মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

এখনো সেই অমিতাভ বচ্চন

আলাউদ্দীন মাজিদ

এখনো সেই অমিতাভ বচ্চন

ফের একবার তিনি প্রমাণ করলেন তিনিই শ্রেষ্ঠ। বয়স তার কাছে সংখ্যা মাত্র। তিনি বলিউডের শাহেনশাহ, অমিতাভ বচ্চন। চলতি বছরের ৮ মার্চ মুক্তি পায় ‘বদলা’ ছবিটি। যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন অমিতাভ বচ্চন। মুক্তির ২৪ ঘণ্টা পেরোতে না পেরোতেই নজরকাড়া সাফল্য পেল ‘বদলা’। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় বক্স অফিসে ‘বদলা’র আয়ের পরিমাণ ৫ কোটি ৯৪ লাখ। স্প্যানিশ ছবি দ্য ইনভিজিবেল গেস্টের হিন্দি রিমেক সুজয় ঘোষের ‘বদলা’। এটি অপরাধ ও প্রতিশোধের গল্প। ছবির শুরুতেই বিগ-বির কণ্ঠস্বর দর্শকদের এক পলকের জন্য কাঁপিয়ে দেয়।

তিনি বলছেন, ‘বদলা নেওয়া সব সময় ঠিক হয় না, তবে প্রতিবার মাফ করে দেওয়াটাও ঠিক হয় না’। এই ছবিতে অমিতাভ বচ্চন একজন অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবী, যিনি কোনো মামলায় হারেননি ৪০ বছর ধরে। খুনে অভিযুক্ত তপসীর জামিনের বিষয়টি তার হাতে আসে। অমিতাভ বিশ্বাস করেন খুনটি তপসী করেননি। এর আগে একই নির্মাতার ‘পিঙ্ক’ ছবিতেও আইনজীবীর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন অমিতাভ বচ্চন। একটি অভিজাত হোটেলের বন্ধ ঘরে ঘুম ভাঙে এক তরুণ নারী উদ্যোক্তার। পাশেই পড়ে ছিল তার প্রেমিকের লাশ। আইনের কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে একজন বুড়ো আইনজীবীকে ভাড়া করেন সেই নারী। এক সন্ধ্যায় তাকে খুলে বলেন সব ঘটনা। এরপর দুজনে মিলে খুঁজতে শুরু করেন রহস্যময় এই ঘটনার  পেছনের ঘটনা। শাহরুখ খানের  রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্ট প্রযোজিত ‘বদলা’ ছবির গল্প এভাবেই এগিয়েছে। স্প্যানিশ গল্পকার অরিওল পাওলোর  লেখা ‘কনত্রাতিয়েম্পো’ সিনেমার হিন্দি সংস্করণই ‘বদলা’। এই ছবিতে অদৃশ্য সেই খুনির চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাহরুখ। ছবির নির্মাতা সুজয় ঘোষ ছবিটির সফলতার জন্য অমিতাভ বচ্চনের অসাধারণ অভিনয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সিনেমাজুড়ে সত্যানুসন্ধানের যাত্রায় যেন ইঁদুর-বিড়ালের  খেলা চলে। সত্যি আর বাস্তবের মধ্যে অনেক অর্ধসত্য রয়েছে। আর সেই আমেজটাই গোটা সিনেমায় ধরে রেখেছে ‘বদলা’। দুই ঘণ্টার সিনেমার শেষের দিকে এসে প্রতি মুহূর্তেই দ্বন্দ্ব  তৈরি হয়, আর সেটি হলো  কোনটা তাহলে সত্যি? প্রতি মুহূর্তে সত্যির পাশা উল্টে যায়। নিজের চরিত্রে অমিতাভ বচ্চন অত্যন্ত সংযমী এবং ব্যক্তিত্বপূর্ণ।

বদলা ছবিটির বাজেট ছিল ১০ কোটি টাকা। আর ঘরে তুলেছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এই বিপুল সাফল্যে  উচ্ছ্বসিত প্রযোজক শাহরুখ খান টুইট করেছিলেন। শাহরুখ তার টুইটার হ্যান্ডলে লিখেছিলেন ‘অমিতাভ বচ্চনের স্টারডমই বদলার সাফল্যের মূল কারণ। এই টুইটটি চোখে পড়তেই অমিতাভ বেশ বড়সড় একটি উত্তর দেন তার টুইটার হ্যান্ডেল থেকে। আর সেই টুইটের উত্তরেই শাহরুখের কাছ থেকে বোনাসের টাকা দাবি করে বসলেন অমিতাভ বচ্চন। হিন্দিতে লেখা  সেই টুইটে শাহরুখকে উদ্দেশ করে অমিতাভ লিখেন, ‘মান্যবর, রাজাধিরাজ (কিং খান) শুনলাম যে, বদলা নাকি আপনার ফিল্মি ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় হিট ছবি। তাহলে ভাই সাহেব, কোনো কোম্পানিতে কেউ যখন কাজ করে সাফল্য পায় বা ভালো কাজ করে, তখন তাকে উপহার হিসেবে কিছু ইনাম দেওয়া হয়। তাহলে এবার আমাকে আমার বোনাসটা দিয়ে দাও।’ এমন মজার টুইটের পর শাহরুখ খান মোটেই চুপচাপ বসে থাকার পাত্র নন। কারণ অমিতাভ বচ্চনের মতোই শাহরুখের সেন্স অব হিউমারের বিষয়টিও বেশ ভালোই চর্চিত বলিউডে। তাছাড়া উত্তর তো তাকে দিতেই হতো। কারণ স্বয়ং বলিউডের শাহেনশাহ, বলিউডের বাদশার কাছে একটি দাবি জানিয়েছেন। তাই শাহরুখও দিয়েছেন বেশ জবরদস্ত একটি উত্তর। ওই টুইটের উত্তরে শাহরুখ যা লিখলেন তার মানেটা দাঁড়ায় এই, ‘স্যার ছবিটা আপনার, অভিনয়ও আপনার, ছবিটা হিট হয়েছে আপনার জন্য। আপনি না থাকলে ছবিটাই হতো না। তাহলে পার্টিটা তো???। এরপর শাহরুখ বেশ কয়েকটি প্রশ্নচিহ্ন রেখেছেন। অর্থাৎ দক্ষ খেলোয়াড়ের মতোই বলটি  ঠেলে দিয়েছেন বিপক্ষের কোর্টে।

