত অভিনেতা বুলবুল আহমেদ নির্মাণ করেছেন শরৎচন্দ্রের ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’। সর্বশেষ ২০১৭ সালে সোহানী হোসেনের ‘মা’ গল্প অবলম্বনে ‘সত্বা’ ছবিটি নির্মাণ করে আবারও এই ধারার ছবির গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিলেন হাসিবুর রেজা কল্লোল। প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা আজিজুর রহমান বলেন, ‘দর্শক গতানুগতিক ধারা  থেকে মুক্তি চায়। ভালো মৌলিক গল্প দেখতে চায়। সাহিত্য ও মৌলিক গল্পের চলচ্চিত্র যাও দু-একটা হচ্ছে তা সুবিধাবাদী সিন্ডিকেটের সঙ্গে পেরে উঠছে না। আর যারা এসব ছবি বানাচ্ছে তারা আর্থিক ক্ষতিকর হওয়ায় আর আসছেন না। অথচ সাহিত্য ও  মৌলিক গল্পের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্র আবার ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ অবলম্বনে গৌতম ঘোষ নির্মাণ করেছেন দুই বাংলার ছবি পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯০), মুহম্মদ জাফর ইকবালের জনপ্রিয় কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে সরকারি অনুদানে মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করেছেন শিশুতোষ চলচ্চিত্র দীপু নাম্বার টু (১৯৯৬), কলমের জাদুকর খ্যাত অমর লেখক হুমায়ূন আহমেদ নিজের রচনা নিয়ে একে একে নির্মাণ করলেন সাহিত্যনির্ভর চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, চন্দ্রকথা, ঘেটুপুত্র কমলা, শ্যামলছায়াসহ বেশ কয়েকটি দর্শকনন্দিত ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি। বাংলাদেশের সাহিত্যনির্ভর ছবিগুলো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও লাভ করে।

সর্বশেষ খবর