সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

কেমন হওয়া উচিত সংবাদ পাঠের ধরন

কেমন হওয়া উচিত সংবাদ পাঠের ধরন

বিবিসি, সিএনএন ও অন্য টেলিভিশনগুলোর সংবাদ উপস্থাপনের নিজস্ব নীতি ও স্টাইল আছে। আমাদের দেশে নিউজ প্রেজেন্টেশন কীভাবে আরও অর্থবহ করা যায়, উপস্থাপকের ড্রেসকোড, উচ্চারণ ও ভাষাশৈলী কতটা গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে সংবাদ উপস্থাপকের সঙ্গে কথা বলেছেন- পান্থ আফজাল

 

খায়রুল বাশার [চ্যানেল আই]

আমাদের এখানে প্রধান সমস্যা হলো কোনো ইনস্টিটিউট নেই, যেটি সঠিকভাবে একজন দক্ষ সংবাদ পাঠক তৈরি করতে পারে। স্কুলিং যদি ঠিক না থাকে তবে কীভাবে দক্ষ নিউজ প্রেজেন্টার তৈরি হবে? আর এখন তো না শিখেই অনেকে প্রেজেন্টার হিসেবে এই মাধ্যমে আসছেন। কিছু নামমাত্র টিভি চ্যানেলে দক্ষ সংবাদ পাঠক আছেন। কেউ যদি এই পেশাকে ধারণ না করেন, বসবাস না করেন, তবে কীভাবে এই সেক্টরকে এগিয়ে নেওয়া যাবে বা অর্থবহ করা যাবে? আপনি দেখেন, বাইরের দেশের প্রত্যেকটি চ্যানেল নির্দিষ্ট টপিক নিয়ে অ্যানালাইসিস করে। প্রত্যেকটি বিষয় আলাদা করে গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। যিনি যে বিষয়ে পারদর্শী তিনি সে বিষয় নিয়ে সংবাদ পড়েন। এদেশে এই পেশাকে ফেন্সি জব হিসেবে সবাই দেখেন। নিজেদের চেহারা দেখানোর জন্য তারা নিউজ পড়তে টিভি সেটের সামনে আসেন। এরা কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে যেতে পারেন না। নিউজের মেরিট না জেনে নিউজ পড়েন। আমরা আসলে নিউজের নিজস্বতা, স্বকীয়তা বা বৈচিত্র্যতার জায়গায় কম্প্রোমাইজ করে ফেলছি। তাই মনে করি, স্কুলিং বড় একটা ফ্যাক্টর। এই মাধ্যমে কোনো স্পেশালাইজেশন নেই। আর উচ্চারণ ও ভাষাশৈলী তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে অনেকেই ফলো করেন। তিনি যদি উচ্চারণে ভুল করেন, তবে তার ফলোয়াররা তো ভুলই শিখবে। বিভ্রান্ত হবেন। এই মাধ্যমে শিখে যাওয়া উচিত, থেকে শেখা উচিত নয়। আর ড্রেসকোড হবে যার যার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই। নির্দিষ্ট করা উচিত নয়। এক্ষেত্রে স্বাধীনতা থাকা উচিত। যা পরে নিজের কাছে কমফোর্টেবল অনুভব হয়, তাই পরা উচিত। আপনি দেখবেন, নাইজেরিয়ান বা ব্রিটিশরা তাদের দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ড্রেস পরে সংবাদ পড়ছেন। তারা কিন্তু গেøাবাল হয়ে উঠার জায়গাটা কম্প্রোমাইজ করেন না। তাহলে আমাদের কেন টাই-স্যুট পরে সংবাদ পড়তে হবে? যা আরামদায়ক তাই পরা উচিত।

 

ঈশিকা আজিজ [বাংলাভিশন]

