মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

সিনেমা হলশূন্য ২৮ জেলা

বন্ধ হয়ে গেল রাজমণি

আলাউদ্দীন মাজিদ

সিনেমা হলশূন্য ২৮ জেলা

আবারও হুমকির মুখে দেশীয় চলচ্চিত্রশিল্প। ১২ অক্টোবর বন্ধ হয়ে গেল রাজধানীর ‘রাজমণি’ সিনেমা হলটি। প্রদর্শক সমিতির একটি সূত্র জানায়, অচিরেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় থাকা সিনেমা হলগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকায় রাজিয়া, পূরবী, পদ্মা, সুরমা, অভিসার, মানসী। চট্টগ্রামে আলমাস ও সিনেমা প্যালেস। সিলেটের নন্দিতা, রংপুরের শাপলা টকিজ। বরিশালের অভিরুচি। খুলনার শঙ্খ। পঞ্চগড়ের ছায়াছন্দসহ আরও অনেক সিনেমা হল। কারণ ছবি নেই। এর ওপর আবার ছবি মুক্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে মোবাইল অ্যাপসে।

উত্তরার দিয়াবাড়িতে ‘ফ্যান্টাসি’ আর মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে ‘পিক্স’ নামে দুটি নতুন সিনেপ্লেক্স চালু হলেও শুরুতেই এগুলো লোকসানের কবলে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। আশা করা হয়েছিল যেহেতু উত্তরার ধারে কাছে কোনো সিনেমা হল নেই, তাই এই সিনেমা হলে দর্শকের ঢল নামবে। তারপরও দর্শক নেই। কেন? এর সহজ-সরল জবাব একটিই, আর তা হলো ছবির মান ভালো নয়। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি ইফতেখার নওশাদ বলেন, সিনেমা হল টিকিয়ে রাখার জন্য কনটেন্ট দরকার। তা কোথায়? স্থানীয়ভাবে যেসব ছবি নির্মাণ হচ্ছে সেগুলো পর্যাপ্ত বাজেটের অভাবে মানসম্মত হচ্ছে না। আর বর্তমানে দেশে সিনেমা হলের যে সংখ্যা রয়েছে তাতে এক কোটি টাকা ব্যয় করে ছবি নির্মাণ করলেও লগ্নিকৃত অর্থ তুলে আনা অসম্ভব। ফলে স্বল্প বাজেটে যেনতেনভাবে ছবি নির্মাণ করতে গিয়ে মানের অভাবে সিনেমা হল দর্শক হারাচ্ছে আর সিনেমা হল বন্ধের ধারাবাহিকতা চলছেই। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে প্রায় ২৮টি জেলা এখন সিনেমা হলশূন্য। এসব জেলার মধ্যে রয়েছে নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঝালকাঠি, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, নড়াইল, মৌলভীবাজার, রায়পুর, মাদারীপুর, সিরাজগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার। একসময় রাজধানী ঢাকায় ছিল ৪৪টি সিনেমা হল। এখন রয়েছে ১৭টি। সর্বশেষ গত ১২ অক্টোবর বন্ধ হলো রাজধানীর ‘রাজমণি’। এরপরই চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, যশোরকে চলচ্চিত্র দর্শকের স্বর্গ বলে গণ্য করা হতো। ২০০০ সাল পর্যন্ত টাঙ্গাইলে ৪৭টি হল ছিল। এখন সেখানে মাত্র ১২টি হল আছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক উপদেষ্টা মিয়া আলাউদ্দীনের দেওয়া তথ্য মতে, গত দুই দশকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বন্ধ হয়ে গেছে ২০টি প্রেক্ষাগৃহ। একসময় যশোরের পরিচিতি ছিল সিনেমা হলের শহর হিসেবে। ছিল ২১টি সিনেমা হল। এখন যশোরে মাত্র ৬টি সিনেমা হল চালু রয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলার ৩১ হলের মধ্যে এখন টিকে আছে মাত্র ৭টি। খুলনা মহানগরীতে সিনেমা হল ছিল ১১টি। এখন আছে মাত্র ৪টি। ডুমুরিয়া উপজেলার একমাত্র সিনেমা হলটি বন্ধ রয়েছে। নেত্রকোনা জেলা শহরের একমাত্র সিনেমা হল হীরামন ও নাটোরের সায়াবান বন্ধ হয়ে গেছে। সিলেটের সাতটির মধ্যে একটি এবং রংপুরের পাঁচটির মধ্যে একটি টিকে আছে। দিনাজপুর, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুরে বর্তমানে মাত্র একটি করে হল চালু রয়েছে। ঝিনাইদহে ১৭টির মধ্যে ৩টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২০টির মধ্যে ৬টি, বেলকুচিতে ১৭টির মধ্যে ২টি, চুয়াডাঙায় ১৪টির মধ্যে ২টি, নীলফামারীতে ২৪টির মধ্যে ১টি, পাবনায় ২৮টির মধ্যে ৭টি, মানিকগঞ্জে ৯টির মধ্যে ১টি, লক্ষ্মীপুরে ১০টির মধ্যে ১টি, ঠাকুরগাঁয়ে ১৫টির মধ্যে ৬টি, রাজবাড়ীতে ২০টির মধ্যে ২টি, রূপগঞ্জে ৬টির মধ্যে ১টি, রংপুরে ৫টির মধ্যে ১টি, সিলেটে ৭টির মধ্যে ১টি সিনেমা হল চালু রয়েছে। গাজীপুরে ছিল ১৪টি সিনেমা হল, এর মধ্যে ১১টিই বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের সিনেমা প্যালেস হলের ব্যবস্থাপক গৌরিপদ চৌধুরী, সিলেটের নন্দিতা হলের ম্যানেজার মোস্তফা চৌধুরী, রংপুরের শাপলা টকিজের ম্যানেজার শাহাবউদ্দীন, বরিশালের অভিরুচি সিনেমার ম্যানেজার সৈয়দ রেজাউল কবির, রাজশাহীর উপহার সিনেমার ম্যানেজার তপন কুমার দাস, খুলনার শঙ্খ সিনেমার কর্মকর্তা ওবায়দুল হক প্রায় অভিন্ন সুরে বলেন, মানহীন ছবির কারণে এভাবে লোকসান গুনে সিনেমা হল টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। স্টাফদের বেতন, বিদ্যুৎ, পানির বিলসহ নানা খরচ কীভাবে বহন করব। ঢাকার বাইরে মফঃস্বলের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। প্রদর্শক সমিতির সাবেক উপদেষ্টা মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, সরকার চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করার পর কথা ছিল সিনেমা হলের বিদ্যুৎ বিল শিল্পের সুবিধায় নেওয়া হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবেই বিশাল অঙ্কের বিদ্যুৎ বিল নেওয়া অব্যাহত রেখেছে সরকার। এতে এই লোকসানি সিনেমা হল আরও ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ অবস্থায় চলচ্চিত্র সংগঠনগুলোর নেতারা শিল্পটিকে নিয়ে কি ভাবছেন। চলচ্চিত্র এডিটরস গিল্ডের সভাপতি আবু মুসা দেবু বলেন, আগে প্রযোজক একটি ছবি নির্মাণ করে পরিবেশকের কাছে যেতেন। উভয়ে মিলে ছবিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতেন। বর্তমানে এই দুই সংগঠনের মাঝখানে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে বুকিং এজেন্টের উদ্ভব হয়েছে। তারা ছবির রেন্টাল নির্ধারণ করেন কমিশনের ভিত্তিতে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন প্রযোজক ও প্রদর্শক। দ্বিতীয়ত. সিনেমা হল ডিজিটাল হওয়ায় একটি টিকিট থেকে প্রযোজক পাচ্ছেন মাত্র ২৫ ভাগ শেয়ার মানি। বাকিটা নানা অজুহাতে সিনেমা হল মালিকরা নিয়ে নিচ্ছেন। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজারের কথায় ডিজিটাল প্রদর্শনের নামে প্রজেক্টর ভাড়া নিয়ে চলছে প্রতারণা। সিনেমা হল কমে যাওয়ায় লোকসান গুনে ফিরে যাচ্ছেন প্রযোজকরা। প্রযোজকের অভাবে পরিচালকরা বেকার।

প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু বলেন, এখন বছরে দু/একটি ছবি চলে। নকলের নৈরাজ্য আর পুরনো ফর্মুলা থেকে নির্মাতারা বেরিয়ে আসতে পারছেন না। ডিজিটালের নামে চলছে প্রতারণা। সরকার, চলচ্চিত্রের ও সাধারণ মানুষ মিলে টার্গেট করতে হবে ২০ টাকা হারে প্রতি টিকিটে ১ কোটি মানুষ ছবি দেখবে। ই টিকেটিং ব্যবস্থাও চালু করতে হবে। লগ্নীকৃত অর্থ ফেরতের নিশ্চয়তা দিয়ে আমরা প্রযোজকদের ফিরিয়ে আনতে সবার সহযোগিতা চাই।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর