সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা
ইন্টারভিউ

ট্যাহা-পয়সা নাই চিকিৎসা করামু ক্যামনে

ট্যাহা-পয়সা নাই চিকিৎসা করামু ক্যামনে

ছবি : রাফিয়া আহমেদ

বাউল সম্রাজ্ঞী কাঙ্গালিনী সুফিয়া।

অসংখ্য মাটি ঘেঁষা ও শিকড়ের গন্ধমাখা গানের ফেরিওয়ালা, কালজয়ী লোকসংগীত রচয়িতা, সুরকার ও গায়ক এই গুণী লোকশিল্পী। রেডিও, টিভি, মঞ্চসহ বিভিন্ন প্লাটফর্মে গান গাইতে গাইতে তিনি বাউল অঙ্গনের একজন জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী। এখন মানুষের মুখে মুখে ঘোরে তার লেখা ও গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলো। এই গুণী বাউলশিল্পী রোগে-দারিদ্র্যে বয়সের তুলনায় অনেকখানি বুড়িয়ে গেছেন এখন। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। মরতে বসেছেন একরকম বিনা চিকিৎসায়। কোনো এক দুপুরে বাংলাদেশ প্রতিদিনের আমন্ত্রণে এসেছিলেন জীবনের নানা বাঁকের কথা জানাতে। তার সঙ্গে করা সেই কথোপকথন পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন- পান্থ আফজাল

 

কেমন আছেন?

শরীরডা ভালা না। শরীরডা খালি টলে। সুস্থ না। মাতায় সমস্যা, কিডনি ও হার্টের সমস্যা। ট্যাহার অভাবে সঠিক চিকিৎসা করাতি পারছি না। কহন জানি দম ফুরাইয়া হাওয়ার পাখিডা উইড়া যায়!

 

ডাক্তার দেখাচ্ছেন না?

দেহাইছি তো। ঐজন্যি এট্টু চলতি-ফিরতি পারতেছি। তয় সারাক্ষণ শরীরডার মধ্যি ক্যামন জানি করে! বুঝি না।

 

শুনেছিলাম আর্থিক অবস্থাও খারাপ। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না...

হ, ট্যাহা-পয়সাও তো হাতে নাই, যে চিকিৎসে করাব। অহন চাইয়া-চিন্তায় দিন কাটাই।

 

রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহায়তাও তো পেয়েছিলেন। সেটা দিয়ে কী চলে না?

আরেকটু আইগ্যা আসলি ভালো হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক শিল্পীদের বা অনেক মাইনষের সাহায্য করচে। এহেক জনের ২০ লাখ বা ১০ লাখ করে দিছে। আবার একুশে পদক দিছে। আমি তো শিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়া; আমি তো একুশে পদক পাই নাই শেখ হাসিনার হাত থেইক্যা।

 

তাহলে তো অনেক আক্ষেপ রয়েছে যে, আপনাকে সঠিকভাবে এখনো সম্মান বা মূল্যায়ন করা হয়নি?

হ, তা তো আছেই! অপেক্ষায় আছি, এই অবস্থা শুইন্যা যেন প্রধানমন্ত্রী আমারে ডাইক্যা নেয়। ডাইক্যা নিয়া আমার মাতায় হাত বুলাইয়া দেয়, কিচু অনুদান দেয়। আমি যেন একুশে পদক পাই। মৃত্যুর আগে এই সম্মানটুকু চাই (অশ্রুসিক্ত নয়নে)।

 

প্রধানমন্ত্রীর কাছে আপনার এখন আর কী চাওয়া?

আমি এহনো গান করতি চাই। কিন্তু বয়স তো আর কম হইলো না। হাঁটতে পারি না। এক জাইগ্যা থেইক্যা আরেক জাইগ্যায় চলতি পারি না। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ, আমারে বিভিন্ন জাইগ্যা ঘুইরা ঘুইরা গান করবার লাইগ্যা একটা গাড়ি দেয়। কিচু একডা করে দিক, বাঁইচা থাকবার জন্যি। আর বহুদিনের ইচ্ছা কুষ্টিয়ায় ‘কাঙ্গালিনী সুফিয়া একাডেমি’ হোক। হেইডা যদি করত, মইরা গিয়াও শান্তি পাইতাম! এহনো সাভার জামসিংয়ের জমির সাড়ে ৯ লাখ টাহার ঋণ মাতায় লইয়া পালাইয়া বেড়াই। কি যে করমু, বুঝবার পারতেছি না।

 

রাষ্ট্রীয়ভাবে এর আগে কতটুকু অনুদান পেয়েছেন?

রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু সাহায্য পাইছিলাম। আর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেইক্যা মহামান্য রাষ্ট্রপতির হাত দিয়া আমারে কিছু অর্থ ও সম্মাননা দিছে। এই দিয়া তো কিছুই হচ্ছে না। অহন অর্থের ওভাবে কিচুই করতি পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া মাসিক ১০ হাজার টাহায় তো সংসারই চলে না, চিকিৎসা করাব কী দিয়া? নুন আনতি পানতা ফুরায় আমার, ঔষধ কিনব কি দিয়া? ট্যাহার অভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করাতি পারছি না। ধারদেনা কইরা জীবন চলতেছে আর কি!