এখন তো আমরা অনেকটাই এগিয়ে গেছি। আধুনিক হয়েছি, প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে। দেশীয় আবহে সংবাদ পাঠ হচ্ছে। সংবাদ পাঠের ক্ষেত্রে দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধারণ, উচ্চারণের স্বতঃস্ফ‚র্ততা ও অভিব্যক্তি থাকা খুবই জরুরি। নিউজের সময় অবশ্যই হাসি বা কান্নার অভিব্যক্তি এক হবে না! আর ড্রেসকোড অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। বাঙালি সংস্কৃতি মেনে শালীন ও পরিশীলিত পোশাক পরিধান করা উচিত। যে পোশাকই পরি না কেন কারও কাছে যেন তা দৃষ্টিকটু না মনে হয়। উচ্চারণ শুদ্ধ ও প্রমিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

 

ফারজানা করিম [একাত্তর টিভি]

আমাদের এখানে কোনোদিনই নিউজকে অর্থবহ করা যাবে না, এগিয়ে নেওয়া যাবে না। বসদের মানসিকতা পরিবর্তন করা যাবে না। যদিও সবারই নিজস্ব একটা ভঙ্গি আছে। বসদের মতে, সবাই একইভাবে নিউজ পড়বে। ফলে নিউজ প্রেজেন্টেশনের ক্ষেত্রে কেউ নিজস্ব স্টাইল গড়ে তুলতে পারছেন না; নিজস্ব বৈচিত্র্যতা তৈরি করতে পারছেন না। সবাই যেন রোবোটিক। সবকিছু সাজানো থাকতে হবে। এ জন্য এদেশে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বিবিসি, সিএনএনের মতো কিছুই হবে না। ফ্রিডম দিতে হবে। আর সংবাদ পাঠের ক্ষেত্রে ড্রেসকোড মেনে চলা খুবই জরুরি। অন্য কোনো বিষয় ৩০ মিনিট বা ১ ঘণ্টা একটানা কেউ দেখে না; কিন্তু নিউজ পাঠের ক্ষেত্রে দেখে। এ জন্য ড্রেসকোড বিষয়ে রুচিশীল হতে হবে। লম্বা হাতাওয়ালা বা ¯িøভলেস ড্রেস নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু এটা তো ড্রেসকোড হতে পারে না। সংবাদ পাঠের ক্ষেত্রে পোশাকের বিষয়টা মেনে চলা জরুরি। পৃথিবীর সব স্থানে মেনে চলে। যা পরিধান করলে সুন্দর ও মানানসই হয়, চোখের আরাম লাগে তাই পরা উচিত। তা শাড়ি কিংবা যে কোনো পোশাকই হোক না কেন। শোক আর উৎসবের পোশাক গুলিয়ে ফেলা যাবে না। বাংলাদেশে আসলে প্রোপার ড্রেসআপে কেউই নিউজ পড়ে না। দেশীয় কালচার মেনটেইন করে পোশাক পরাটা জরুরি। আর উচ্চারণ বা ভাষাশৈলী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রুতিকটু যেন না হয়। তবে প্রথমে লুক, এরপর উচ্চারণ ও ভাষাশৈলী।

 

শামস উজ জোহা [যমুনা টেলিভিশন]

