শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নাট্য প্রদর্শনীতে যত সংকট

নাট্য প্রদর্শনীতে যত সংকট

বর্তমানে রাজধানীতে মঞ্চনাটক প্রদর্শনী নিয়ে নানা সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। নাটক প্রদর্শনীর পেছনে বিভিন্ন দলকে অনেক জটিলতা ও সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। এসব সংকট ও জটিলতা হিসেবে কিছু বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঢাকার মঞ্চনাট্যাঙ্গনের বিভিন্ন সংকট ও তার থেকে উত্তরণের পথ নিয়ে লিখেছেন-পান্থ আফজাল

 

মৌলিক পাণ্ডুলিপি সংকট

পান্ডুলিপি নাট্যচর্চার জন্য অন্যতম প্রধান একটি উপাদান। এ ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকেই আমাদের মঞ্চে বিদেশি নাট্যকারের নাটক অনুবাদ বা রূপান্তর করে পান্ডুলিপি করার একটা ধারা চলে এসেছে। এ ক্ষেত্রে কোনো বিদেশি নাটক দেশজ আদলে নিয়ে এলে সেখানে নিজস্ব সংস্কৃতিকে কতটা প্রাধান্য দেওয়া হয় তা ভাববার বিষয়। সম্প্রতি সে জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে মৌলিক ও বিষয়বৈচিত্র্যের কিছু পান্ডুলিপি আমাদের মঞ্চাঙ্গনকে উৎসাহিত করলেও এখনো দেশীয় মৌলিক পান্ডুলিপি সংকট রয়েই গেছে।

 

মহড়াকক্ষ সংকট

মঞ্চনাটকে মহড়াকক্ষের সংকট বহু পুরনো। এ সংকট যেন কাটছেই না। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় নাট্যশালায় রয়েছে মাত্র চারটি মহড়াকক্ষ। রাজধানীতে এত এত দলের জন্য এত কম সংখ্যক মহড়াকক্ষ প্রধান সমস্যার মধ্যে একটি। এ কারণে কোনো দলই নিয়মিত নাট্যচর্চা করতে পারছে না। অপেক্ষা করতে হয় মহড়াকক্ষ বরাদ্দ পাওয়ার জন্য। এই বরাদ্দ বেশির ভাগ সময়ই পায় বড় নাট্যদলগুলো। তাই অবহেলার শিকার হচ্ছে উঠতি নাট্যদলগুলো।

 

মিলনায়তন সংকট, ভাড়া বেশি

মঞ্চনাটক প্রদর্শনীর জন্য যেমন ভালো পান্ডুলিপি, নাট্যকার, নির্দেশক বা মহড়াকক্ষ জরুরি; তারও আগে প্রয়োজন মিলনায়তন। ইদানীং মঞ্চনাটক প্রদর্শনীর জন্য মিলনায়তন সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। জাতীয় নাট্যশালা নাট্যকর্মীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল। এ মঞ্চে নাটক ছাড়া অন্য কোনো অনুষ্ঠান করতে দেওয়ার সরকারি নীতিমালা অনেক দলের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। পাবলিক লাইব্রেরি ও জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে নাটক করা সম্ভব হলেও দ্বিগুণ ভাড়া নেওয়া হয় বিধায় নাট্যদলগুলো নাটক মঞ্চায়নে আগ্রহী হয় না। এসব মিলনায়তনের ভাড়া কমানো জরুরি বলে অনেকে মনে করেন।

 

হল বরাদ্দ নিয়ে জটিলতা

প্রতিটি দল মঞ্চনাটক নিয়মিত মঞ্চস্থ করতে চায়। সেক্ষেত্রে হল বরাদ্দ নিয়ে রীতিমতো চলে কাড়াকাড়ি। এটা রীতিমতো নিয়মিত সমস্যায় পরিণত হয়েছে। হল বরাদ্দ কমিটি এটি নিয়ে উদাসীন বলা চলে। অন্যদিকে প্রশাসনও তেমন করে উদ্যোগী হচ্ছে না। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো দলকে হল বরাদ্দের জন্য আগের মাসের ৭ তারিখের মধ্যে আবেদন করতে হয়। ১৫ তারিখের মধ্যে হল বরাদ্দ কমিটি মিটিং করে ফেলে। ২০ তারিখে বরাদ্দ তালিকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়। নাট্যদলগুলোকে তালিকা দেখে ৩০ তারিখের মধ্যে টাকা পরিশোধ করতে হয়। এসব বিষয় বেশির ভাগ দল মেইনটেইন করলেও সময়মতো হল বরাদ্দ পাচ্ছে না। অন্যদিকে শিল্পকলার নিজস্ব কিছু অনুষ্ঠান থাকে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই কয়েক মাস তো কোনো দলই হল বরাদ্দ পায় না। ফলে নাটক মঞ্চায়ন করা সম্ভব হয় না।

