রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

আমি এখন আর ডুবে যাওয়ার ভয় করি না

আমি এখন আর ডুবে যাওয়ার ভয় করি না

ছবি : রাফিয়া আহমেদ

ন্যান্সি, গানের ভুবনে জনপ্রিয় একটি নাম। তার সংগীতজীবন শুরু ২০০৬ সালে ‘হৃদয়ের কথা’ চলচ্চিত্রের গান গেয়ে। ২০১১ সালের ‘প্রজাপতি’ চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। তারপর গানের ভুবনে পার করে দিয়েছেন ১৪টি বছর। গান ও সমসাময়িক নানা বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন- আলী আফতাব

 

বর্তমান ব্যস্ততা কী নিয়ে?

ব্যস্ততা বলতে, শীতের সময় স্টেজ শো’র মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। এরই মধ্যে ডিসেম্বরে চারটা স্টেজ শো করব। এছাড়া বুলবুল চাচার (আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল) বেশকিছু কাজের মধ্যে দুটো গানের কাজ আমি করেছি রিজভি ওয়াহিদের সঙ্গে। গান দুটি হলো ‘ও হাওয়া এই বুকের নিশ্বাস নিয়ে যাও তার বুকে’ আরেকটির নাম ‘উড়তে উড়তে যারে পাখি যারে বন্ধুর দেশে’। এ গান দুটো নিয়ে জানুয়ারিতে প্রেস কনফারেন্স করব। চাচার মৃত্যুবার্ষিকীতে গান দুটো প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে।

 

গানে কম দেখা যাচ্ছে কেন?

কারণ সিনেমার গান আগের মতো তেমন হচ্ছে না। ২০০৬ সাল থেকে কাজ করছি এ রকম তো কখনো হয়নি। কম আর বেশি কাজ তো হয়েছে। যৌথ প্রযোজনার ছবি কিন্তু আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে; এ নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু এই যে ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যায় কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে। ভাগ বাটোয়ারা শেষে আমাদের ভাগ্যে কতটুকু পড়ে, পরিমাণটা খুবই কম। এ ছাড়া আমি সিনেমার গানে সম্মানীটা একটু বেশি নিই। হয়তো সম্মানীর কারণে আমার কাছে গানের কাজ কম আসত। আর এখন তো গান একেবারেই কমে গেছে। তারপরও সিনেমায় গান করিনি যে তা নয়। সামনে আরও একটি নতুন ছবিতে গান করার কথা চলছে।

 

এখন গান প্রকাশ হচ্ছে ইউটিউবে, এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

আমি এখনো সিডি প্লেয়ারে গান শুনব এই ফিলে আছি। সিডি প্লেয়ার থেকে বেড়িয়ে হেডফোন দিয়ে গান শুনে আমি তৃপ্তি পাই না। আগে যে কোনো অ্যালবাম প্রকাশের আগে সারা শহর পোস্টারে ছেয়ে যেত। খুব সুন্দর করে একটি প্রকাশনা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সে অ্যালবামটি শ্রোতাদের হাতে তুলে দেওয়া হতো। এখন আর অ্যালবাম প্রকাশে সে উৎসবের ভাবটা নেই। এখন গান প্রকাশ হচ্ছে অনলাইনে। তবে একটা বিষয় খারাপ লাগে যখন ওই সব অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বলে, এখন আমাদের আগের মতো আর লাভ হচ্ছে না। গানের বাজার এখন কমে গেছে। সেখানে আমার প্রশ্ন? বাজারে বর্তমানে যে পরিমাণে ইউটিউভভিত্তিক চ্যানেল গড়ে উঠেছে, তারা যদি ব্যবসা করতে না পারত, তারা কী কারণে এ ব্যবসা খুলে বসেছে। আমার নিজেরও কিছু গান প্রকাশ হয়েছে বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে। কিন্তু আমি সেগুলোর নাম বলতে পারব না।

 

সবাই যখন ছুটছে মিউজিক ভিডিওর দিকে, আপনি তখন পিছিয়ে কেন?

আমি কণ্ঠশিল্পী। আর যারা শুধু মিউজিক ভিডিওর দিকে ছুটছে তাদের অনেকগুলো গুণ আছে। আমি গানটা ছাড়া আর কিছু করতে পারি না। অনেকে আমাকে বলে আমি ছবি তোলার সময় ভালো করে পোজ দিতে পারি না, স্টেজে গান গাওয়ার সময় নাচা-নাচি করতে পারি না। গান ছাড়া কেন জানি আমাকে দিয়ে আর কিছু হয় না। যেহেতু চলচ্চিত্রে গান দিয়ে আমার শুরু। আমি গান মানে বুঝি, আমি গান করব, আমার সে গানটিকে চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তুলবে চলচ্চিত্রের অভিনেতা অভিনেত্রীরা। তেমনি মিউজিক ভিডিও করার বেলায়ও আমি সব সময় গানটাকে প্রধান্য দিয়েছি। এখনকার মিউজিক ভিডিওগুলো দেখলে মনে হবে, শিল্পীরা গান থেকে মিউজিক ভিডিওর দিকে বেশি মনোযোগী। কে কত কম টাকা দিয়ে মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করতে পারে। মিউজিক ভিডিওতে কোন মডেল অভিনয় করবে। এসব বিষয় নিয়ে শিল্পীদের এখন মাথাব্যথা। একজন শিল্পী যখন নানা দিকে মনোযোগ দেবে তখন সে কীভাবে ভালো গান করবে।

 

এখন আমাদের দেশের অনেক শিল্পী আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে।

আমাদের যার যে কাজটি কারা দরকার, সে যদি সে কাজটি করে, তাহলে কিন্তু এ সমস্যা হতো না। আমার কথা হচ্ছে, মিউজিক ভিডিওতে অভিনয় করার জন্য আমাদের দেশে তো মডেল আছে। আমি কেন যাব পুরো একটি মিউজিক ভিডিওতে অভিনয় করতে। হ্যাঁ, এটা হতে পারে, আমি শখ করে একটি-দুটি মিউজিক ভিডিওতে অভিনয় করতে পারি। তার মানে এই নয়, আমার সব গানের মডেল আমি নিজেই হবো। এসব কারণে এখনকার শিল্পীরা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছে।

 

একটি সুন্দর গান তৈরির জন্য গানের কথা কতখানি ভালো হওয়া প্রয়োজন।

অনেক প্রয়োজন। গানের কথা যদি ভালো না হয়, গানের ভাবটা ভালো হবে না। ‘বাহির বলে দূরে থাকুক, ভিতর বলে আসুক না’ মারজুক রাসেল ভাই গানের কথাটি যদি এতো সুন্দর করে না লিখতেন, তা কিন্তু মানুষের মনে গেঁথে থাকত না। গানের কথা দিয়ে তো আপনি ভাবটি  বোঝাবেন। এখন আরও একটি বিষয় হয়, তা হলো, আগে সুর হয়ে যায়, তার ওপর কথা বসে। এখন দেখা গেল, যিনি গান লিখছেন, তাকে হুট করে একটি সুরের ওপর গান লিখতে বলা হয়। আর ওই সময় গানের অনেক অঙ্গহানি ঘটে। আর এ কারণে হয়তো ওই গানের অনেক আবেগ নষ্ট হয়ে যায়।

 

এখন তো  শিল্পীদের ঘরে ঘরে মিউজিক স্টুডিও। এ বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন? 

এ বিষয়টি আমার কাছে অনেক অদ্ভুত লাগে। এখন সব শিল্পীই মিউজিক কম্পোজার। এখন সব শিল্পী যদি মিউজিক কম্পোজার হয়ে যায়, তবে মিউজিক কম্পোজাররা কী করবে। একজন ভালো মিউজিক কম্পোজার হতে হলে সব ধরনের বাদ্যযন্ত্রের ওপর দখল থাকতে হয়। আর এ দক্ষতা তাদের মধ্যে আছে কি না, আমার সন্দেহ আছে। এখন ইন্টারনেটে নানা ধরনের লুপ পাওয়া যায়। আর সে সব লুপ দিয়ে তৈরি হচ্ছে গান। আবার, এখন তো অনেক মিউজিক কম্পোজার গানও গাওয়া শুরু করেছে। যার যেটা মনে চাচ্ছে, সে সেটা করছে। আর এসব কারণে আজ আমরা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগছি।  

 

আপনার মেয়ে রোদেলা লাকি কেমন গান করছে?

রোদেলার সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, সে একজন পরিচিত মানুষের সন্তান। এটা তার জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট। তবে রোদেলা কম গায়। ভালো না মন্দ গায়, তার চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সে কনফিডেন্টের সঙ্গে গান গায়। আর এ বিষয়টি তার ভিতরে ছোটবেলা থেকেই ছিল।

 

আপনি কি চান রোদেলা গানের ভুবনে থাকুক?

যেহেতু আমি নিজে একজন শিল্পী। আমার মনে তো একটি সুপ্ত ইচ্ছে আছে, আমার মেয়ে গানের ভুবনে থাকুক। কিছু না হোক গানটাকে ভালোবাসুক। তবে সে গানটাকে প্রফেশন হিসেবে নেবে কি নেবে না সেটা একান্ত তার ব্যাপার। এখন তো আর আগের জামানা নেই যে, জোর করে ধরে কিছু করানো যাবে। যেমন আমার মা আমাকে পেয়ারার ডাল দিয়ে মেরে মেরে গান শিখতে পাঠিয়েছেন। এখন তো আর সেটা করা যাবে  না। এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এখনকার ছেলেমেয়েরা অনেক স্বাধীন। তবে বোঝা যায়, রোদেলা এখন গানটাকে উপভোগ করে। এবার যখন দেশের বাইরে স্টেজে গান পরিবেশন করছিল, আমি তার মধ্যে একটি কনফিডেন্ট দেখতে পেয়েছি।

 

 গান নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

আমি এখন আর গান নিয়ে তেমন কিছু ভাবি না। তবে একটা সময় গান নিয়ে অনেক পরিকল্পনা থাকত। কিন্তু বেলাশেষে দেখা যেত, আমার পরিকল্পনার সঙ্গে অনেক কিছুই মিলত না। তখন হয়তো বা কিছুটা কষ্ট পেতাম। গান থেকে কিছু দিন দূরে ছিলাম। কিন্তু কিছু দিন যাওয়ার পর অস্থির লাগত। এভাবে থাকা যায় না। তখন আবার গানে চলে এলাম। মাঝে আমাকে নিয়ে অনেক ধরনের খবর প্রচার হয়েছে। তার পরও মানুষ এখনো আমাকে ভালোবাসে, আমাকে স্টেজে গান পরিবেশনের জন্য ডাকে, আমার কাজের খবরগুলো মিডিয়া গুরুত্বের সহকার প্রচার করে। এটা আমার অগাধ, আত্মবিশ্বাস, আমি যদি ডুবে যেতাম অনেক আগেই ডুবে যেতাম। তাই এখন আর ডোবার ভয় করি না।

সর্বশেষ খবর