আমাদের এখানে প্রেজেন্টেশনের পলিসি বলতে গেলে অলিখিত। যার যেভাবে খুশি সেভাবেই চলছেন। একটা স্টাইল সাবমিশন হতে কিন্তু সময় লাগে। প্রথমদিকে যে কেউ এসেই জয়েন করতে পেরেছেন। পরে অবশ্য জানা ছেলে-মেয়েরা এসেছেন। আর একদিনে তো স্টাইল ঠিক হবে না; সময় লাগবে। তবে একটা বিষয় খুবই অ্যালার্মিং যে, এদেশের চ্যানেলগুলোর সিনিয়র নিউজ প্রেজেন্টার নাই হয়ে যাচ্ছেন। সে জায়গায় নতুনরা এসে জায়গা করে নিচ্ছেন। ১৫ বছর আগের যারা ছিলেন, তারা থাকলে হয়তো আজ বিবিসি, সিএনএনের মতো নিজস্ব স্টাইল প্রতিষ্ঠিত করে সাহস দেখাতে পারতেন। এখন তো অনেক কিছুই হাউসের সঙ্গে সমন্বয় হচ্ছে না। তবে প্রেজেন্টেশনের ক্ষেত্রে ফ্রিডম থাকাটা জরুরি। আর ড্রেসকোড খুবই ইমপোর্টেন্ট। কারণ আমরা বাসায় বা অন্য কোনো প্রোগ্রামে যেমন ড্রেসকোড ফলো করব, নিউজ পড়ার ক্ষেত্রে কিন্তু তা পারব না। প্রত্যেকটি চ্যানেল নিজস্ব পোশাক ভাবতেই পারে। তবে নিউজ একটা ফর্মাল বিষয়, ইনফর্মাল নয়। তা ভাবা দরকার। এ জায়গায় ছাড় দিলে ডিজেস্টার হবে। মিনিমাম ভাষাশৈলী আর উচ্চারণ বিষয়ে জ্ঞান থাকাটা জরুরি। চর্চা দরকার। আমাদের তো উচ্চারণ গাইড লাইন আছে। তা দেখে নেওয়া আবশ্যক। স্টাইল দেখে নেওয়া যায়, নিলে হয়। প্রেজেন্টেশন স্টাইলে যে যতটা ভালো সে ততটা গ্রহণযোগ্য।

 

সানজানা ইসলাম পদ্ম [নিউজ টোয়েন্টিফোর]

বিবিসি, সিএনএন দেখেই আমাদের এখানে মূল ফরমেট দাঁড়িয়েছে। যদিও এখানে টেকনোলজিক্যাল সমস্যা আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ম্যানুয়ালি কন্ট্রোল হয়। এটা সত্যি যে, কমতি রয়েছে। ওদের মতো পুরোপুরি করতে পারা সম্ভব নয়। দর্শক আসলে কি চাচ্ছে সে অনুযায়ী আমরা করতে পারছি না। দর্শকের কথা মাথায় রেখে, অফিস পলিসি মেনে নিউজ পড়তে হয়। যিনি যেভাবেই ফলো করুক না কেন, অফিস পলিসি মাথায় রেখে যেন দৃষ্টিকটু না হয় সেভাবে করতে হয়। নিউজ পড়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই নিজস্ব স্টাইল ফলো করা উচিত।

দর্শকের বিষয়ও ভাবা উচিত। আর উচ্চারণ, ড্রেসকোড মেনে চলাটা দরকার। দর্শক যা একসেপ্ট করবে না তা অবশ্যই বর্জনীয়। পড়ার ধরনটা নিজের মতো হওয়াই উচিত। উচ্চারণ বিষয়ে দরকার পড়লে বাংলা একাডেমি ফলো করা যায়। অনেক ক্ষেত্রেই ড্রেসকোড অফিস থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া থাকে।

 

সফিক মোহাম্মদ [সময় টেলিভিশন]

আজ থেকে ২০ বছর আগে দেশীয় টেলিভিশনে সংবাদ পাঠ শুরু হয়। সে সময় যারা শিখিয়েছিলেন, তারা এখন বিভিন্ন চ্যানেলের হর্তাকর্তা। তাদের শেখানোটাই মূলত আমরা শিখেছি ও শিখছি। অনেক পরিমার্জিত হয়েছে।

তবে এখনো মনে করি, আমরা সংবাদ পাঠের ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে। বাইরের সবাই অনেক ন্যাচারাল, প্রাণবন্ত। যে কোনো ট্রপিকে মিশে যায়। প্রেজেন্টেশন স্টাইল অন্যরকম। সেখানে আমরা হয়ে গেছি রোবোটিক। সংবাদ পাঠের ক্ষেত্রে আমরা রিলাক্স নই। এক্ষেত্রে চ্যানেলের নীতি-নির্ধারকরা কিন্তু অনেক কিছুই পরিমার্জন করতে পারেন। আর পরিমার্জিত পোশাক ও শুদ্ধ উচ্চারণ খুবই জরুরি। কারণ রুট লেভেল থেকে উচ্চ পর্যায়ের মানুষ সংবাদ পড়া দেখেন।

