রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
ইন্টারভিউ → ইলিয়াস কাঞ্চন

সড়কে শৃঙ্খলা না ফিরিয়ে আন্দোলন থেকে ফিরছি না

সড়কে শৃঙ্খলা না ফিরিয়ে আন্দোলন থেকে ফিরছি না

জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। সড়ককে নিরাপদ করার প্রত্যয়ে নব্বই দশকে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’। প্রায় ২৬ বছর ধরে এই সংগঠনের মাধ্যমে সড়কের নিরাপত্তা বিধানে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে বাস-ট্রাকের শ্রমিকরা যে ‘কর্মবিরতি’ পালন করেছেন সেখানে ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবি হেয় প্রতিপন্ন করার অভিযোগ উঠেছে। এমন আচরণে কষ্ট পেলেও থেমে যাওয়ার পাত্র নন তিনি। এ প্রসঙ্গে ইলিয়াস কাঞ্চনের সাক্ষাৎকার তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 

 

নতুন সড়ক পরিবহন আইন বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

দেরিতে হলেও সরকার সড়ককে নিরাপদ করতে যে আইন প্রণয়ন করেছে তা যথাযথ হয়েছে বলে আমি মনে করি। কিন্তু যারা আইন মানতে চায় না তাদের অযৌক্তিক দাবির কাছে সরকারের নতিস্বীকার করাকে আমি কোনোভাবেই সমর্থন করি না। কারণ একটি গোষ্ঠী সব সময়ই নিজের স্বার্থে আইন অমান্যের পথে চলছে। তারা এই আইনে অসঙ্গতি রয়েছে বলে দাবি তুলল আর সরকার এতে প্রথমদিকে কঠোর অবস্থানে

থাকলেও এক সময় নমনীয় হয়ে গেল, এটি তো ঠিক নয়, সরকার আইন বাস্তবায়নের সময় বাড়িয়ে দিয়ে বলছে এর অসঙ্গতি খতিয়ে দেখবে। আমার প্রশ্ন, যে আইন বাস্তবায়নই হলো না তার আবার সঙ্গতি-অসঙ্গতি খতিয়ে দেখার কথা আসে কোথা থেকে। আগে আইন বাস্তবায়ন করা হোক, তারপর এর কোনো অসঙ্গতি থাকলে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, এসব অন্যায় আবদারের কাছে জিম্মি হওয়া বা মেনে নেওয়া উচিত নয়। তাহলে তো এদেশের মানুষ অনিরাপদ সড়কে রয়েই যাবে। প্রতিদিন অগণিত প্রাণ ঝরবে সড়কে। আইনে কোনো অসঙ্গতি থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। এসব না করে আইনটি কার্যকর হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে আমাকে হেনস্তা করা হচ্ছে; যা অতীতেও করা হয়েছে। অথচ আমি সব সময় বলে আসছি, এ আইন করা হয়েছে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য, সড়কে দুর্ঘটনা কমানোর জন্য। জেল বা জরিমানা আদায়ের জন্য নয়।

 

এই আইন মেনে চলার জন্য আপনার উদ্যোগ নিয়েও পরিবহন শ্রমিকরা নেতিবাচক আচরণ করছে। এতে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

দেখুন, তারা আমার এই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছে। তারা মনে করে আমি যদি এই আন্দোলন শুরু না করতাম তাহলে তারা যেভাবে নিয়ম ভঙ্গ আর আইন অমান্য করে চলছিল তা নির্বিঘেœ চালিয়ে যেতে পারত। তাদের অন্যায় কাজের পথে আমি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি, তাই যেভাবে হোক আমাকে প্রতিহত করতেই হবে তাদের। কিন্তু আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, নিরাপদ সড়কের দাবিতে গত প্রায় ২৬ বছর ধরে আমি যেভাবে নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আসছি, কাজ করে যাচ্ছি কোনো অশুভ শক্তি তা থামাতে পারবে না। এক সময় সড়ক দুর্ঘটনাকে মানুষ মনে করত ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। আমি এই আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের সেই অমূলক ধারণা ভেঙে দিয়েছি। এদেশের মানুষের চোখ খুলে দিয়েছি। এখন জনগণ এ ব্যাপারে সচেতন হয়েছে। তারা সড়ককে নিরাপদ করতে আমার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনের নাম এখন জাতীয় স্লে­াগানে পরিণত হয়েছে। এ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে এখন প্রতিবছর পালিত হয় নিরাপদ সড়ক দিবস। সংগঠনের কর্মকা- জাতিসংঘেও প্রশংসিত হয়েছে। স্বীকৃতি হিসেবে একুশে পদকও দেওয়া হয়েছে আমাকে। আমি আমরণ এই আন্দোলন চালিয়ে যাব। কোনো অশুভ শক্তি আমার পথরোধ করতে পারবে না। এক্ষেত্রে আমি আরও বলতে চাই যে, স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছে এবং যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তাদের প্রতি আমাদের সবার কোনো না কোনো দায়িত্ব রয়ে গেছে। কারণ দেশ স্বাধীন না হলে আজ আমি নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন হতে পারতাম না। তাই জীবন দিয়ে হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ আমি শোধ করে যাব।

 

যারা আপনার এই আন্দোলনের বিরোধিতা করে আসছে তাদের উদ্দেশে কী বলবেন?

তাদের উদ্দেশে বলব, ভালো কাজের ক্ষেত্রে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর বিরোধিতা নতুন কোনো বিষয় নয়, আমাদের মহামানবদের ক্ষেত্রে এটা হয়েছে। তারাও সত্যকে তুলে ধরতে গিয়ে চরমভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। আমারও একই কথা, আমি সত্যের পথে আছি, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে মৃত্যুকেও ভয় করি না। যারা সত্য ও নিয়মের বিরুদ্ধে তাদের যেন সৃষ্টিকর্তা প্রকৃত বিষয়টি বোঝার তৌফিক দেন, এটিই আমার প্রার্থনা।

 

যারা এই আইনের বিরুদ্ধে নেমেছে তাদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে বলে কি মনে করেন?

যারা অনিয়মের পথে চলে তাদের মধ্যে তো অবশ্যই অসৎ উদ্দেশ্য কাজ করে। তারা বলছে আইনকে সহনীয় করে দিতে। সহনীয় করা মানেই হলো আইন অমান্য করার সুযোগ পাওয়া। কেউ যদি সৎ ও সচেতন হয় তাহলে আইন যত কঠোর হোক তাতে তো ভয় পাওয়ার কথা নয়। এতেই বোঝা যায় এ ব্যাপারে তাদের উদ্দেশ্য কতটা সৎ বা অসৎ। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, প্রতীক্ষার পর বিভিন্ন মহলের মতামত, অনেক গবেষণা ও ব্যাপক আকারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সবাই পেয়েছে ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’। যুগোপযোগী এ আইন পাস হওয়ার পর সাধারণ জনগণ ও সচেতন মহলের সবাই আইনের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর ১ নভেম্বর থেকে হওয়ার কথা থাকলেও আইন সম্পর্কে সবাই অবগত না থাকার কারণে ১৪ দিন সময় দেওয়া হয়। এরপর যখন আইনটি প্রয়োগ শুরু হলো, ঠিক সেই সময় অবাক বিস্ময়ে দেখলাম চারদিকে এক নৈরাজ্য পরিস্থিতি। আমার প্রশ্ন হলো, কেন এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? সরকার যেন এদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায়  আনে সেই আবেদনও রাখছি।

 

চলচ্চিত্র জগৎসহ সর্বস্তরের মানুষ আপনাকে এই কাজে সমর্থন দিচ্ছে, এ নিয়ে আপনার আগামী পরিকল্পনা কী?

আমি যেহেতু সবার কল্যাণে রাস্তায় নেমেছি তখন সচেতন মানুষেরা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সবার প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। সবাইকে বলব নিয়ম প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নামব। এখন আমি অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি, সরকার শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটিই দেখছি। আমি আবারও বলতে চাই, নিজের ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে, নিজের সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে সড়ক নিরাপদের যে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, সেটা আমি চালিয়েই যাব। যাদের জন্য আমি সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছি; কোনো কিছু পাওয়ার আশায় নয়। দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। আমার ক্যারিয়ারে সময় না দিয়ে নিরাপদ সড়কে সময় দিয়েছি। সুতরাং সড়কে নিয়ম না ফিরিয়ে আমি আন্দোলন থেকে ফিরছি না।

সর্বশেষ খবর