 

অনেক কালজয়ী গান লিখেছেন, কণ্ঠ দিয়েছেন। সেসব গান অনেকেই গেয়ে লাভবান হচ্ছে। আপনি কি রয়্যালিটি পান?

তা তো পাই না বাপু! অনেক মানষেই আমার গান গায়। আমার ছবি তুলে মোবাইলে নেয়। হেইগুলা ব্যবহার করে। অনেক কম্পানিও আমার গান অন্যের দিয়া গাওয়ায়। যা লাভ, সবই তো কম্পানি পায়, আমার তো কুনো লাভ হয় না। হেরা আমার গান ইউটিউবে দেয়, অন্যের দিয়া গাওয়ায়। কই আমার কাছ থেইক্যা কুনো অনুমতি নেয় না।

ট্যাহা-পয়সাও তো কিচুই দেয় না আমারে। কিচু দিলেও চিকিৎসা করাইতে পারতাম। এরা যদি কিচু দিত, তাইলে তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাচে হাত পাততাম না।

 

আপনার গান অন্য শিল্পীরা গাইছে, ফিউশন করছে। এটা কতটা ঠিক হচ্ছে?

ঠিক তো হইতেছে না। একজন শিল্পীর গান আরেকজন নকল কইরা গাইতেছে- এইডা তো ভালা না। সে ঠিকঠাক মতো গাইতেও পারচে না।

 

কাঙ্গালিনী উপাধি কে দিয়েছেন?

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির তহনকার ডিজি মোস্তফা সাহেব (মুস্তাফা মনোয়ার) আমারে এই উপাধি দেন।

 

কত বছর ধরে গান করছেন?

হেইডা তো মনে নাই। মাতা কাজ করে না। এহন তো বুড়ি হইয়া গেছি। তয় ১৪ বছর বয়স থেইক্যা আমি গান করি। আর রাজবাড়ী জেলায় আমার জন্ম।

 

রাজবাড়ীতে তো বসতবাড়ি আছে আপনার?

রাজবাড়ীতে থাকার জায়গা পাইছিলাম। হেই সময় রাজবাড়ীর ডিসি কল্লোল সাহেব ছিলেন (হাসানুজ্জামান কল্লোল)। তিনি আমার থাকার জন্যি জায়গার বন্দোবস্ত কইরা দিছিলেন। আর আরেকজন বাড়িঘর কইরা দিছিল; কিছু ট্যাহাও পাইছিলাম।

 

নিজ এলাকা থেকে কী কোনো সম্মাননা পেয়েছেন?

তেমন করি তো কেউ মূল্যায়ন বা সম্মাননা দিল না! কেউ তো ডাকলিও না কোনো দিন। আসলে দ্যাশের মাইয়া তো, দ্যাশের মূল্যায়ন পায় না (আক্ষেপ)।

 

সাভারেও তো থাকেন?

সাভারেও থাকি। আবার রাজবাড়ীতেও। কুষ্টিয়াতে থাকি, সেখানে অল্প একটু থাকার জাইগা আছে।

 

শুনেছি কুষ্টিয়াতে আপনার জমি বেদখল হয়ে আছে?

হ, সেহানে ১৮ শতাংশ জমি পাইছিলাম। লালন সাঁইজির অনুষ্ঠান (ছেঁওড়িয়া) যেখানে অয় (স্টেজ)। সেহানের জমি এহনও দখলে পাইনি। বেদখল করে সেহানে টয়লেট বানাইছে। জমি আমারে বুঝাইয়া দিচ্ছে না। ভূমি মন্ত্রণালয়ে অনেকবার গিছি, কাজ তো কিচুই হচ্ছে না! রাষ্টীয়ভাবে শুনি শিল্পীদের অনেক থাকার জাইগা দেয়, আমি তো পাচ্ছি না।

 

লালন সাঁইজির গান কি সবাই ঠিকমতো গাইতে পারছেন?

কীভাবে কব! সবাইরে মূল্যায়ন করবার চাই না।

 

কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন সাঁইজির ১২৯তম তিরোধানের অনুষ্ঠানে গান করেছিলেন...

আমারে দেরিতে দিছিল। খালি কইবার লাগছিল, পরে পরে। আমি তহন ডিসি সাহেবের কাছে যাইতেছিলাম। হেরপর তারা ভয় পাইয়া আমারে স্টেজে উঠায়। তহন রাত ১২ডা হইব। গান তো দুইডা গাইছিলাম। আমার মেয়ে পুষ্পও সেহানে ছিল। আমি মরি যাবার পর আমার মাইয়াই সব পরিচালনা করব। তাই সবসময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে।

 

অনেক বয়স হয়েছে। এখনো কী নিয়মিত গান গাইতে চান?

গানই তো আমারে বাঁচাইয়া রাখছে। আমি বারবার মঞ্চে ফিরবার চাই। নিয়মিত গান গাইবার চাই।

সর্বশেষ খবর