শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

নাচে নেই কোনো বৈচিত্র্য...

নাচে নেই কোনো বৈচিত্র্য...

ছন্দের ছোঁয়ায় শব্দ যেমন হয়ে ওঠে কবিতা ঠিক তেমনি মুদ্রার ছোঁয়ায় নৃত্য হয়ে ওঠে দৃশ্যকাব্য। বিদ্যুৎ চমকের মতো নৃত্যশিল্পীদের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া নূপুরের ছন্দে ছন্দে মঞ্চ হয়ে ওঠে কাব্যময়। নাচ এমনই শিল্প যার জন্য কোনো ভাষার প্রয়োজন হয় না। সময়ের ক্রমবিবর্তনে পৃথিবীর নানা দেশে আধুনিক ও সমকালীন নাচের চর্চা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে প্রদর্শিত নাচে নেই তেমন বৈচিত্র্য। বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফারের সঙ্গে কথা বলেছেন- পান্থ আফজাল

 

লায়লা হাসান

যে নৃত্যই করি, তার ব্যাকরণ মেনে করতে হবে। ব্যাকরণ ভাঙা যাবে না। শুদ্ধতা বজায় রাখতে হবে। তাহলেই বৈচিত্র্য আসবে। আজকাল অনেকেই দুই- চারটি নাচ আয়ত্তে এনে গুরু হয়ে যাচ্ছেন। দেখতে হবে মানসম্পন্ন কতটা হয়েছে। আর আমাদের দেশে ‘নাচ শেখার আগে মঞ্চে ওঠা’র প্রবণতা রয়েছে। তারা নাচকে ধারণ করতে পারেন না।

 

মুনমুন আহমেদ

একসময় লোকজনের একমাত্র বিনোদন ব্যবস্থা ছিল বিটিভি, যার মাধ্যমে উল্লি­খিত নৃত্যশিল্পীদের দর্শকরা চিনেছেন-জেনেছেন। এখনকার দিনেও অনেক নৃত্যশিল্পী বিভিন্ন চ্যানেলে অনুষ্ঠান করেন। তবে সেটা দায়সারাগোছের। যোগ্যরা সুযোগ পান না। মানসম্পন্ন নৃত্যানুষ্ঠান হয় না বললেই চলে। নাচে নেই কোনো বৈচিত্র্য। তাই এ নিয়ে আগ্রহী দর্শক অনেক কম। আমরা যখন প্রথমদিকে নাচ শিখেছি তখন এর পেছনে সময় ও শ্রম দিয়েছি। এখনকার সময় শিক্ষার্থীরা ততটা সময় ও শ্রম দেয় না।

 

শামীম আরা নীপা

নাচে এখন পেশাদারিত্বের জায়গা তৈরি হয়েছে।  তবে আক্ষেপ রয়েছে, অনেক ভালো শিল্পী তৈরি হলেও টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নন-ড্যান্সারদের পারফর্ম করতে দেখা যায়। নেই কোনো বৈচিত্র্য। নাচ আসলে শরীরের ভাষা দিয়ে প্রকাশ করতে হয়। আমার কাছে বরাবরই নাচের ফিউশন বিষয়টা রীতিমতো দৃষ্টিকটু। দেখে দেখে তো সব হয় না, বুঝে-শুনে তারপর করতে হয়। কিন্তু ফিউশন নাচে তা মানা হয় না। নাচের কিন্তু নির্দিষ্ট পোশাক-সাজ রয়েছে। এগুলো কি যথাযথভাবে মানা হয়? এটা শুদ্ধ নাচের পরিপন্থী।

 

শিবলী মোহাম্মদ

এখন ফিউশনধর্মী নাচ হচ্ছে প্রচুর। সেই শাস্ত্রীয় নৃত্য, ভরতনাট্যম, মনিপুরী কিংবা কথক নৃত্যকে একত্রিত করে বিভিন্ন ইভেন্ট, টিভি অনুষ্ঠানে অনেক তারকাকেই পারফর্ম করতে দেখা যায়। যা অনেকটাই বাণিজ্যিক। ভালো নৃত্যশিল্পী কেন তৈরি হচ্ছে না? কেন নাচে তেমন বৈচিত্র্য নেই? এর অন্যতম কারণ এখন মিডিয়া চায় চেনা মুখ। নাচের সঠিক তালিম নেওয়া ছাড়াই তারা অনুষ্ঠান করে। এ দেশে নৃত্যশিল্পীর সংখ্যা কিন্তু কম নয়।

 

ওয়ার্দা রিহাব

আমি যতগুলো ক্লাসিক্যাল ড্যান্স ফর্ম  মনিপুরী নৃত্য নিয়ে কাজ করছি তার সবই কৃষ্ণ ও রাধা নির্ভর; এর থেকে বের হওয়ার অন্য কোনো সুযোগ নেই। নাচে বৈচিত্র্য আনতে নতুন নতুন নৃত্য ভাবনা প্রয়োজন। তবে, নতুনদের মধ্যে যারা ভালোভাবে শিখে আসছে তারা অনেক ভালো করছে। তবে আমি বলছি না সবাই; ১০ জনের মধ্যে অন্তত ২ জন তো উজ্জ্বলভাবে বেরিয়ে আসছে। তবে, যারা মনিপুরী নৃত্য নিয়ে কাজ করে তাদের সদিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি জেলায় সরকারিভাবে এই শিল্প বিকাশে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

 

পূজা সেনগুপ্ত

একটা সময় নাচকেই পেশা হিসেবে নিই। প্রথমদিকে শখের বশে কাজ করলেও একটা সময় ভালোবাসার জিনিসটি যেন হারিয়ে না যায় তাই নাচটাকে আমি পেশা হিসেবে নিয়েছি। পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশে ধামাইলসহ দেশীয় ও সৃজনশীল নাচের কর্মশালা করিয়েছি। নাচে বৈচিত্র্য আনতে আমার দল তুরঙ্গমী থিম বেইজড কাজ করে। প্রত্যেকটি সেশনে একটি করে গল্প তৈরি করি। টিম ওয়ার্কের মধ্য দিয়ে বেশ ভালো সময় পার করছে তুরঙ্গমী। তবে, দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের নিজস্ব নৃত্য আঙ্গিক অনেকটাই হারিয়ে গেছে।

 

তানজিল আলম

একসময় পশ্চিমা বা বিদেশি ধাঁচের নাচ আমাদের এখানে খুব একটা দেখা যেত না। তাই অনেকেই আমাকে বলেছেন এসব বিদেশি নাচ দিয়ে কিচ্ছু হবে না। কিন্তু আমি মনে করি, জগতের সব নাচই শিল্প, যদি তা শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করা যায়। নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করতে পারলে এ দেশেও পশ্চিমা বা ধ্রুপদী নাচের বাইরের নাচ জনপ্রিয়তা পাবে। আসলে শিল্পের মানচিত্র অনেক বড়। এখানে সব প্রয়োজন পড়ে। কেবল ক্ল্যাসিক দিয়ে নৃত্যশিল্পের পূর্ণতা আসবে না। বিশ্বের নানা অঞ্চলে নানারকম অধিবাসীর বৈচিত্র্যময় সব নাচ আছে। সে সবের সমন্বয়ে যিনি যত বেশি সমৃদ্ধ হবেন তিনি তত বড় নৃত্যশিল্পী। তবে এটা ঠিক, আজকালকার শিল্পচর্চায় কাজের বৈচিত্র্যতা কম।

সর্বশেষ খবর