 

মঞ্চে বড় দলের প্রভাব

ছোট দলগুলোকে নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ করতে হলে যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হয় বার বার। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সদস্যভুক্ত নাট্যদলগুলোর মধ্যে থিয়েটার মঞ্চে বড় কয়েকটি দলেরই প্রভাব বেশি দেখা যায়। ছোট দলগুলোর প্রতিভা ও সাংগঠনিক সবলতা থাকা সত্ত্বেও তেমন করে পাচ্ছে না মঞ্চ আর মহড়াকক্ষ। মঞ্চস্থ না করতে পারার কারণে নাট্যকর্মীরা হতাশ হয়ে থিয়েটারে নিয়মিত চর্চায় আসতে আগ্রহী হচ্ছেন না।

 

নিরুৎসাহিত তরুণ নির্দেশক, নেই থিয়েটারকর্মী ভাতা

স্বাধীনতার পর কিছু বিচক্ষণ নির্দেশক ও নাট্যকারের মসৃণ পথ ধরে আমরা পেয়েছি এ প্রজম্মের তারুণ্যদীপ্ত দুরন্ত কতক নাট্যনির্মাতা-নাট্যকারদের। আমাদের অভিনয়ে, নির্মাণে, নেপথ্যে অর্থাৎ কলা-কৌশলীর জায়গাতেও আধুনিকায়নের স্পর্শে পরিবর্তন এসেছে। তবে তরুণ নাট্যকার ও নির্মাতারা তাদের কাজ অনুযায়ী মূল্যায়িত হচ্ছেন না। নেই নাট্যকর্মীদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতার ব্যবস্থা। এটা নাট্যকর্মীদের থিয়েটার চর্চায় নিরুৎসায়িত করছে। নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা আজাদ আবুল কালাম বলেন, ‘এ সময়ে তরুণ নির্দেশকরা সবাই অনেক ভালো করছেন। তাদের কাজ এখন বিশ্বমানের বলা চলে। আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে, তারা যে ভালো ভালো কাজ করছে তার জন্য উৎসাহ দেওয়ার কেউ নেই। তাদের অনুপ্রেরণা আমরা দিতে চাই না। সেজন্য তারা নিজেদের ঠিকমতো মেলে ধরতে পারছে না।’

 

রাজধানীতে নেই এলাকা ভিত্তিক মঞ্চ

আধুনিকায়নের এই সময়ে এসেও রাজধানীতে নেই জোনভিত্তিক মঞ্চ। নাটক হয়ে গেছে শিল্পকলা কেন্দ্রিক। ইদানীং বেইলি রোডের মহিলা সমিতিতে কিছু মঞ্চনাটক প্রদর্শনী হলেও সেটা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বিশিষ্ট  নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন, ‘নতুন নতুন মঞ্চনাটক চাই; তার চেয়ে বেশি চাই মঞ্চ। আমাদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ আছে, যেটি আবার ঢাকা শহরের একটি জায়গায় সীমাবদ্ধ।

অন্যদিকে উত্তরায় কোনো মঞ্চ নেই। মিরপুর, ধানমন্ডি, বনানী গুলশান কিংবা নারায়ণগঞ্জে তেমন মঞ্চ নেই যেখানে কোনো দল নাটকের শো করতে পারে। মাঝে মাঝে ঢাকার রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টার জ্যামে নাট্যপ্রেমীরা আটকে থাকেন। মঞ্চনাটকের দর্শক এ অবস্থায় মঞ্চনাটক দেখতে কিভাবে এতদূরের পথ পেরিয়ে শিল্পকলায় আসবে? যদি ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মঞ্চ থাকত তবে কাউকে ভোগান্তি পোহাতে হতো না। অনেক ভালো ভালো নাটক নামছে, কিন্তু মঞ্চের অভাবে করতে পারছে না। প্রত্যাশা কিন্তু অনেক। তবে মঞ্চের অভাবে, ইনফ্রাস্ট্রাচারের অভাবে দলগুলো নাটক নামাতে পারছে না। তাই প্রশ্ন তো থেকেই যায়, নাটক করবেটা কোথায়?’

সর্বশেষ খবর