রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সাংগঠনিক দলাদলিতে অস্থির চলচ্চিত্র

আলাউদ্দীন মাজিদ

সাংগঠনিক দলাদলিতে অস্থির চলচ্চিত্র

সাংগঠনিক দলাদলিতে অস্থির হয়ে উঠেছে ঢাকাই চলচ্চিত্র। কাজের কোনো খবর নেই। বিভিন্ন ইস্যুতে চলচ্চিত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে দলাদলি ঠিকই চলছে। এতে চলচ্চিত্র শিল্পের সর্বনাশ হচ্ছে। দলাদলির কারণে প্রায় আট বছর বন্ধ ছিল প্রযোজক সমিতির নির্বাচন। বর্তমানে দুটি চলচ্চিত্র সংগঠনের দলাদলিতে আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে চলচ্চিত্রপাড়া। একটি হলো চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি, অন্যটি শিল্পী সমিতি। প্রদর্শক সমিতির বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনটির নির্বাচন স্থগিত করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মেসার্স আলিম সিনেমাসহ ১১০ জন আবেদনকারী ২ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে প্রতিকার দাবি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, সংগঠনের নির্বাচনী তফসিল ভোটারদের সঠিকভাবে ও সঠিক নিয়মে জানানো হয়নি। এ ছাড়া কারচুপির মাধ্যমে মনোনয়নপত্র দেওয়া হয়েছে, অনেক প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র দেওয়া হয়নি এবং বেশিরভাগ সদস্যকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। একই তারিখে চাঁদা নিয়ে কারচুপির মাধ্যমে কাউকে মেম্বার বানানো হয়েছে, কাউকে বানানো হয়নি। যাদের নির্বাচন কমিশনার বানানো হয়েছে তারা হল মালিক নন এবং ভোটারও নন। প্রাপ্ত অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সেলিম হোসেনকে পত্রপ্রাপ্তির ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি ও মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বলেন, নির্বাচনের নিয়ম না মেনে আইন বহির্ভূত কাজ করা হয়েছে। ১১০ জনের আবেদনের ভিত্তিতে তাই তদন্ত কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির নির্বাচনের সব কার্যক্রম স্থগিত রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জেনেছি। অভিযোগ আছে, সভাপতি ইফতেখার নওশাদের বিরুদ্ধে কমিটির সবাই একাট্টা হয়ে তাকে বাদ দিয়ে গোপনে নির্বাচন করতে যাচ্ছিলেন। অন্যদিকে, চলচ্চিত্রশিল্পী সমিতির নির্বাচনকে ঘিরে শিল্পীদের মধ্যেও অস্থিরতা এখন চরমে। ২৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য এ নির্বাচনে জায়েদ-মিশা প্যানেলের বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আছেন সভাপতি পদে মৌসুমী আর সাধারণ সম্পাদক পদে ইলিয়াস কোবরা। এ নির্বাচনকে ঘিরে শুরু হয়েছে পক্ষে-বিপক্ষে কাদা ছোড়াছুড়ি। শিল্পী সমিতির বিদায়ী সভাপতি মিশা সওদাগর বলেছেন, তাদের নির্বাচনী ইশতিহারে সমিতির জন্য ফান্ড তৈরির ইচ্ছে থাকলেও শিল্পীদের অসহযোগিতার কারণে ফান্ড তৈরি করতে পারেননি। মিশা বলেন, আমরা অনুষ্ঠান করেছি। সদস্য তারকাদের বলেছি টাকা না নিতে। তখন তারা বলেছে, অমুক নিচ্ছে তো আমি কেন নেব না। নারায়ণগঞ্জের ড্রিমল্যান্ডের একটি প্রোগ্রামে পারফর্ম করার জন্য নায়ক ফেরদৌস ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন। তার সঙ্গে রিয়াজ ও পপিকেও একই পরিমাণ টাকা দেওয়া হয়েছে। সমিতির কমিটির সদস্য এবং একজন সিনিয়র শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও তারা শিল্পীদের ফান্ড গঠনের টাকায় পারিশ্রমিক নিয়েছেন বলে দাবি বিদায়ী সভাপতি ও সেক্রেটারির। এতে বিক্ষুব্ধ ফেরদৌস। তিনি বলেন, কোনো প্রোগ্রামের জন্য আমার পারিশ্রমিক কি ৫০ হাজার টাকা? ওরা কী বোঝাতে চায়? আমি একটা প্রোগ্রামে গেলে কত টাকা সম্মানী নেই সেটা যারা আমাকে নেন তারা সবাই জানেন। তারা কি প্রমাাণ দিতে পারবে আমি এই টাকা সম্মানী নিয়েছি? এর জবাবে জায়েদ খান অভিযোগ তুলে বলেন, উনারা সমিতির তহবিল নিয়ে বড় বড় কথা বলেন। ২ বছরে তারা একটি পয়সাও তহবিলে দেননি। কোথাও থেকে আনেনওনি। তাদের কী অবদান আছে সমিতিতে? কেউ মারা গেলেও তারা আসেননি, কোনো মিলাদেও অংশ নেননি। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে রিয়াজ বলেন, আমি খুবই অবাক হচ্ছি এ রকম মিথ্যাচার দেখে। ভদ্রতা-ধৈর্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর সময় চলে এসেছে। আমি, ফেরদৌস বা পপি কী ৫০ হাজার টাকা পারিশ্রমিকের শিল্পী? এমন সস্তা হলে তো দিনে চারটা করে শো করতে পারতাম। তারা নির্বাচন করছে করুক। প্রশ্ন তুললে অনেক তোলা যাবে। কিন্তু যে কাদা ছোড়াছুড়ি ওরা করছে সেটার ফল তাদের ভোগ করতে হবে। সব মিলিয়ে ২ বছরে ৫৮ লাখেরও বেশি টাকা এসেছে। কোন খাতে কত খরচ হয়েছে তার কোনো হিসাব আছে? কোনো কাগজ আছে? মুখে বললে তো হবে না। এখানে অনেক টাকার ব্যাপার। এটা কমিটির সদস্যরা চাইলে অন্যায়? সৎ হলে কিসের এত ভয়? আছে কোনো রশিদ সেই টাকা নেওয়ার? ঘটনা হলো নারায়ণগঞ্জের সেই শোটি ছিল ৮ লাখ টাকা বাজেটের। তার মধ্যে ৪ লাখ টাকা শিল্পী সমিতির ফান্ডে জমা হয়েছে। আর বাকি ৪ লাখ টাকা যারা পারফর্ম করেছে তাদের দেওয়া হয়েছে। সেটা কিন্তু পারিশ্রমিক হিসেবে নয়, ড্রেস ও অন্যান্য বাবদ। আর তা নির্ধারণ করা হয়েছে সবাই মিলেই। আমি, ফেরদৌস ও পপি যদি ৫০ হাজার করে দেড় লাখ টাকা নিয়ে থাকি তাহলে বাকি আড়াই লাখ টাকা কোথায়? ২ বছরে ৫৮ লাখেরও বেশি টাকা এসেছে। কোন খাতে কত খরচ হয়েছে তার কোনো হিসাব আছে? একই অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন চিত্রনায়িকা পপিও। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, গত ২ বছরে সমিতির সঙ্গে থেকে অনেক কিছু দেখে নির্বাচনের ইচ্ছেটা মরে গেছে। যেটা বুঝেছি তারা দুজন নিজেদের কোরাম আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছে। যারা ন্যায্য কথা বলে, যারা অনিয়ম হলে প্রতিবাদ করে তারা সমিতিতে নেতৃত্বে আসুক এটা তারা চান না।

