মঙ্গলবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা
সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য

ইংরেজি নামে বাংলা ছবি নির্মাণ চলছেই

আলাউদ্দীন মাজিদ

ইংরেজি নামে বাংলা ছবি নির্মাণ চলছেই

পৃথিবীতে ভাষার জন্য অকাতরে জীবন দেওয়ার দৃষ্টান্ত একমাত্র বাঙালি জাতিরই রয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অঙ্গনে সরব হয়েছে। তারপরেও ভিনদেশি ভাষা শুধু নয়, সংস্কৃতিও অবাধে আমরা অনুকরণ আর অনুসরণ করে যাচ্ছি। এর অর্থ হলো ভাষার জন্য জীবন দানকে আমরা ভুলে যাচ্ছি আর অর্থহীন করে তুলছি। চলচ্চিত্র হচ্ছে একটি দেশের প্রধান গণমাধ্যম। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেশের মানুষ নিজ দেশ, ভাষা, জীবন আর কৃষ্টি কালচারের সন্ধান পায়। এই চলচ্চিত্রের কাঁধেও চেপেছে ভিন দেশি ভাষার ভূত। মূলত আশির দশক থেকেই অহেতুক বাংলা ছবির নাম ইংরেজিতে রাখার প্রবণতা শুরু হয়েছে। যা একটি জাতির স্বাতন্ত্র্যবোধ রক্ষার ক্ষেত্রে সত্যিই অন্তরায় এবং দুঃখ জনক। এই অনিয়ম রোধের জন্য সর্বপ্রথম বাংলাদেশ প্রতিদিন ‘শোবিজ বিভাগ’ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। ২০১৪ সালের ৭ মার্চ বিষয়টি নিয়ে শোবিজ বিভাগে ‘ইংরেজি নামে অবাধে ছবি নির্মাণ’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর আগস্ট মাসেই সরকার বাংলা ছবির ইংরেজি নাম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. রবিউল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, ‘সাম্প্রতিককালে অনাবশ্যকভাবে বাংলা সিনেমার নাম ইংরেজিকরণের প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ঢালাওভাবে বাংলা চলচ্চিত্রের ইংরেজি নামকরণ বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এসব বিষয় বিবেচনা করে চলচ্চিত্রের নামের ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অনুসরণ নিশ্চিতকল্পে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’ তথ্য মন্ত্রণালয়ের এই প্রজ্ঞাপনটি চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক সমিতি ও সেন্সর বোর্ডের কাছে প্রেরণ করা হয়। এ নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ২০১৪ সালের আগস্টের পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত ইংরেজি নামে বাংলা ছবি নির্মাণ ও মুক্তি অব্যাহত রয়েছে। মানে সরকারি আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে এক শ্রেণির নির্মাতা ভিনদেশ প্রীতি দেখিয়ে চলেছে। ২০১৪ সালে আইন জারির পর থেকে এখন পর্যন্ত যেসব ছবি ইংরেজি নামকরণে নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- গেইম রিটার্নস, বিগ ব্রাদার, অ্যাকশন জেসমিন, ইউটার্ন, ব্লাকমানি, লাভম্যারেজ, লাভার নম্বর ওয়ান, দ্য  স্টোরি অব সামারা, গ্যাংস্টার রিটার্ন, হেড মাস্টার, লাভ স্টেশন, সুইটহার্ট, মিসড কল, ব্লাকমেইল, ওয়ার্নিং, রানআউট, আন্ডার কনস্ট্রাকশন, হিটম্যান, মাই নেম ইজ সিমি, ঢাকা অ্যাটাক, মিশন এক্সট্রিম, সুপার হিরো, মেড ইন বাংলাদেশ, বিট কয়েন স্কিম, জ্যাম, পাসওয়ার্ড, ক্যাপ্টেন খান, ফিফটি ফিফটি লাভ, মিস্টার বাংলাদেশ, লিডার, আই অ্যাম রাজ, বয়ফ্রেন্ড, লাইভ ফ্রম ঢাকা, দ্য ডিরেক্টর প্রভৃতি।

দুঃখের বিষয় হলো চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড এসব ছবিকে অবলীলায় ছাড়পত্রও দিচ্ছে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও গবেষক অনুপম হায়াৎ বলেন, এটি জাতি হিসেবে আমাদের দৈন্যতা ও চরম ব্যর্থতা। সেন্সর নীতিমালায় এ বিষয়ে কঠোর আইন থাকা উচিত ছিল। ২০১৪ সালে সরকারি এক প্রজ্ঞাপনে বাংলা ছবির ইংরেজি নামকরণ নিষিদ্ধ করা হয়। এ নিষেধাজ্ঞা নির্মাতা বা সেন্সর বোর্ড মানছে না। এটি দুঃখজনক।

চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি প্রজ্ঞাপনে ইংরেজি নামকরণকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তারপরেও  অনাবশ্যকভাবে ইংরেজি নামকরণ সমর্থনযোগ্য নয়। এ প্রবণতা যদি বেড়ে যায় তাহলে সেন্সর বোর্ডের ১৫ সদস্যের যে কমিটি আছে তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পারে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায় প্রজ্ঞাপনটিতে এমন কোনো ক্লজ রয়েছে যার ফাঁক-ফোকরে ইংরেজি নামকরণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ও সেন্সর বোর্ডের সাবেক সদস্য ইফতেখার নওশাদ বলেন, ছবির গল্পের সঙ্গে না গেলে অহেতুক ইংরেজি নামকরণ সমর্থন করি না। কিছু ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়। এ বিষয়ে এফডিসির ভূমিকা প্রধান। তারা অহেতুক ইংরেজি নামে ছবি অ্যান্ট্রি না করলেই হয়। খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা আজিজুর রহমান বলেন, সেন্সর বোর্ড নীতিমালার এস আরও ১৯৮৫-এর ধারা ১ এর উপধারা ‘এ’ তে বর্ণিত আছে- ‘বাংলাদেশ বা এর জনগণের সমসাময়িক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রথা ও পোশাকের পরিপন্থী কোনো বিষয় চলচ্চিত্রে থাকতে পারবে না।’ এ নির্মাতার প্রশ্ন-ভাষাগতভাবে ছবির নামের দিকটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর বাধ্যবাধকতার বিষয়টি সেন্সর বোর্ডের আইনে কেন উল্লেখ নেই?’ এ নীতিমালার দুর্বলতার সুযোগে অসাধু নির্মাতারা বাংলাদেশি ছবির নাম ইংরেজিতে রাখার দুঃসাহস দেখিয়ে যাচ্ছে। এটি প্রতিরোধ করা জরুরি। সেন্সর বোর্ড এ বিষয়ে কঠোর হবে বলে আশা করছি।

সর্বশেষ খবর