সংবাদ পাঠ তাই সাবলীল হতে হবে। শব্দের বিচ্যুতি হলে ভুল মেসেজ সবার জন্যই ক্ষতিকারক।

 

ফাহমিদা শম্পা [ডিবিসি]

আমাদের দেশে সংবাদ অর্থবহ করাটা ডিফিকাল্ট। এত কম সময়ে তা করা সম্ভব নয়। বাইরের দেশের চ্যানেলগুলোর মতো এদেশেও নিউজ পড়ার স্টাইল নির্দিষ্ট হতে সময় লাগবে। আমরা সংবাদ পাঠের ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে আছি। সংবাদ পাঠের ক্ষেত্রে স্বাধীন প্রেজেন্টেশন স্টাইল থাকাটা প্রয়োজন। আমরা এক্ষেত্রে সবাই যেন রোবোটিক। সবকিছু যেন তৈরি থাকতে হবে। আমরা কিন্তু পারি নিউজ প্রেজেন্টেশনের ক্ষেত্রে একটা নিজস্ব স্টাইল গড়ে তুলতে। ড্রেসকোড মেনে চলা জরুরি। তা হতে হবে রুচিশীল ও পরিশীলিত। বিদেশে ড্রেসকোড মেনে চলে। দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি মেনে পোশাক পরা উচিত। আর উচ্চারণ শুদ্ধ ও সাবলীল হতে হবে।

 

শাওন দত্ত [যমুনা টেলিভিশন]

প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব সংস্কৃতি, ঐতিহ্য থাকে। তা মেনে নিউজ প্রেজেন্টেশন হওয়া জরুরি। হয়তো সবকিছু বিবিসি, সিএনএনের মতো হবে না; তবে নিজস্ব স্বকীয়তা ও বৈচিত্র্যতা মনে রেখে সংবাদ পাঠকে আরও বেশি অর্থবহ করা যায়। তবে যা কিছুই করি না কেন, আমাদের অডিয়েন্সকে মাথায় রেখে করা উচিত। বাইরের দেশের চ্যানেলগুলোও তাদের অডিয়েন্সকে মাথায় রেখে সংবাদ পাঠের ধরন নির্ধারণ করে। আর ড্রেসকোড অবশ্যই নির্বাচন করা দরকার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে মাথায় রেখে। হতে হবে কমফোর্টেবল। যা সবার কাছে শালীন ও পরিশুদ্ধ তাই পরিধান করা উচিত। উচ্চারণ ও ভাষাশৈলীও হতে হবে শুদ্ধ, পরিমিত ও ব্যাকরণ বিধিসম্মত।

 

তাহিয়া রুবাইয়াত অপলা [সময় টেলিভিশন]

উপস্থাপনায় অবশ্যই নিজস্ব স্টাইল জরুরি। শুধু দেখতে সুন্দর হলেই হবে না, তাকে সংবাদ সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। পরিপূর্ণ সাংবাদিকতা ও নিউজ বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে।

তবেই নিউজ প্রেজেন্টেশনটা অর্থবহ হবে। আর উচ্চারণ, ভাষাশৈলী ও ড্রেসকোড শতভাগ ঠিক থাকাটা জরুরি। একজন নিউজ প্রেজেন্টার কিন্তু সবার কাছে আইকন।

মেজরিটি মানুষের কাছে যে ড্রেসটি গ্রহণযোগ্য হয় তাই পরা উচিত। উচ্চারণ আর ভাষাশৈলী যেন শ্রুতিমধুর হয়, দৃষ্টিকটু যেন না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকা অবশ্যই দরকার। কারণ সবাই নিউজ পড়ার সময় আপনাকে দেখছে।

সর্বশেষ খবর