পঞ্চাশের দশকে ঢাকাই ছবির গোড়াপত্তন হয়। তখন থেকে স্বাভাবিক নিয়মে চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে মনোমালিন্য থাকলেও কখনো ছিল না দলাদলি। মানুষকে বিনোদিত করাই চলচ্চিত্রকারদের কাজ। দলাদলির বিষয়টি কয়েক বছর আগেও শিল্পীদের বেলায় দেখা যায়নি।

২০১৭ সালে এসে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করে। চলচ্চিত্রকারদের একাধিক সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনের অধীনেই শিল্পীদের নিষেধাজ্ঞা, বয়কট সংস্কৃতি চালু হয় ২০১৭ সাল থেকে। বিশেষ করে শিল্পী সমিতি ও পরিচালক সমিতিতে এটি বেশি হয়েছে। চলচ্চিত্রের ১৮ সংগঠন মিলে গঠিত হয় ‘চলচ্চিত্র পরিবার’।

বলা হয়ে থাকে চলচ্চিত্রের উন্নয়নেই এ পরিবার গঠিত। যদিও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে খোদ চলচ্চিত্রকারদের মধ্যেই। আন্দোলন আর মিটিং ছাড়া চলচ্চিত্রের উন্নয়নে নাকি আর কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি পরিবারের। পরিবার গঠনের আগে বা পরে যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ঠেকানোর কথা বলে চলচ্চিত্রের বিশেষ কিছু মানুষের পেছনে নিষেধাজ্ঞা ও বয়কট করার কারণেই পরিবার থেকে আলাদা হয়ে পড়েন একদল শিল্পী। দলাদলিটা এরপর থেকেই চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। শাকিব খানকে বয়কট, পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন কর্তৃক নায়করাজ রাজ্জাককে নিয়ে মানহানি কথা বলার প্রতিবাদ করায় পরিচালক গাজী মাহবুবকে বহিষ্কার, শাকিব খানের সঙ্গে কাজ করার কারণে নির্মাতা শামিম আহমেদ রনিকে বহিষ্কার ও একই কারণে বাপ্পারাজ, মৌসুমী, ওমর সানিসহ বেশ কয়েকজন শিল্পীকে শিল্পী সমিতি কর্তৃক শোকজ দেওয়া, চলচ্চিত্র পরিবারের আন্দোলনের সময় প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার নওশাদের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন কারণে অনেক শিল্পী, নির্মাতা, প্রযোজক ও কলাকুশলী নিয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্রের উন্নয়নই মূলমন্ত্রÑ স্লোগানকে মূলমন্ত্র করে আত্মপ্রকাশ ঘটায় নতুন সংগঠন ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ফোরাম’। বলা হয়েছিল, এটা  চলচ্চিত্রের সার্বজনীন সংগঠন। শেষ পর্যন্ত অন্তর্কোন্দলে ফোরাম আর টেকেনি।

 চলচ্চিত্রকারদের এ দ্বিধাবিভক্তির বিষয়ে  প্রবীণ অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান বলেছিলেন, ‘আমি এখন সবার মুরব্বি। সবার সঙ্গেই আছি। আবার কারও সঙ্গে নেই। চলচ্চিত্র ফোরামের আত্মপ্রকাশের দিন আমাকে দাওয়াত করা হয়েছে। তারা আমাকে মুরব্বি হিসেবে নিয়ে এসেছে। আমি এসেছি। এরপর এফডিসিতে শুটিং করতে এলে শিল্পী সমিতির সেক্রেটারি জায়েদ খান আমাকে ধরে সমিতির অফিসে নিয়ে এসেছে। আমি এসেছি। এখনো জানি না পরিবার কিংবা ফোরাম চলচ্চিত্রের উন্নয়নে কী কাজ করবে। আমাদের দলাদলির কী দরকার? শিল্পীদের দরকার শিল্প বিকাশ করা, দল নয়। এখন প্রযোজকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, সেদিকে কেউ খবর নিচ্ছে না। চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকার বাইরেও পর্দার পেছনের কত মানুষ বেকার পড়ে আছে সে খবর কে রাখে। সারা বছর আমি এ টি এমের খবরও তো কেউ রাখে না। তাই বলি বিভক্তি বা দলাদলি নয়, কাজ করুন সবাই মিলে।’

চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের কথায় সাংগঠনিক দলাদলির মাধ্যমে রাজনীতির ময়দানের মতো চলচ্চিত্রপাড়ায়ও বিভক্তি তৈরি হচ্ছে। চলচ্চিত্রের উন্নয়ন, নাকি একে অপরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি বা আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ করার জন্যই এ বিভক্তি? দেশের প্রধান গণমাধ্যম চলচ্চিত্র শিল্পকে নিয়ে এ অবস্থা কারও কাম্য নয়।

সর্বশেষ খবর