শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

চিরদিনের মহানায়ক উত্তম...

চিরদিনের মহানায়ক উত্তম...

তিনি জানতেন, তিনিই উত্তম হবেন। তাই নামটা অরুণ কুমার থেকে নিজেই বদলে উত্তম কুমার রেখেছিলেন। এই মহানায়কের জন্ম ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। আর তার মহাপ্রয়াণ ঘটে ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আজকের এই আয়োজন তৈরি করেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

অভাব অনটনে বেড়ে ওঠা

উত্তম কুমার ১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার ৫১ আজিরিটোলা স্ট্রিটে জন্মগ্রহণ করেন। দাদু আদর করে তাকে ডাকতেন উত্তম। আসল নাম অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়। বাবার নাম সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়। মা চপলা দেবী। অভাব-অনটনের মধ্যে কাটে উত্তমের ছেলেবেলা। সংসারে অভাব থাকায় ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর দিনে পোর্ট কমিশনার্স অফিসের ক্যাশ বিভাগে কেরানির চাকরি নেন। রাতে ভর্তি হন ডালহৌসির গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল কলেজে। ১৯৪৫ সালে বিকম পাস করেন।

 

মুকুট নাটকে অভিনয় শুরু

অভিনয়ে আসার পেছনে পরিবারের প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কৃতিমনা উত্তমের বাবা-কাকারা গড়ে তুলেছিলেন ‘সুহৃদ সমাজ’। বিভিন্ন উৎসবে সুহৃদ সমাজ থেকে যাত্রাপালার আয়োজন হতো। যাত্রাপালায় অভিনয় দেখে উত্তমেরও অভিনয়ের ইচ্ছে জাগে। স্কুলে থাকতেই উত্তম তার মহল্লায় নাট্যসংগঠন লুনার ক্লাবে যুক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মুকুট’ নাটকে অভিনয় দিয়ে শুরু হয় অভিনয় জীবন।

 

কেরানি থেকে নায়ক

নাটকের পর পোর্ট কমিশনারের কেরানি উত্তমের মাথায় চেপে বসল সিনেমার ভূত। ওই সময় অভিনয়ের সঙ্গে গান জানা অপরিহার্য ছিল। উত্তম তাই গান শিখতে সংগীতশিক্ষক নিদান ব্যানার্জির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। একদিন গেলেন ভারত লক্ষ্মী স্টুডিওতে। সেখানে ভোলানাথ আর্য ‘মায়াডোর’ নামে একটি হিন্দি ছবি প্রযোজনা করেন। দারোয়ান ঢুকতে না দিলে পূর্ব পরিচিত নাট্যজন গণেশ বাবুর পরিচয় দিয়ে প্রযোজকের সামনে

হাজির হলেন। প্রযোজক অনেক দেখেশুনে তাকে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দিলেন। নতুন বরের মার খাওয়ার দৃশ্যে উত্তমের অভিনয় ছিল খুবই সাবলীল। এভাবে সহশিল্পী হিসেবে উত্তম কুমার চলচ্চিত্রে পা রাখেন।

 

সম্মানী এক টাকা চার আনা

পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি দৈনিক এক টাকা চার আনা সম্মানী পান। ১৯৪৮ সালে মাত্র ২৭ টাকা পারিশ্রমিকে নীতিন বসুর ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে উত্তম কুমার নায়কের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেন। এটিই তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি।

 

উত্তমকে নিয়ে উপহাস

‘ওরে যাত্রী’ সিনেমার শুটিং চলছে। অভিনয়ে ব্যস্ত উত্তম কুমার। হঠাৎই ফ্লোর থেকে ভেসে এলো টিটকারি। চেহারা তো বটেই, অভিনয় নিয়েও কমপ্লি­মেন্টের বাহারে টেকা দায়। কেউ বলেন নেক্সট দুর্গাদাস, কেউ আবার ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে তুলনা টানেন। একের পর এক ফ্লপ সিনেমার হিরোর তখন অবস্থা নাকাল।

 

উত্তম যুগের সূচনা

১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত একের পর এক সিনেমা করেছেন। সবই ফ্লপ। ১৯৫৩ সালে এলো ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। ছবিটি সুপার হিট। শুরু হলো উত্তমযুগ। তাকে বলা হয় ‘বাংলার রবার্ট ব্রুরস’।

 

হিন্দি ছবিতে উত্তম

উত্তম কুমার ১৫টি হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। হিন্দি চলচ্চিত্রের মধ্যে ছোটিসি মুলাকাত, অমানুষ এবং আনন্দ আশ্রম অন্যতম।

 