এ তো গেল বদলা ছবিকে ঘিরে দক্ষ ও চির তরুণ অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের কথা। তার জীবনকাহিনি কিছুটা হলেও এবার বলতে হয়। তিনি হলেন একজন জনপ্রিয় ভারতীয় চলচ্চিত্র অভিনেতা, প্রযোজক,  টেলিভিশন উপস্থাপক ও সাবেক রাজনীতিবিদ। ১৯৭০-এর প্রথম দিকে তিনি বলিউড চলচ্চিত্র জগতে ‘রাগী যুবক’ হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। অমিতাভ ‘বিগ-বি’ বা বড় বচ্চন নামেও পরিচিত। বলিউডের শাহেনশাহ ও সহস্রাব্দের  সেরা তারকা হিসেবে পরিচিত বচ্চন তার পাঁচ দশকের অধিক সময়ের কর্মজীবনে ১৯০টির অধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। বচ্চনকে ভারতীয় চলচ্চিত্র তথা বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা ও প্রভাবশালী অভিনেতা হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে তার একচ্ছত্র আধিপত্যের জন্য ফরাসি চলচ্চিত্র সমালোচক ও পরিচালক ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো তাকে ‘একক-ব্যক্তি চলচ্চিত্র শিল্প’ বলে অভিহিত করেন। অমিতাভ বচ্চন কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন; এর মধ্যে  রয়েছে পাঁচটি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ১৬টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার। ফিল্মফেয়ারে অভিনয়ের জন্য প্রদত্ত পুরস্কারের বিভাগে তিনি সর্বাধিক মনোনয়ন পাওয়ার রেকর্ড গড়েছেন। অভিনয় ছাড়াও তাকে নেপথ্য গায়ক, চলচ্চিত্র প্রযোজক, টেলিভিশন সঞ্চালক হিসেবেও দেখা গেছে। তিনি  গেম শো ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ অনুষ্ঠানের ১৬ মৌসুমের সঞ্চালনা করেন। ১৯৮০-এর দশকে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ পর্যন্ত ভারতীয় সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন। শিল্পকলায় তার অবদানের জন্য ১৯৮৪ সালে ভারত সরকার তাকে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রী, ২০০১ সালে তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণ এবং ২০১৫ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণে ভূষিত করে। বিশ্ব চলচ্চিত্রে তার অনন্য কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা লেজিওঁ দনরের নাইট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৬৯ সালে অমিতাভ বচ্চন ছবির জগতে আত্মপ্রকাশ করেন ‘সাত হিন্দুস্তানি’ নামক একটি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৭৩-এ বচ্চনের চলচ্চিত্র জীবনে একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে, যখন পরিচালক প্রকাশ মেহেরা তার ‘জঞ্জির’ ছবির মুখ্য ভূমিকা, ইন্সপেক্টর বিজয় খান্নার চরিত্রে তাকে নির্বাচিত করেন। এই ছবিটি আগের সব রোমান্টিক ছবির থেকে পুরোপুরি অন্য ঘরানার হওয়ায় অমিতাভ ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’ মানে ‘রাগী যুবক’ হিসেবে এক নতুন রূপে নিজেকে বলিউডে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এর পরের ছবিগুলোতে তার অভিনীত চরিত্রের আঙ্গিক আর দক্ষ অভিনয় তার এই নতুন পরিচিতিকে আরও দৃঢ় করেছিল। ১৯৪২ সালের ১১ অক্টোবর এলাহাবাদে জন্ম নেওয়া ৭৭ বছর বয়সী অমিতাভ বচ্চন এখনো পর্দায় তার তারুণ্যকে এক রত্তিও হারতে দেননি। বরং চোখ ধাঁধানো উপস্থিতি, ছন্দময় নাচ আর বলিষ্ঠ অভিনয়ের কাছে হার মেনেছে অমিতাভ বচ্চনের বয়সের অঙ্কটা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর