বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে উত্তাল এফডিসি

আলাউদ্দীন মাজিদ

শিল্পী সমিতির নির্বাচন নিয়ে উত্তাল এফডিসি

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে উত্তপ্ত এখন এফডিসি। তর্ক-বিতর্ক চললেও সুষ্ঠু-সুন্দর পরিবেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ২৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে, আসবে নতুন নেতৃত্ব- এমন প্রত্যাশা প্রার্থী-ভোটার এবং চলচ্চিত্রকারদের।

 

চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে উত্তপ্ত এখন এফডিসি। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই নতুন ঘটনার জন্ম নিচ্ছে। ২০১৯-২১ মেয়াদের শিল্পী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৫ অক্টোবর। এবার সভাপতি পদে লড়াই করছেন চিত্রনায়িকা মৌসুমী ও খলনায়ক মিশা সওদাগর। সহ-সভাপতির দুটি পদে প্রার্থী হয়েছেন মনোয়ার হোসেন ডিপজল, রুবেল ও নানা শাহ। সাধারণ সম্পাদক পদে জায়েদ খানের প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী ইলিয়াস  কোবরা। সহ-সাধারণ সম্পাদক পদে লড়ছেন আরমান ও সাংকো পাঞ্জা। সাংগঠনিক সম্পাদক পদে অভিনেতা সুব্রত, দফতর ও প্রচার সম্পাদক পদে জ্যাকি আলমগীর এবং কোষাধ্যক্ষ পদে অভিনেতা ফরহাদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। অর্থাৎ সুব্রত, জ্যাকি আলমগীর এবং ফরহাদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পদে লড়ছেন নূর মোহাম্মদ খালেদ ও ইমন। সংস্কৃতি ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে লড়ছেন জাকির হোসেন ও ডন। কার্যকরী পরিষদ সদস্যের ১১টি পদের জন্য প্রার্থী হয়েছেন ১৪ জন। তারা হলেন- অঞ্জনা সুলতানা, রোজিনা, অরুণা বিশ্বাস, আলীরাজ, আফজাল শরীফ, বাপ্পারাজ, রঞ্জিতা, আসিফ ইকবাল, আলেকজান্ডার  বো, জেসমিন, জয় চৌধুরী, নাসরিন, মারুফ আকিব ও শামীম খান (চিকন আলী)। ২০১৭ সালের ৫ মে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সর্বশেষ নির্বাচন হয়। নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মিশা-জায়েদ প্যানেল পাস করে। কমিটি গঠনের কিছুদিন পর ওমর সানী-অমিত হাসান প্যানেল থেকে বিজয়ী কার্যকরী পরিষদের সদস্য মৌসুমী ও নানা শাহ পদত্যাগ করলে কমিটির দুটি পদ শূন্য হয়। পরবর্তীকালে সমিতির কার্যনির্বাহী সংসদের মিটিংয়ে পাস করার মধ্য দিয়ে ওই দুটি পদে নিপুণ ও নিরবকে নেওয়া হয়। এবারের নির্বাচনে গতবারের বিজয়ী রিয়াজ, ফেরদৌস, পূর্ণিমা, পপি, নিপুণ, নিরব, সাইমন সাদিক  নেই। ফেরদৌস বলেন, ‘আমি বলেছিলাম নির্বাচন ১৮ অক্টোবর থেকে কয়েকদিন পিছিয়ে দিতে। কিন্তু সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ ১২-১৩ জন মিলে পিছালেন না। পরে ঠিকই কিন্তু পিছিয়ে ২৫ অক্টোবর করা হয়েছে। অথচ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা পুরো ২১ সদস্যের কমিটির বাইরে করতে পারেন না তারা।’ রিয়াজ বলেন, ‘শিল্পী সমিতির পরিবেশ ভয়াবহ রকমের দূষিত হয়ে গেছে। যে অশ্লীলতার কারণে সিনেমা ছেড়ে শিল্পীদের জন্য কাজ করতে সমিতিতে এসেছিলাম, এখানে এসে সেই একই রকম দূষিত পরিবেশ  দেখতে পাচ্ছি।’ পপি বলেন, ‘কেউ কেউ প্যানেল প্রস্তুত করেই নিজের মতো করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে দিয়েছেন। অন্যদের প্যানেল গোছানোর সময়ই দেওয়া হয়নি। এটি ক্ষমতার অপব্যবহার। ক্ষমতার বড়াই।’ এবারের নির্বাচনে অনেক শিল্পী ভোটাধিকার হারিয়ে সহযোগী সদস্য হয়েছেন। এ কারণে তারা ভোট প্রয়োগ করতে পারবেন না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গঠনতন্ত্র তোয়াক্কা না করেই নতুন সদস্য নেওয়ার অভিযোগ তুলেছে তারা বিদায়ী কমিটির দিকে। অন্যদিকে অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন বিদায়ী শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান। জানা গেছে, গত নির্বাচনে শিল্পী সমিতির মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ৬২৪ জন। মিশা সওদাগর-জায়েদ খান প্যানেল বিজয়ী হওয়ার পর এ তালিকা থেকে ১৮১ জন  ভোটারের ভোটাধিকার খর্ব করে কেবল সহযোগী সদস্য করা হয়েছে। যারা এবার ভোট দেওয়ার অধিকার পাবেন না। অন্যদিকে নতুন করে ২০ জন শিল্পীকে করা হয়েছে নতুন ভোটার। এবারের শিল্পী সমিতির ২০১৯-২০ মেয়াদের নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা হচ্ছে ৪৪৯ জন। বাদ পড়া অনেক ভোটার বলছেন গঠনতন্ত্রের ধারা অনুযায়ী আমাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নতুন করে যারা ভোটার হয়েছেন তারা আমাদের চেয়ে বেশি সিনেমায় কাজ করেননি। কিন্তু আমাদের সিনেমার তালিকা দেখলে বোঝা যাবে কারা শিল্পী আর কারা শিল্পী নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিল্পী বলেন, সমিতির গঠনতন্ত্রের ৫(ক) ধারায় উল্লেখ আছে, ন্যূনতম পাঁচটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অবিতর্কিত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। কিন্তু এসব বিষয়ের তোয়াক্কা না করেই বড় ধরনের একটা গেম খেলেছে মিশা-জায়েদ খান। নতুন এখন যারা ভোটার হয়েছেন তারা এই ধারার মধ্যে পড়েন। তারপরও তারা ভোটার হয়েছেন। জায়েদ খান বলেন, সমিতির গঠনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে আমরা কোনো কাজ করিনি। সমিতির নিয়ম অনুযায়ী আমরা নতুন সদস্য ও বাদ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছি। যারা এখন এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন তারা মূলত আমাদের নির্বাচনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে চেষ্টা করছেন। আমরা আমাদের নীতি মেনেই সমিতির সঙ্গে কাজ করেছি। সমিতির গঠনতন্ত্রের ৫(ক) ধারার বিষয়টির সঙ্গে বর্তমান নতুন সদস্য নেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত জানতে চাইলে জায়েদ খান বলেন, কার্যকরী পরিষদের সদস্য ও উপদেষ্টা পরিষদ মিলেই ভোটার তালিকা সংশোধন করা হয়েছে। সমিতির গঠনতন্ত্রের ৫(ক) ধারাটি আজ  থেকে ত্রিশ বছর আগের। সে সময় বছরে ৭০ থেকে ৮০টি সিনেমা মুক্তি পেত। আর এখন বছরে কয়েকটি সিনেমা নির্মাণ হয়। যার ফলে কার্যনির্বাহী সদস্য মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, দুটি করে সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করলে তাদের সদস্যপদ দেওয়া হবে। শিল্পীরা বলছেন, ২০১৭ সালের ৫ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মিশা সওদাগর ও জায়েদ খান ক্ষমতায় আসার পর বেশকিছু ইতিবাচক কাজ দিয়ে যেমন প্রশংসিত হয়েছেন তেমনি আবার বিতর্কের মুখেও পড়েছেন। মিশা-জায়েদ কমিটি জয়ী হওয়ার পর সংগঠনটির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি বছর একবার বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও গত বছর তা হয়নি। গত ৪ অক্টোবর বিএফডিসির জহির রায়হান কালার ল্যাব মিলনায়তনে দুই বছরের সভা একসঙ্গে আয়োজন করা হয়। এই সভা নিয়েও ওঠে বিতর্ক। এখানে দুই বছরের আয়-ব্যয়সহ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নানা কার্যক্রম তুলে ধরা হলেও সে আয়-ব্যয় নিয়ে কমিটির গত মেয়াদের সহ-সভাপতি অভিনেতা রিয়াজকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির বর্তমান কমিটির  মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২৪ মে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল আগস্ট মাসে। সমিতির গঠনতন্ত্রের ৮ নম্বর অনুচ্ছেদের (চ)-এ আছে, ‘পূর্ববর্তী কার্যকরী পরিষদের মেয়াদান্তে অতিরিক্ত ৯০ দিনের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন হইতে হইবে।’ সে হিসাবে ২৪ আগস্টের মধ্যে ২০১৯-২০-এর নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও সমিতির বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আগস্টের মধ্যেই নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু আগস্ট শোকের মাস। তাই এক মাস পিছিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে নির্বাচন হতে পারে।’ তারপরও নির্বাচন হচ্ছে আরও দেরিতে মানে অক্টোবরে। বিষয়টি নিয়েও গঠনতন্ত্র লঙ্ঘনের অভিযোগ অনেক শিল্পীর। কথা ছিল মিশা-জায়েদের বিপরীতে প্যানেল দেবেন মৌসুমী-ডি এ তায়েব। সেই প্যানেলে রিয়াজ, ফেরদৌস, পপি, পূর্ণিমা, সাইমনসহ অনেকে প্রার্থী হবেন। শেষ পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন মিশা-জায়েদ প্যানেল ২১ পদে পূর্ণ প্রার্থী দিলেও মৌসুমী আসেন একা। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ডি এ তায়েব সরকারি চাকরি করার কারণে নির্বাচন করতে পারছেন না। কিন্তু অন্যরা মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার দিন সকাল থেকে আমার ফোন রিসিভ করেননি এবং মনোনয়নপত্র জমা দিতে আসননি। যতটুকু শুনেছি অদৃশ্য শক্তির ভয়ভীতির কারণে তারা নির্বাচন থেকে দূরে সরেছেন। এদিকে সর্বশেষ সোমবার এফডিসিতে নির্বাচনে স্বতন্ত্র সভাপতি প্রার্থী অভিনেত্রী মৌসুমীকে অপমান করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় নির্বাচনী আমেজ-উৎসব এখন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে বলে উদ্বেগের সঙ্গে জানাচ্ছেন সাধারণ শিল্পীরা। গত সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় এফডিসিতে খলঅভিনেতা ড্যানিরাজ তর্কে জড়ান অভিনেত্রী মৌসুমীর সঙ্গে। একপর্যায়ে  মৌসুমীকে তিনি ধাক্কা মারেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে ওইদিন রাত ৮টা পর্যন্ত এফডিসিতে উত্তেজনা বিরাজ করে। ঘটনার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইলিয়াস কাঞ্চন প্রযোজক সমিতির সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু, শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানকে নিয়ে আলোচনায় বসেন। সেখানে ড্যানিরাজ কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। এসব কারণেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে চলছে বিতর্ক। এই তর্ক- বিতর্ক চললেও সুষ্ঠু-সুন্দর পরিবেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ২৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে, আসবে নতুন নেতৃত্ব- এমন প্রত্যাশা প্রার্থী- ভোটার এবং চলচ্চিত্রকারদের।

সর্বশেষ খবর