বিটিভির সেই সময় থেকে এ পর্যন্ত অনেক নতুনের আবির্ভাব ঘটেছে মিডিয়ায়। রাতারাতি তারা পেয়েছেন তারকাখ্যাতিও। কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তিগত খামখেয়ালিপনায় তারা ইদানীং বিলুপ্তপ্রায় অভিনয়শিল্পীর পর্যায়ে চলে যাচ্ছেন। ঝরে পড়ছেন দলে দলে। টিভি নাটকের পালাবদলে নতুনদের অবস্থান নিয়ে লিখেছেন- পান্থ আফজাল
বিটিভি নামে তখন একটিই চ্যানেল ছিল। এখনকার মতো বিজ্ঞাপন দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে নাটক দেখানোর সিস্টেম তেমন ছিল না। নাটক ছিল মানসম্মত। বরফ গলা নদী, ইডিয়ট, রক্তের আঙ্গুরলতা, পারলে না রুমকী, বাবার কলম কোথায়, কূল নাই কিনার নাই, অশ্রুত গান্ধার, মারিয়া আমার মারিয়া, রক্তকরবী, দৃষ্টিদান, সকালসন্ধ্যা, যোগাযোগ, সংশপ্তক, তথাপিসহ প্রায় একক ও ধারাবাহিক নাটকই ছিল অমর সৃষ্টি। দর্শকপ্রিয় এসব নাটকে তখন ছিল তারকার সমাবেশ। কে ছিলেন না! ছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন, সৈয়দ আহসান আলী সিডনী, আফজাল হোসেন, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ফেরদৌসী মজুমদার, আলী যাকের, রামেন্দু মজুমদার, সারা যাকের, দিলশাদ খানম, আসাদুজ্জামান নূর, কেয়া চৌধুরী, প্রিসিলা পারভীন, রিনি রেজা, শম্পা রেজা, মুজিবুর রহমান দিলু, মিতা চৌধুরী, সুবর্ণা মুস্তাফা, নীপা রেজা, নায়লা আজাদ নূপুর। একটির পর একটি মন ভোলানো নাটক আমরা দেখেছি। সেই আশির দশকে হুমায়ূন আহমেদের নন্দিত নরকে নাট্যজগতে এক বিপ্লব আনে। পরবর্তীতে এইসব দিনরাত্রি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, বহুব্রীহি, আজ রবিবার, বারো রকমের মানুষ, ভাঙনের শব্দ শুনি এই নাটকগুলোর মধ্য দিয়ে প্রচুর দর্শক তৈরি হয়েছিল। হুমায়ূনকন্যা শিলা আহমেদ, বিপাশা হায়াত, মেহের আফরোজ শাওন, জহিরুদ্দিন পিয়ার, ত্রপা মজুমদার, মাকনা ভাইখ্যাত হাবিবুল ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর অভিষেক ও জনপ্রিয়তা আমরা দেখেছি। তারানা হালিম, শমী কায়সার, নিমা রহমান, তারিক আনাম, আফসানা মিমি, জাহিদ হাসান, তৌকীর আহমেদ, অপি করিম, আজিজুল হাকিম, সেলিম, তমালিকা, ঈশিতা, তারিন, টনি ডায়েস, মেঘনা, সুরাইয়া হুদা রাত্রী, ইলোরা গহর আরও অনেকেই ছিলেন ছোট পর্দার উজ্জ্বল সব তারকা। মিতা চৌধুরী, আসাদুজ্জামান নূর, আফজাল-সুবর্ণা জুটির ক্রেজ তখন তুঙ্গে। রোমান্টিক জুটি হিসেবে সার্থক। হুমায়ুন ফরীদি-সুবর্ণা, রাইসুল ইসলাম আসাদ-সুবর্ণাও বেশ নাম করেছিল। পঁচাত্তর থেকে পঁচাশি নাটকের স্ক্রিপ্ট ছিল খুবই শক্তিশালী। অভিনয় ছিল মানসম্মত। নাটক তৈরি হতো কম। কিন্তু নাটক হতো মনে রাখার মতো অভিনয় শৈলীসম্পন্ন। একটা ঘণ্টা মনেই হয় না যেন কোনো নাটক দেখছি। মনে হয় যেন নিজের জীবনে নিজেদের পরিবারে এই ঘটনাপ্রবাহ ঘটে চলেছে। চৌদ্দ বা চব্বিশ ইঞ্চি সাদা-কালো অথবা রঙিন টিভির সামনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে থাকা হতো। নাটক শেষ হলেও মনে তার রেশ রয়ে যেত। উত্তরসূরিদের পথ ধরে একসময় এসেছে জাহিদ হাসান, শহীদুজ্জামান সেলিম, বিপাশা হায়াত, তৌকীর আহমেদ, শমী কায়সার, আফসানা মিমি, তানিয়া আহমেদদের মতো জনপ্রিয় সব তারকা। এখনো তাদের কম-বেশি দেখা যায়। এখনো তাদের নিয়ে দর্শকের মাঝে অন্য রকম আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাদের পরবর্তী সময়ে কালে কালে অনেক অভিনয়শিল্পীই মিডিয়ায় এসেছেন। কাজ করেছেন বা করছেন। কিন্তু এসব প্রজন্মের শিল্পীদের নিয়ে আগ্রহ বা তাদের পরিচিতি নিয়ে দর্শকদের মাঝে আগ্রহ খুবই কম। নতুন এ শিল্পীদের নিয়ে নির্মাতারা বহু নাটক নির্মাণ করলেও দর্শক তাদের ঠিকভাবে নিতে পারছেন না। তবে আজাদ আবুল কালাম, মাহফুজ আহমেদ, নুসরাত ইমরোজ তিশা, জাহিদ হাসান, আনিসুর রহমান মিলন, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, শাহনাজ খুশি, আ খ ম হাসান, শতাব্দী ওয়াদুদ, রওনক হাসান, প্রভা, অপূর্ব, মেহজাবিন, আফরান নিশো, নাদিয়া আহমেদ, মম, অর্পণা, সানজিদা প্রীতি, মৌটুসী বিশ্বাসের মতো গুটিকয় তারকাকে দর্শক চেনেন। কিন্তু এত এত শিল্পী কাজ করলেও ড্রইং রুম মিডিয়ায় কেন শিল্পী সংকট? গুটি কয়েকজন নিজ যোগ্যতাবলে টিভি পর্দায় নিজের অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু বাকিরা কোনো সুযোগ পাচ্ছেন না। তবে সিনিয়র অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নামের পর অল্প কিছু নতুন অভিনয় তারকা দর্শকনজর কাড়তে সক্ষম হচ্ছেন। বয়সে ছোট হলেও সিনিয়রদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই কাজ করছেন তারা। বয়সে ছোট কিন্তু অভিনয়ে বড় এই শিল্পীদের নামের তালিকায় আছেন অনেকেই। তারা প্রত্যেকেই আলাদা করে দর্শকনজর কাড়ছেন। কিন্তু বেশির ভাগ শিল্পী বিভিন্ন কারণে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছেন। হারিয়ে যাচ্ছেন দর্শকদের মাঝ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও পারিপার্শি¦ক জটিলতায়। এর মধ্যে আছে খামখেয়ালিপনা, হুটহাট শিডিউল ফাঁসানো, নেশায় আসক্ত হওয়া, ইচ্ছামতো শুটিংয়ে যাওয়া, প্রেম-ভালোবাসা ও বিয়ে-সংক্রান্ত জটিলতা ছাড়াও বিভিন্ন কারণ। ঘাটতি রয়েছে পেশাদারিত্বের।