রবিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

জন্মদিন এলেই প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে

জন্মদিন এলেই প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে

একজন রুনা লায়লা, অনেক উঁচুতে দাঁড়িয়ে থেকেও খুব সহজ, সরল আর প্রাণবন্ত তিনি। নতুন কিংবা পুরনো কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে ঠোঁটের কোণে সহজ সরল হাসি। গুণী এই মানুষটির আজ জন্মদিন। এ ছাড়া ২০১৮ সালে আলমগীর পরিচালিত ‘একটি সিনেমার গল্প’ চলচ্চিত্রে সুরকার হিসেবে কাজ করেই তিনি অর্জন করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। জন্মদিন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তি’ ও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন- আলী আফতাব

 

 

আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা এবং শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তিতে অভিনন্দন।

ধন্যবাদ আপনাকে এবং বাংলাদেশ প্রতিদিন পরিবারকে। কারণ সবসময়ই এই জাতীয় দৈনিকটি আমার নানা সাফল্যে, কাজে পাশে থেকেছে এবং আমাকে সহযোগিতা করেছে। কিছুদিন আগে দেশের বাইরে থাকায় এই পত্রিকা আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে আমার উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়নি।

 

‘একটি সিনেমার গল্প’ চলচ্চিত্রে সুরকার হিসেবে অভিষেক হয়েই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তি। আপনার অনুভূতি কী?

সত্যি বলতে কী এই সিনেমাতে সিনেমার পরিচালকের আগ্রহেই আমার সুর করা। আবার আমারই ইচ্ছায় সিনেমাটিতে আমার প্রথম করা সুরে আঁখির গান গাওয়া। যে গানের সুর করার জন্য আমার সুরকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তি সেই একই গানের জন্য আঁখিরও চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া, বিষয়টি আমার কাছে অনেক বড় অর্জন হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। ভীষণ আনন্দ লাগছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো গানটিতে কণ্ঠ দেওয়ার আগে আঁখি সত্যিই অনেক কষ্ট করেছে। নিজেকে গানটির জন্য তৈরি করে নিয়েই তারপর গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছে। আর পাশাপাশি গানটির জন্য চমৎকার অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছেন ইমন সাহা। সিনেমার পরিচালক, আঁখি, ইমন, আমি আমরা সবাই এই সাফল্যে আনন্দিত।

 

আজকের দিনটি কীভাবে কাটাবেন?

এখন তো আসলে পরিবারের অনেকেই নেই, বাবা নেই, মা নেই, বোন দীনা লায়লা নেই। জন্মদিন এলেই যে শুধু তাদের মিস করি এমনটি নয়। নীরবে একা একা যখন হঠাৎ ফেলে আসা দিনের কথা মনে হয় তখনই তারা আমার স্মৃতিতে চলে আসেন। তাই জন্মদিনকে ঘিরে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা নেই। যথারীতি ঘরোয়াভাবেই দিনটি উদযাপন করব, নিজের মতো করেই সময় কাটাব। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবার কাছ থেকে শুভেচ্ছা, অভিনন্দন পেতে ভালোই লাগে।

 

আপনার জন্মদিনে কলকাতার টিভি চ্যানেল স্টার জলসা বিশেষ আয়োজন করেছিল, কেমন ছিল সেই আয়োজন?

গত নভেম্বরে দিনব্যাপী কলকাতার টালিগঞ্জের একটি স্টুডিওতে ‘কে আপন কে পর’ ধারাবাহিকের বিশেষ পর্বের দৃশ্য ধারণ করা হয়। সুরকার হিসেবে পুরস্কার প্রাপ্তির খবরটি সেখানেই পাই। যাই হোক, আমার জন্মদিনকে ঘিরে স্টার জলসার উদ্যোগে ‘কে আপন কে পর’ ধারাবাহিকের বিশেষ এই আয়োজনকে আমি স্বাগত জানাই। আমাকে নিয়ে বিশেষ এই পর্ব নির্মাণের জন্য স্টার জলসা এবং এই ধারাবাহিকের প্রত্যেকের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। এমন একটি জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক প্রচারের সময়কালে আমারই জন্মদিনে আমার উপস্থিতির বিষয়টি আমার জন্য অনেক ভালো লাগার। তাছাড়া জবা চরিত্রে অভিনয় করা পল্লবী শর্মাসহ ‘কে আপন কে পর’ এর পুরো টিমকে অনুপ্রাণিত করতে পারার মধ্যেও আমার নিজেরই ভালো লাগছে।

আজ স্টার জলসায় রাত ১০টায় বিশেষ এই পর্বটি প্রচার হবে। এ ছাড়া গতকাল ধ্রুব মিউজিক থেকে প্রকাশ হলো আমার একটি গান। নাম ‘ফেরাতে পারিনি’। এটি লিখেছেন কবির বকুল।

গানটি প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন সাংবাদিক অভি মঈনুদ্দীন।

 

আপনি তো এই প্রজন্মের অনেক শিল্পীরই গান শুনেন। তারা কেমন করছে বলে আপনি মনে করেন?

এটা সত্যি, যারা সত্যিকার অর্থেই ভালো গান করে আমি তাদের নিজে ফোন করে অনুপ্রেরণা দিয়ে থাকি। আমার স্পষ্ট মনে আছে হঠাৎ একদিন দেখি শ্রদ্ধেয় বেগম আখতারের ‘জোছনা করেছে আড়ি’ গানটি একটি মেয়ে গাইছে। গানটি তার কণ্ঠে শুনে ভীষণ ভালো লাগল আমার। আমি ইমন সাহার কাছ থেকে ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তাকে ফোন করি এবং তার গায়কির প্রশংসা করি। আমি লুইপার কথা বলছি। আর গান হচ্ছে গুরুমুখী শিক্ষা। আমি যেভাবে গুরুর কাছে শিখেছি সেভাবে এখন আর কেউ শেখানোর নেই। এমনও হয়েছে যে ওস্তাদজি গানের ক্লাস নিয়ে চলে গেলেন। আবার কিছুক্ষণ পর ঘুরে এলেন। বললাম, আবার এলেন যে। তখন ওস্তাদজি বলতেন এই কাজটা আমার মাথায় এসেছে, একটু শিখিয়ে যাই। না হলে ভুলে যাব। এই যে ওস্তাদজির আমাকে শেখানোর আগ্রহ এবং আমারও শেখার আগ্রহ, দুজনের আগ্রহ ছিল বলেই কিন্তু শুদ্ধ সুরের চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পেরেছিলাম।

 

আমাদের শিল্পীদের মধ্যে অধ্যবসায়ের ব্যাপারটা কম দেখা যাচ্ছে মনে হয়। আপনি কী মনে করেন?

নতুনদের মধ্যে ভালো গান করে এমন শিল্পী কিন্তু কম নয়। তবে অনেক শিল্পীই আসলে টাকার পেছনে বেশি ছুটছেন। এ বিষয়টি দুঃখজনক। সাধনা কিংবা অধ্যবসায় থেকে তারা অনেক দূরে। চর্চায় লেগে থেকে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করার যে চেষ্টা সেটা দেখা যায় না বললেই চলে। যেন কারও কোনো সময়ই নেই। এটা তো ঠিক না। গান গাইতে হলে চর্চাটা ভীষণ জরুরি। আমাদের এখানে অনেক মেধাবী শিল্পী আছে। তাদের পথপ্রদর্শক নেই যারা তাদের সত্যিকারের আলোর পথ দেখাবে। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা ভালো ওস্তাদজি পেয়েছি। আমাদের সব দেখিয়ে দিয়েছেন। আমি তো এখনো শিখছি। কিন্তু এখনকার শিল্পীদের মধ্যে শেখার আগ্রহটাই দেখি না আমি। আমি সবসময়ই বলি, তোমরা প্লিজ খালি গলায় হলেও কঠিন কঠিন গানগুলো রেওয়াজ কর, তাতে যতটুকু পারা যায় প্র্যাকটিসটা হয়, চর্চাটাও হয়।

 

দীর্ঘ সংগীতজীবনে ১৯টি ভাষায় অসংখ্য গান গেয়েছেন। গানগুলো সংরক্ষণের বিষয়ে কিছু ভেবেছেন কী?

এ নিয়ে আমি ভেবেছি। তবে কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় কাজটি করব তা এখনো চূড়ান্ত করিনি। হয়তো খুব শিগগিরই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেব। আগামী প্রজন্মের জন্য আমার গানগুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। আবার যদি কেউ আমার গান নিয়ে গবেষণাও করতে চায় তখন তা কাজে লাগবে।

 

লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে আপনার প্রথম দেখা হওয়ার স্মৃতি....

১৯৭৪-এ বাংলাদেশে এলাম আমি। সে বছরের শেষে প্রথমবারের মতো ভারত সফরে গেলাম। আয়োজক ছিল ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন অর্গানাইজেশন।

দিল্লিতে এবং বোম্বেতে আমার শো। অর্গানাইজাররা বোম্বের শোতে লতা মঙ্গেশকরকেও আমন্ত্রণ জানালেন। বোম্বের শো-এর দিন আমি স্টেজের পেছনে রিহার্সেল করছি।

হঠাৎ দেখলাম পেছনের দরজা দিয়ে কেউ একজন প্রবেশ করছেন, পরনে সাদা শাড়ি ও হাতে গোলাপ ফুলের তোড়া। সঙ্গে আরও দুই তিনজন।

দূর থেকে মনে হলো লতাজি আবার ভাবলাম না তা কী করে হয়! যখন নিশ্চিত হলাম লতাজি তখন তার কাছে ছুটে গেলাম। লাল গোলাপের তোড়াটি আমার হাতে দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। তার সঙ্গে ছিলেন বিখ্যাত পরিচালক ঋষিকেশ মুখার্জি এবং সলিল চৌধুরী। লতাজির সঙ্গে কথা হলো অনেকক্ষণ। দেখলাম আমার সম্বন্ধে তিনি অনেক কিছু জানেন। কীভাবে জেনেছেন জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমি তো অনেক উর্দু গান শুনি এবং বেশির ভাগই তো আপনার গান। আমার গাওয়া তার অনেকগুলো প্রিয় গানের কথা চটপট বলে ফেললেন। আমি খুব অবাকই হয়েছিলাম সেদিন। 

 

আপনার জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি?

আমার জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি নেই। আলহামদুলিল্লাহ, আমি এখন পর্যন্ত যা পেয়েছি, যতটুকু পেয়েছি আমি মনে করি অনেক বেশি পেয়েছি। আমি সবসময়ই শুকরিয়া আদায় করি। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যে ভালোবাসা, যে শ্রদ্ধা পেয়েছি তা আমার কাছে পুরস্কারের চেয়েও অনেক বড়।

শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও যখন যাই তখন যে ভালোবাসা পাই তা দেখে আমি মাঝে মাঝে বিস্মিত হই, মুগ্ধ হই। নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত আছে বলেই তা সম্ভব হয়েছে। আমি আমার দেশকে, দেশের মানুষকে অনেক অনেক ভালোবাসি।

সর্বশেষ খবর