শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

কাটছে না মঞ্চের সংকট

মানুষ অতিমাত্রায় টেলিভিশনমুখী হওয়ায় মঞ্চনাটক দর্শক হারাচ্ছে। মানুষের বিবেকবোধে ঘুণে ধরেছে বলেও দর্শকদের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেকাংশে কমে গেছে। দীর্ঘদিন কাজ করার পরও আশানুরূপ চরিত্র না পাওয়ায় দলগুলোতে ভাঙন ধরে। -কেরামত মওলা

মোস্তফা মতিহার

কাটছে না মঞ্চের সংকট

গল্পে ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সমাজের প্রতিবিম্বই ফুটিয়ে তোলা হয় বলে নাটককে সমাজের দর্পণ বলা হয়ে থাকে। অভিনয়ের পাঠশালা বলে খ্যাত থিয়েটারকে ঘিরেই নাটকের বিকাশ। স্বাধীনতা-উত্তরকালে নাটকের এই ক্ষেত্রটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত হলেও প্রতিকূল পরিস্থিতি ও নানা সংকটের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে এই অঙ্গনটি। তবে সমাজ সংস্কারের কাজে ব্যবহৃত সংস্কৃতির এই মাধ্যমটি বর্তমানে নানা সমস্যায় জর্জরিত। মিলনায়তনের অপ্রতুলতা, মহড়া কক্ষ, পা-ুলিপি ও দর্শক সংকট, পর্যাপ্ত নারী নাট্যকর্মী ও পেশাদারিত্বের অভাব ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে নাটকের এই মাধ্যমটিতে ঘুণে ধরেছে বলে মনে করছেন নাট্যচর্চার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত বেশ কয়েকজন নাট্যকর্মী। ফেডারেশনভুক্ত ঢাকা থিয়েটার, আরণ্যক, নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়, নাগরিক নাট্যাঙ্গন, লোক নাট্যদল (সিদ্ধেশ্বরী), থিয়েটার, সুবচন নাট্য সংসদ, সময় নাট্যদল, প্রাচ্যনাট, পদাতিক ছাড়া বেশির ভাগ নাট্যদলের মিলনায়তন পেতে প্রচুর ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। গুটিকয়েক নাট্যদল, শীর্ষস্থানীয় নাট্যদলের কর্তাব্যক্তি ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের নেতাদের স্তুতিকরণের মাধ্যমে নাটকের চর্চা অব্যাহত রেখে নিজেদের টিকিয়ে রাখলেও হল পাওয়ার আশায়  বেশির ভাগ নাট্যদলই দিনের পর দিন প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন। অন্যদিকে যে পরিমাণ মহড়া কক্ষ থাকার কথা তার অর্ধেকের চেয়েও কম মহড়া কক্ষ রয়েছে বলে নাট্যাঙ্গন থেকে বিচ্যুত হওয়ার পথে অনেক দল।

অন্যদিকে নাট্যচর্চায় পেশাদারিত্ব  তৈরির লক্ষ্যে রেপার্টরি পদ্ধতি চালু হলেও সব দলকে রেপার্টরির আওতায় আনা হচ্ছে না বলে মঞ্চের নির্দিষ্ট গন্ডি ছাড়িয়ে অভিনয়ে ক্যারিয়ার গড়ার আশায় থিয়েটারে নিবেদিতপ্রাণ শিল্পীদের অনেকেই বর্তমানে  টেলিভিশনের রঙিন ভুবনের পথে পা বাড়িয়েছে। এছাড়া পা-ুলিপি সংকটের কারণে শেকসপিয়র, ইবসেন, মলিয়েরসহ বিদেশি নাট্যকারদের নাটকগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে বিভিন্ন দলের কাছে। আর দর্শক সংকটের কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক দল নতুন নতুন প্রযোজনা আনতে সাহস পাচ্ছে না। রাজধানীর যানজট ও ঘুরে-ফিরে একই নাটক বারবার মঞ্চায়ন হওয়ায় দর্শক খরা তৈরি হয়েছে বলে জানান নিয়মিত নাট্যচর্চার সঙ্গে জড়িতরা। এছাড়া থিয়েটারে বিভক্তি ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব মঞ্চনাটককে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মনে করেন বিভিন্ন নাট্যদলের সঙ্গে সম্পৃক্তরা। একসঙ্গে নাট্যচর্চা ও নাট্য আন্দোলনের প্রত্যয় নিয়ে কাজ শুরু করলেও নেতৃত্বের সাধ গ্রহণের প্রত্যাশায় পরবর্তী সময় ভাগ হয়ে যায় রাজধানীর বেশ কয়েকটি নাটকের দল। এর মধ্যে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় ভেঙে গঠিত হয় নাগরিক নাট্যাঙ্গন ও নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বল, থিয়েটার ভেঙে আরামবাগ, তোপখানা, বেইলি রোড বিভিন্ন নামে বিভক্ত হয়। অন্যদিকে  লোক নাট্যদল ভেঙে তৈরি হয়  লোক নাট্যদল (সিদ্ধেশ্বরী), লোক নাট্যদল (বনানী) ও লোক নাট্যদল (টিএসসি)। একই ভাবে পদাতিক, মহাকাল, দৃষ্টিপাতসহ অনেক নাটকের দলেই বিভক্তি ঘটে নিজেদের বনিবনা না হওয়া বা নেতৃত্বের আশায়। অন্যদিকে, শুধু নাটককে হৃদয়ের গহিনে লালন করার কারণে নানা ধরনের সংকট ও ভাঙনের মধ্য দিয়েও নাট্যাঙ্গনে নিজেদের আলোর দ্যুতি ছড়িয়েছে বেশ কয়েকটি নাট্যদল।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে নাট্যজন কেরামত মওলা বলেন, মানুষ অতিমাত্রায় টেলিভিশনমুখী হওয়ায় মঞ্চনাটক দর্শক হারাচ্ছে। মানুষের বিবেকবোধে ঘুণে ধরেছে বলেও দর্শকদের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেকাংশে কমে গেছে। দীর্ঘদিন কাজ করার পরও আশানুরূপ চরিত্র না পাওয়ায় দলগুলোতে ভাঙন ধরে। দলের অধিকর্তার সঙ্গে ভালো সম্পর্কের সুবাদে একই ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে প্রধান চরিত্রে কাজ করে থাকেন বলে  মেধাবী ও প্রতিশ্রুতিশীল অনেকে যুৎসই চরিত্রে সুযোগ পান না, যার কারণেও দলে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে প্রতিটি নাট্যদলের কর্তাব্যক্তিদের আরও নমনীয় হতে হবে। 

নাট্যজন ঝুনা চৌধুরী বলেন, দলগুলোতে গণতন্ত্র নেই বলে ভাঙন হয়। দলের শৃঙ্খলা ও গণতন্ত্রের অভাবেই নাট্যকর্মীরা দলছুট হয়ে নতুন দল গঠন করেন।  নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে কিংবা দলের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা ও গণতন্ত্রের অভাবে অনেক নাট্যকর্মী দল থেকে বের হয়ে নতুন দল গঠন করেন, এতে আমি দোষের কিছু  দেখি না। তবে যখন তাদের কাছ থেকে আশানুরূপ কিছু পাওয়া না যায় তখনই খারাপ লাগে। দর্শক সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, মানুষ এখন অনেক বেশি যান্ত্রিক হয়ে গেছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণে দর্শকের সংখ্যা কমেছে ঠিকই, তবে এখনো ভালো কোনো নাটক মঞ্চায়ন হলে দর্শকের অভাব হয় না। যদিও তা শুধু দুই-একটা নাটকের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর