বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

অনুদানের ছবি নিয়ে ধূম্রজাল

অনুদানের ছবি নিয়ে ধূম্রজাল
চলচ্চিত্রশিল্পে মেধা ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহ দিতে ১৯৭৬ সালে চালু হয় সরকারি অনুদান প্রথা। সরকারি অনুদানের ছবির বেশির ভাগেরই কাজ শুরু হয় কিন্তু  শেষ হয় না। এ ক্ষেত্রে সরকারি কোনো কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থাও নেই। অনুদানের ছবির আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

যত অভিযোগ

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা মতিন রহমান বলেন, চলচ্চিত্রে সরকারি অনুদান মানে অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। অনুদান পাওয়ার পর অনেক নির্মাতা ‘একটি ছবি নির্মাণে এই অর্থ যথেষ্ট নয়’ এই অজুহাত দেখান। অথচ তারা অনুদানের অর্থের পরিমাণ  জেনেই আবেদন করেন। তাহলে অর্থ পাওয়ার পর কেন ছবি নির্মাণে  খোঁড়া অজুহাত প্রদর্শন ও অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা? আরেকটি অভিযোগ হলো চিত্রনাট্যের সঙ্গে জমা দেওয়া শিল্পীর তালিকায় খ্যাতনামা শিল্পীদের নাম জমা দিয়ে অনুদান আদায়ের পর উল্লিখিত শিল্পীদের না নিয়ে ছোটখাটো শিল্পীকে নামমাত্র অর্থ বা বিনা অর্থে কাজ করিয়ে  নেওয়া হয়। আবার শিল্পী না নিয়ে নির্মাতা নিজের আত্মীয়স্বজন দিয়ে অভিনয় করান। এরপরও কারচুপি আছে। আর তা হলো স্পন্সর বা একজন প্রযোজককে প্রলুব্ধ করে তার কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে  কোনোভাবে ছবির কাজ শেষ করে তা টিভি চ্যানেলের কাছে বিক্রি করে দিয়ে সেই নির্মাতা অসাধু পথে লাভবান হন।

তথ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৯ বছরে মোট ৪১টি চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মুক্তি  পেয়েছে মাত্র ১৫টি ছবি। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, অনুদানের প্রথম  চেক প্রাপ্তির ৯ মাসের মধ্যে অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের নির্মাণ কাজ শেষ করতে হবে। তবে বিশেষ অবস্থায় অনুরোধ সাপেক্ষে পরিচালক ওই সময় বৃদ্ধি করতে পারেন। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অনেক নির্মাতা ছবি নির্মাণে বছরের পর বছর পার করছেন। মন্ত্রণালয়ের একশ্রেণির কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে তারা এ ধরনের কাজ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যার কারণে নির্মাতাদের  কোনো ধরনের জবাবদিহি করতে হয় না। তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র শাখার কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সাল  থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এক দশকে অনুদানপ্রাপ্ত ২২ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুক্তি পায়নি। অন্যদিকে অনুদান পেয়ে মুক্তি না পাওয়া স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১৮। সময়মতো ছবির নির্মাণ শেষ না করায় এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে তিন নির্মাতার বিরুদ্ধে। তাতেও কোনো লাভ হয়নি।

 

যেসব ছবি মুক্তি পেয়েছে এবং পায়নি

মসিহ্উদ্দিন শাকের-শেখ নিয়ামত আলীর ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ মুক্তি পায় ১৯৭৯ সালে, বাদল রহমানের শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ মুক্তি পায় ১৯৮০ সালে। কবির আনোয়ারের ‘তোলপাড়’ মুক্তি পায় অনুদান পাওয়ার এক দশক পর, ১৯৮৮ সালে। বেবী ইসলামের ‘মেহেরজান’ আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৭৭-১৯৮১ অনুদান দেওয়া হয়নি। ১৯৮১-৮২তে চারটি ছবি যথাসময়ে মুক্তি পায়। ছবিগুলো হলো- ‘কলমিলতা’, ‘মোহনা’, ‘বাঁধনহারা’ ও ‘সোয়ামী’। ১৯৮২-৮৩ অনুদান পায় পাঁচটি ছবি। ‘দহন’, ‘ডাক দিয়ে যাই’, ‘ফুলমতি’, ‘পেনশন’ ও ‘উদয় তারা’র মধ্যে তিনটিই আলোর মুখ  দেখেনি। পরিচালক ইসমাইল মোহাম্মদের মৃত্যুর পর ‘ডাক দিয়ে যাই’ ও মাসুদ করিমের মৃত্যুর পর ‘ফুলমতি’ বন্ধ হয়ে যায়। নায়ক আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জল ‘উদয় তারা’র জন্য এক লাখ টাকা অনুদান  পেলেও ছবি জমা দেননি, টাকাও ফেরত দেননি। রফিকুল বারী চৌধুরীর ‘পেনশন’ মুক্তির পর ১৯৮৪ সালে ছবিটিকে নিষিদ্ধ করে সরকার। শেখ নিয়ামত আলীর ‘দহন’ মুক্তি পায় ১৯৮৫ সালে। ১৯৮৩-৮৪ অনুদান  দেওয়া হয়নি। ১৯৮৪-৮৫ অনুদানের টাকা ফেরত দিয়েছেন নির্মাতা শমশের আহমেদ। কারণ ‘অচেনা বন্দর’ নামের চলচ্চিত্রটির জন্য এক লাখ টাকা অনুদান পান তিনি। এই টাকায় ছবি নির্মাণ সম্ভব নয়, তাই অনুদান ফেরত দেন। ১৯৮৫-৮৬ থেকে ৯২-৯৩ টানা সাত বছর অনুদান প্রদান বন্ধ ছিল। ১৯৯৩-৯৪ এ তিনটি ছবিকে অনুদান দেওয়া হয়- হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’, শেখ নিয়ামত আলীর ‘অন্য জীবন’ ও ববিতার ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’। যথাক্রমে ১৯৯৪, ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে ছবিগুলো মুক্তি পায়।

১৯৯৪-৯৫ এ চারটি ছবিকে অনুদান দেওয়া হয়। মোরশেদুল ইসলামের ‘দীপু নাম্বার টু’ মুক্তি পায় ১৯৯৬ সালে, চাষী নজরুল ইসলামের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ মুক্তি পায় ১৯৯৭ সালে। মোস্তাফিজুর রহমান ‘পথ বেঁধে দিল’র জন্য পাওয়া টাকা ফেরত দেন। ইসমাইল হোসেন ‘চোখের মণি’ নির্মাণ করেননি, টাকাও গ্রহণ করেননি। ১৯৯৫-৯৬ এ খান আতার ‘এখনো অনেক রাত’ নির্দিষ্ট সময়ে মুক্তি দিলেও মনিরুজ্জামান মনিরের ‘পদ্মা আমার জীবন’ মুক্তি পায় ১৩ বছর পর, ২০০৮ সালে। শাহজাহান চৌধুরীর ‘উত্তরের খেপ’ মুক্তি পায় পাঁচ বছর পর, ২০০০ সালে। ১৯৯৬-৯৭ ‘জননী’, ‘সনাতন গল্প’ ও ‘নিষিদ্ধ লোবান’ এই তিনটি ছবি অনুদান পায়। এর মধ্যে ‘জননী’র জন্য জাঁ নেসার ওসমান অর্থ গ্রহণ করেননি। ‘নিষিদ্ধ লোবান’-এর জন্য অর্থ গ্রহণ করেননি নাসির উদ্দীন ইউসুফ। ‘সনাতন গল্প’র নির্মাতা মাসুম আজিজ ছবিটি মুক্তি দেন ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর। ১৯৯৭-৯৮ থেকে ১৯৯৯-২০০০ তিন বছর অনুদান বন্ধ থাকে। ২০০০-০১ সাইদুল আনাম টুটুলের ‘আধিয়ার’ ও রেজানুর রহমানের ‘তাহাদের কথা’ অনুদান পায়। ২০০৩ সালে মুক্তি পায় ‘আধিয়ার’। ‘তাহাদের কথা’র জন্য প্রথম কিস্তি বাবদ তিন লাখ ৪০ হাজার টাকা পান রেজানুর রহমান। ছবি নির্মাণ না করায় ১৪ বছর পর ২০১৫ সালের নভেম্বরে চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে টাকা ফেরত দেন। ২০০১-০২ অনুদান প্রদান করা হয়নি। ২০০২-০৩ অনুদান পাওয়া কোহিনূর আখতার সুচন্দার ‘হাজার বছর ধরে’ মুক্তি পায় ২০০৫ সালে, শিবলী সাদিকের ‘বিদেশিনী’ মুক্তি পায় ২০০৬ সালে। ২০০৩-০৪ এ অনুদান পাওয়া গাজী জাহাঙ্গীরের ‘জীবন সীমান্তে’ ও নূর-উল-আলমের ‘পরম প্রিয়’ যথাক্রমে ২০০৫ ও ২০০৬ সালে মুক্তি পায়। ২০০৪-০৫ কাজী মোরশেদের ‘ঘানি’ ও হাফিজ উদ্দিনের ‘হাজী শরীয়তউল্লাহ’ ২০০৬ সালেই মুক্তি পায়। ২০০৫-০৬, ২০০৬-০৭ অনুদান প্রদান করা হয়নি। ২০০৭-০৮ তানভীর  মোকাম্মেলের ‘রাবেয়া’ ও আবু সাইয়ীদের ‘রূপান্তর’ নির্দিষ্ট সময় মুক্তি পায়। এনামুল করিম নির্ঝরের ‘নমুনা’ আটকে দেয় সেন্সর বোর্ড। ২০০৮-০৯ এ  অনুদান পাওয়া ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ও ‘আত্মদান’ মুক্তি পেয়েছে। ‘স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের কাল’ ছবির কাজ শেষ করতে পারেননি পরিচালক জুনায়েদ হালিম। ২০০৯-১০ এ ‘গেরিলা’, ‘অনিশ্চিত যাত্রা’, ‘একই বৃত্তে’, ‘ছেলেটি’ (আকাশ কতদূরে) ও ‘কাজলের দিনরাত্রি’ মুক্তি  পেয়েছে। ‘সূচনারেখার দিকে’ ছবির পরিচালক আখতারুজ্জামান মারা  গেছেন ২০১১ সালের আগস্টে। ২০১০-১১ অনুদানপ্রাপ্ত পাঁচটি ছবি মুক্তি পেয়েছে ‘শোভনের স্বাধীনতা’, ‘বৃহন্নলা’, ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’, ‘মুক্তি ও ধোঁকা’ (হরিজন)। ফারুক হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ ছবির কাজ  শেষ।। ২০১১-১২ এ ‘জীবনঢুলি’, ‘মৃত্তিকা মায়া’ ও ‘হেডমাস্টার’ মুক্তি পায়। সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকীর ‘একা একা’, মারুফ হাসানের ‘নেকড়ে অরণ্যে’, প্রশান্ত অধিকারীর ‘হাডসনের বন্দুক’ মুক্তি পায়নি। ২০১২-১৩ ‘একাত্তরের মা জননী’, ‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’, ‘মেঘমল্লার’ ও ‘খাঁচা’ মুক্তি  পেয়েছে। নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর ‘কাগজের ফুল’ ছবির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে গেছে। ‘কাঁটা’র পরিচালক টোকন ঠাকুরকে  বেশ কিছুদিন অর্থায়নের জন্য সহপ্রযোজক খুঁজতে দেখা গেছে। ‘যৈবতী কন্যার মন’-এর পরিচালক নারগিস আক্তার বলেছেন, তার ছবির কাজ শেষ। ২০১৩-১৪ মুক্তি পেয়েছে ‘সুতপার ঠিকানা’, ‘লাল চর’, ‘মহুয়া সুন্দরী’, ‘লাল সবুজের সুর’, ‘ছিটকিনি’। জাঁ নেসার ওসমানের ‘পঞ্চসঙ্গী’র কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ‘কাঁসার থালায় রুপালি চাঁদ’ ছবির কাজ শেষ বলেছেন পরিচালক ড্যানি সিডাক। ২০১৪-১৫ ‘ভুবন মাঝি’ ও ‘রীনা ব্রাউন’ মুক্তি পেয়েছে। ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’র শুটিংয়ের কাজ শেষ বলেছেন পরিচালক নূরুল আলম আতিক। ‘চন্দ্রাবতী কথা’র পরিচালক এন রাশেদ চৌধুরী জানান, ছবির কাজ শেষ। ‘বিউটি সার্কাস’-এর পরিচালক মাহমুদ দিদারও বলেন, ছবির কাজ শেষ। ‘মায়া : দ্য লস্ট মাদার’-এর পরিচালক মাসুদ পথিকও দাবি করেন, কাজ শেষ। ২০১৫-১৬ ‘আঁখি ও তার বন্ধুরা’, ‘গহিন বালুচর’ ও ‘দেবী’ মুক্তি পেয়েছে। ‘সাবিত্রী’র শুটিং এখনো শুরু হয়নি। কামাল আহমাদ সাইমনের ‘শঙ্খধ্বনি’র (শিকলবাহা) কাজ চলছে। ‘বৃদ্ধাশ্রম’ ছবির ছবির কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান নির্মাতা এস ডি রুবেল। ২০১৬-১৭ ‘নোনাজলের কাব্য’, ‘রূপসা নদীর বাঁকে’র শুটিং চলছে। ‘আজব সুন্দর’-এর কাজ শেষ হয়নি। ‘প্রিয় জন্মভূমি’র কাজ থেমে আছে। ‘দায়মুক্তি’র খবর নেই। ২০১৭-১৮ ‘গোর’, ‘কালবেলা’, ‘অলাতচক্র’, ‘আজব ছেলে’ ও ‘অবলম্বন’। কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ গত এপ্রিলে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে কবরীর ‘এই তুমি সেই তুমি’, মীর সাব্বিরের ‘রাতজাগা ফুল’, হোসেন  মোবারক রুমীর ‘অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’, হৃদি হকের ‘১৯৭১ সেই সব দিন’, শমী কায়সারের ‘স্বপ্ন মৃত্যু ভালোবাসা’ ও আকরাম খানের ‘নকশি কাঁথার জমিন’।

 

তথ্যমন্ত্রীর আশ্বাস

সম্প্রতি ফিল্ম আর্কাইভ মিলনায়তনে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ ইনস্টিটিউটের এক অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানান, সরকারি অনুদানে নির্মিত সিনেমাগুলো যাতে সব প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হতে পারে,  সে ব্যাপারেও কঠোর বিধি-বিধান আরোপের চিন্তা করছেন তিনি।

সর্বশেষ খবর