চলচ্চিত্রকার উত্তম

প্রযোজক ও পরিচালক হিসেবেও সফলতা পান উত্তম কুমার। পরিচালনা করেন ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (১৯৮১), বন পলাশীর পদাবলী (১৯৭৩) ও শুধু একটি বছর (১৯৬৬)।

 

অর্জনের ঝুলি

১৯৬৭ সালে ‘এন্টনি ফিরিঙ্গি’ ও ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পান। ১৯৫৭ সালে ‘হারানো সুর’ ছবিতে অভিনয় করে পেয়েছিল রাষ্ট্রপতি সার্টিফিকেট অব মেরিট। ছবিটির প্রযোজক ছিলেন তিনি নিজেই।

 

আজও সেরা উত্তম-সুচিত্রা

সুচিত্রা-উত্তম জুটির বিশেষত্ব হলো তাদের

কথোপকথনের ধারা। একে বলা যায় ‘রোমান্স অন এ টি-পট’। সুচিত্রা সেনই উত্তমকে ম্যাটিনি আইডল করে তুলেছিলেন। আজও সেরা এই জুটি। উত্তম-সুচিত্রার রসায়ন শুধু সেলুলয়েডে সীমিত ছিল না। বাস্তব জীবনেও তাদের প্রেমের খুনসুটি আমজনতা জেনে গিয়েছিলেন। তাদের মিলন না হওয়ায় আফসোস করে বলেছেন, ‘আহা তারা কেন একসঙ্গে ঘর বাঁধতে পারলেন না।’ আজও তারা তরুণ-তরুণীর হৃদয়ে প্রেমের উপমা আর উৎসাহের প্রতীক হয়ে আছেন।

 

গৌরী দেবীকে বিয়ে

১৯৪৮ সালে ২৪ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন বান্ধবী গৌরী দেবীকে। তিনি তখন আলিপুর ডকে চাকরি করতেন। গৌরীর সঙ্গে বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা। অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে ঝোঁকের মাথায় হুট করেই পালিয়ে বিয়ে করেন তাকে। ১৯৫০ সালে তাদের একমাত্র সন্তান গৌতমের জন্ম হয়। গৌরী চাইতেন না উত্তম অভিনয় করুক। এ কারণেই তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়।

 

উত্তম-সুপ্রিয়া অধ্যায়

ভালোবাসার মানুষকে আপন করে নেওয়ার পথে সমাজ, সংসারের কোনো বাধাই মানেননি মহানায়ক। লোকনিন্দা, অপবাদ সবকিছু মাথা পেতে নিয়েও জীবনের ১৭টি বছর একসঙ্গেই বসবাস করে গেছেন উত্তম কুমার ও সুপ্রিয়া দেবী। আইনত বিয়ে করতে পারেননি। বিবাহিত দম্পতির মতোই পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন তারা। ১৯৬৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর উত্তম কুমার চলে আসেন সুপ্রিয়া দেবীর ময়রা রোডের ফ্ল্যাটে। জীবনের বাকি ১৭টি বছর তিনি সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গেই কাটান।

 

উত্তম কুমার মেট্রো স্টেশন

মহানায়ক উত্তমকুমার মেট্রো স্টেশন হলো কলকাতা মেট্রোর একটি স্টেশন। স্টেশনটির আগেকার নাম টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশন। পরে স্টেশনটি উত্তম কুমারের নামে নামাঙ্কিত হয়।

 

সংগীতশিল্পী উত্তম

রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার হরিণ চাই’, ‘অনেক কথা বলেছিলেম’, ‘তুমি ধন্য ধন্য হে’ এবং ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’ গানগুলো উত্তম কুমার রেকর্ড করেছিলেন। নিদানবন্ধু বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বেশ কয়েকজন সংগীতগুরুর কাছে গানের তালিম নিয়েছিলেন। দেবীকুমার বসুর ‘নবজন্ম’ ছবিতে নচিকেতা ঘোষের সুরে ছয়টি গান গেয়েছেন। সে সব পরে অ্যালবাম আকারে প্রকাশও হয়েছিল। গান গাওয়ার পাশাপাশি তিনি নিজে সংগীত পরিচালনা করেছেন ‘কাল তুমি আলেয়া’ ছবিতে। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে মেগাফোন থেকে প্রকাশিত রবিন্দ্রসংগীতের চার সিডির অ্যালবাম ‘আমাদের যাত্রা হলো শুরু’র শেষ দুটি গানের শিল্পী স্বয়ং উত্তম কুমার। প্রযোজনা সংস্থাটির ‘অপ্রকাশিত রেকর্ডিং’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে উত্তম কুমারের কণ্ঠে ‘আমার সোনার হরিণ চাই’ ও ‘অনেক কথা বলেছিলেম’ গান দুটি। অন্যদিকে ‘পেরিনিয়াল রেকর্ডস’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে উত্তম কুমারের গাওয়া আরও দুটি রবীন্দ্রসংগীত ‘তুমি ধন্য ধন্য হে’ এবং ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’। সংগীতপ্রেমী উত্তম কাল তুমি আলেয়া ছবির সব গানের সুরারোপ করেন। 

 

ব্যক্তি জীবন

মা-বাবার তিন সন্তানের মধ্যে উত্তম কুমার ছিলেন সবার বড়। ছোট ভাই তরুণ কুমার একজন শক্তিশালী অভিনেতা ছিলেন। তারা একসঙ্গে বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। উত্তম কুমার ১৯৪৮ সালে গৌরী দেবীকে বিয়ে করেন। তাদের একমাত্র সন্তান গৌতম চট্টোপাধ্যায় মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ক্যান্সারে মারা যান। গৌরব চট্টোপাধ্যায় উত্তম কুমারের একমাত্র নাতি। বর্তমানে টালিগঞ্জের অভিনেতা।

 

যেভাবে না ফেরার দেশে

১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই মাত্র ৫৩ বছর বয়সে

মৃত্যুবরণ করেন বাংলার এ মহানায়ক। ছবিতে অভিনয় করতে করতেই চলে গেলেন তিনি। টালিগঞ্জের স্টুডিওতে রাত ১০টা পর্যন্ত ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র শুটিং করলেন। বাসায় ফিরে টের পেলেন বুকের বাম পাশটায় একটা ব্যথা লতিয়ে উঠছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। ক্ষণজন্মা কিংবদন্তি অভিনেতা উত্তম কুমার চলচ্চিত্রশিল্পকে দিয়েছেন ব্যস্ততম ৩২টি বছর। বড় অসময়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেও তার কীর্তি তাকে আজীবন অমর করে রাখবে এই ভুবনে। বারে বারে গেয়ে উঠবেন তিনি ‘এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলতো..’।

 

উল্লেখযোগ্য ছবি

সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩), ওরা থাকে ওধারে (১৯৫৪), মরণের পারে (১৯৫৪), চাঁপাডাঙার বউ (১৯৫৪), অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪), শাপমোচন (১৯৫৫), সবার উপরে (১৯৫৫), শিল্পী (১৯৫৬), সাগরিকা (১৯৫৬), পথে হলো দেরি (১৯৫৭), হারানো সুর (১৯৫৭), চন্দ্রনাথ (১৯৫৭), 

রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন (১৯৬০), সপ্তপদী (১৯৬১), নায়ক (১৯৬৬), কাল তুমি আলেয়া (১৯৬৬),

চিড়িয়াখানা (১৯৬৭), অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি (১৯৬৭), গৃহদাহ (১৯৬৭), ছদ্মবেশী (১৯৭১), আলো আমার আলো (১৯৭১), বন পলাশীর পদাবলী (১৯৭৩), অমানুষ (১৯৭৫), বহ্নিশিখা (১৯৭৬), রাজবংশ (১৯৭৭), সব্যসাচী (১৯৭৭), আনন্দ আশ্রম (১৯৭৭), কিতাব (১৯৭৭), ধনরাজ তামাং (১৯৭৮), নিশান (১৯৭৮), বন্দী (১৯৭৮), দুই পুরুষ (১৯৭৮), নব দিগন্ত (১৯৭৯), সুনয়নী (১৯৭৯), ব্রজবুলি (১৯৭৯), সমাধান (১৯৭৯), শ্রীকান্তের উইল (১৯৭৯), দুরিয়াঁ (১৯৭৯), দেবদাস (১৯৭৯), প্রতিশোধ (১৯৮০), খনা বরাহ (১৯৮০), আরো একজন (১৯৮০),

দর্পচূর্ণ (১৯৮০), পক্ষীরাজ (১৯৮০),

রাজা সাহেব (১৯৮০), দুই পৃথিবী (১৯৮০), সূর্যসাক্ষী (১৯৮১),  ইমন কল্যাণ (১৯৮১),

ওগো বধূ সুন্দরী (১৯৮১), কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (১৯৮১), প্লট নাম্বার ৫ (১৯৮১); উত্তম কুমার অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্র ছোটিসি মুলাকাৎ (১৯৬৭),  দেশপ্রেমী (১৯৮২), মেরা করম মেরা ধরম (১৯৮৭)।

উত্তম কুমার পরিচালিত চলচ্চিত্র কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী (১৯৮১), বন পলাশীর পদাবলী (১৯৭৩), শুধু একটি বছর (১৯৬৬)। প্রযোজিত চলচ্চিত্র গৃহদাহ (১৯৬৭), ছোটিসি মুলাকাত (১৯৬৭), হারানো সুর (১৯৫৭)।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর