শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

গিটার জাদুকরের প্রয়াণের এক বছর

আলী আফতাব

গিটার জাদুকরের প্রয়াণের এক বছর

জন্ম : ১৬ আগস্ট, ১৯৫২, মৃত্যু : ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

গিটার আর কণ্ঠকে একাকার করে বাংলাদেশের সংগীতের ভুবনে ঝড় তুলেছিলেন সুরের যুবরাজ আইয়ুব বাচ্চু। আজকের এই দিনে লাখো কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান এই গুণী শিল্পী। হেমন্তের আকাশ যখন শীতের আগমনী বার্তা দিয়ে যাচ্ছে, তখনই এলো বিদায় বার্তা। যার গান শুনে, গিটারের টানে এখনকার বহু যুবকের কৈশোর কেটেছে সেই আইয়ুব বাচ্চু আর নেই। তিনি চলে গেলেন দরজার ওপাশে। ওপাশ থেকে আর কখনো ফেরা যায় না। এ এক অসম্ভব দূরত্ব, যে দূরত্ব কখনো ঘুচবে না। একজন আইয়ুব বাচ্চুর জন্ম প্রতি দশকে হয় না। প্রতি শতাব্দীতেও একজন আইয়ুব বাচ্চু পাওয়া যাবে তাও নিশ্চিত করে বলে যায় না। আইয়ুব বাচ্চুকে বাংলাদেশের ব্যান্ড ও গিটারের জগতে নক্ষত্র বলে অভিহিত করা হয়। বাচ্চু কেবল তার গলা দিয়েই মুগ্ধতা ছড়াননি, সমান্তরালে তিনি বাজিয়ে গেছেন গিটার। আইয়ুব বাচ্চু আর গিটার যেন একে অপরের পরিপূরক, প্রতিশব্দ। বাচ্চুকে বাদ দিয়ে গিটার, গিটার বাদ দিয়ে বাচ্চুর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, যাবে না।

গিটার পাগল ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তিনি যখন ক্লাস সেভেনে পড়তেন, সেই সময় বাবার কাছ থেকে কালো রঙের একটি অ্যাকুস্টিক গিটার পেয়েছিলেন। ওই সময় একদিকে বিশ্বের অন্যতম সেরা গিটারবাদক জিমি হ্যান্ড্রিকস, রিচি ব্ল্যাকমোর, কার্লোস স্যানটানার গিটার শুনতেন, অন্যদিকে বাংলাদেশের পপশিল্পী আজম খানের গিটারবাদক নয়ন মুন্সির গিটার বাজানোর খুবই মুগ্ধ করেন তাকে। একসময় তাদের মতো গিটার পারদর্শী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সত্তরের দশকের তিনি ভাড়ায় গিটার বাজাতেন। গিটারটাও ভাড়া নিয়ে যেতেন। ওই সময় ডিসকো কোম্পানির একটি গিটার তার এক বন্ধুর কাছ থেকে ৩০ টাকা দিনপ্রতি ভাড়ায় নিয়ে শো করতেন। ভাড়া হিসেবে  ৩০ টাকা দেওয়ার পর আরও ৫০ থেকে ৬০ টাকা থেকে যেত তার পকেটে। তার গিটারের জাদুতে মুগ্ধ হতে শ্রোতারা অধীর অপেক্ষা করতেন। গানের সঙ্গে তার মন মাতানো গিটারের সুর শ্রোতাদের মনকে আন্দোলিত করত। অনেক সময় শুধু গিটারের সুরেই মঞ্চ কাঁপিয়েছেন তিনি। তার বন্ধুদের অনেকেই বইয়ের বাইরে আগ্রহের কেন্দ্র ছিল ফুটবল কিংবা ক্রিকেট। কেউ কেউ সংগীতেও মজেছিলেন। আবার ছাত্ররাজনীতির জটিল পথে পা বাড়িয়েছিলেন কেউ কেউ। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সবার থেকে আলাদা। ক্রিকেট, ফুটবল, রাজনীতি- কিছুই টানেনি তাকে। তার প্রেম ছিল গিটারকে ঘিরে। স্কুলজীবনেই গিটারের প্রেমে সেই ছেলেটি আইয়ুব বাচ্চু। রক্ষণশীল পরিবারে গিটার প্রেম নিয়ে অনেক ঝক্কিই পোহাতে হয়েছে আইয়ুব বাচ্চুকে। প্রায় রাতেই ঘর থেকে পালিয়ে চলে যেতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। বাসায় থাকলেও নিজের কক্ষে রাতভর।

১৯৮৬ সালে আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’। দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ময়না (১৯৮৮)। এলআরবি ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম ‘এলআরবি’ (১৯৯২)। এ ছাড়া তার একক অ্যালবাম কষ্ট (১৯৯৫), সময় (১৯৯৮), একা (১৯৯৯), প্রেম তুমি কি (২০০২), দুটি মন (২০০২), কাফেলা (২০০২), প্রেম প্রেমের মতো (২০০৩), পথের গান (২০০৪), ভাটির টানে মাটির গানে (২০০৬), জীবন (২০০৬), সাউন্ড অব সাইলেন্স (ইনস্ট্রুমেন্টাল, ২০০৭), রিমঝিম বৃষ্টি (২০০৮), বলিনি কখনো (২০০৯), জীবনের গল্প (২০১৫)।

এলআরবির অ্যালবামগুলো হলো এলআরবি (১৯৯২),  সুখ (১৯৯৩), তবুও (১৯৯৪),  ঘুমন্ত শহরে (১৯৯৫), ফেরারি মন (১৯৯৬), স্বপ্ন (১৯৯৬), আমাদের বিস্ময় (১৯৯৮), মন চাইলে মন পাবে (২০০০), অচেনা জীবন (২০০৩), মনে আছে নাকি নেই (২০০৫), স্পর্শ (২০০৮), যুদ্ধ (২০১২) আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া জনপ্রিয় কিছু গান- সেই তুমি কেন অচেনা হলে, রুপালি গিটার, রাত জাগা পাখি হয়ে, কষ্ট পেতে ভালোবাসি, মাধবী, ফেরারি মন, এখন অনেক রাত, ঘুমন্ত শহরে, বারো মাস, হাসতে দেখ, এক আকাশের তারা, উড়াল দেব আকাশে।

আইয়ুব বাচ্চু বাংলাদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ছিলেন। তিনি একাধারে গায়ক, লিডগিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার, প্লে­ব্যাক শিল্পী। এলআরবি ব্যান্ড দলের লিডগিটারিস্ট এবং ভোকাল বাচ্চু ছিলেন বাংলাদেশের ব্যান্ড জগতে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বের একজন।

১৯৬২ সালে ১৬ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চট্টগ্রাম শহরের এক বনেদী হাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এ জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।

 

আজ সংগীতশিল্পী ও এলআরবির প্রতিষ্ঠাতা আইয়ুব বাচ্চুর (এবি) প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। এমন দিনে তাকে স্মরণ করেছেন তারই বন্ধু ও সহযোদ্ধারা...

 

একজন আরেকজনকেই কাঁধে নিতে হবে : কুমার বিশ্বজিৎ

৪০ বছরের সম্পর্কে আমাদের অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। চট্টগ্রামের হাটে, মাঠে, ঘাটে, বিয়েবাড়ি থেকে শুরু করে এমন কোনো জায়গা নেই যে আমরা বাজাইনি। চট্টগ্রামের অলিগলিতে আমাদের স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। মাঝে ব্যস্ততার কারণে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ কমে যায়। প্রায়ই বাসায় দাওয়াত দিতাম। সে আসতে পারত না। তার সঙ্গে কথা বলে ফোন রাখার সময় প্রায়ই অভিমান করে বলতাম, ‘আসিস না আর কোনো দিন।’ মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে শেষবার দেখা হয়। তখন বলল, ‘দোস্ত, শেষ পর্যন্ত হয়তো আমাদের একজন আরেকজনকেই কাঁধে নিতে হবে।’

 

ওপারে ভালো থাকুক বাচ্চু : নকীব খান

তার সঙ্গে স্মৃতি তো অনেক রয়েছে। কোনটা রেখে কোনটা বলি! আমরা একসঙ্গে ব্যান্ড করেছি। ১৯৮২ সালের দিকে সোলসে সে যোগ দেয়। এর আগে সে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডে ছিল। তাকে ব্যান্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন পিলু খান। অল্প বয়সে তাকে হারিয়েছি। এক বছর হতে চলল সে আমাদের মাঝে নেই। এই সময়ে সবাই মিলে তার আত্মার শান্তি কামনা ছাড়া কিছুই করার নেই! ওপারে ভালো থাকুক-এই কামনাই করি।

 

শিল্পীর মৃত্যু নেই : জেমস

আশির দশকের কথা। লিড গিটারিস্ট হিসেবে ফিলিংস ব্যান্ডে যোগ দিয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। এর পর কত আড্ডা-গানের মধ্য দিয়ে কত সময় চলে গেছে, তার হিসাব মেলানো কঠিন। তখনই জেনেছিলাম, সংগীতের জন্য আইয়ুব বাচ্চু কতটা নিবেদিতপ্রাণ। শিল্পী ও সংগীতায়োজক হিসেবে তার পথচলাও মসৃণ ছিল না। পরিবারের অসম্মতি আর অনেক বাধা পেরিয়ে দিনের পর দিন সংগ্রাম করেই শিল্পী হিসেবে তার প্রতিষ্ঠা। সে ইতিহাস গল্পের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। তার কাছেই শুনেছিলাম, গিটারের নেশায় কীভাবে ছুটে গেছেন এক মঞ্চ থেকে আরেক মঞ্চে। জানি, শিল্পীর মৃত্যু নেই। গিটারের বরপুত্র আইয়ুব বাচ্চু বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন তার সৃৃষ্টির মধ্য দিয়ে। তবু পুরনো দিনের স্মৃতি মনে আঁচড় কাটবেই।

 

 

সর্বশেষ খবর