দেশীয় শোবিজ অঙ্গনের ঘাড়ে অবক্ষয় যেন সিন্দাবাদের বুড়ো আপদের মতো চেপে বসেছে দীর্ঘদিন ধরে। এই আপদ থেকে কবে কখন আমাদের সংস্কৃতি নিস্তার পাবে তা কেউ জানে না। তারপরও সবাই আশায় বুক বেঁধে থাকে। সবার প্রত্যাশা ‘ওই বুঝি এলো সুদিন’। শোবিজ বোদ্ধারা এমনই প্রত্যাশার কথা জানালেন নতুন বছরকে ঘিরে। তাদের কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ ও পান্থ আফজাল
সাবিনা ইয়াসমিন
দীর্ঘদিন ধরে শোবিজ অঙ্গনে চরম অবক্ষয় চলছে। নতুন বছরে আমার প্রত্যাশা আর শুভ কামনা এই মন্দাবস্থা থেকে যেন আমরা মুক্তি পেতে পারি। ভালো গান চাই। সামাজিক ও পারিবারিক গল্পের যে ছবি দর্শক আগে পরিবার নিয়ে সিনেমা হলে গিয়ে দেখত সে ধরনের মানসম্মত ছবি চাই। মানসম্মত ছবি নির্মাণ হলে এর সিকোয়েন্সের ওপর ভিত্তি করে ভালো গান তৈরি হয়। গান, ছায়াছবি, নাটক সবক্ষেত্রেই যেন মান ও দেশীয় সংস্কৃতির আবহ ফিরে আসে সেটিই প্রত্যাশা করছি। একটি মানসম্মত গানের জন্য প্রয়োজন শিক্ষিত ও মেধাবী গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক; এর অভাব এখন প্রকট। শোবিজ জগতের সব অঙ্গন যেন নতুন বছরে এই অভাব কাটিয়ে উঠতে পারে সে অপেক্ষায় আছি।
আলমগীর
নতুন আরেকটি বছর, দুই হাজার বিশ সাল, আমার চাওয়া বিষে বিষে বিষ ক্ষয় হয়ে চলচ্চিত্রের গৌরবময় দিন ফিরে আসুক। নতুন মানসম্মত গল্পের ছবি নির্মাণ হোক। সিনেমা হল নতুন করে সাজুক। দর্শক নতুন করে আবার ভালো ছবি পেয়ে সিনেমা হলে ফিরে আসুক। শুধু চলচ্চিত্র নয়, নাটক, গান থেকে শুরু করে শোবিজ অঙ্গনের প্রতিটি শাখা ভালোত্ব, নিজস্বতা আর ভালো লাগায় ভরে উঠুক। নতুন বছরে এমন চাওয়াটা শুধু কথার কথা নয়, এ আমার প্রাণের দাবি।
আবুল হায়াত
এখন তো শৃঙ্খলার খুবই অভাব। শৃঙ্খলার অভাবেই সংস্কৃতি অঙ্গনের অবনতি হচ্ছে। এর জন্য এ অঙ্গনের প্রতিটি সেক্টর সফলতার মুখ দেখতে পারছে না। শৃঙ্খলার অভাবের কারণে রুচিশীল বা মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান নির্মিত হচ্ছে না। নতুন বছরে আশা থাকবে, সবাই মূল্যবোধ মেনে, সবাই সবাইকে সম্মান দিয়ে কাজ করবে।
হানিফ সংকেত
সংস্কৃতি এখন আর কীর্তিমানদের হাতে আছে বলে মনে হয় না। যদি থাকত তাহলে সিনেমা, নাটক, গান, যা দেখি তাতে বাংলাদেশ আর দেশের সংস্কৃতিকে কেন খুঁজে পাই না? এখন বাইরের সংস্কৃতির অনুকরণ করতে গিয়ে মিশ্র সংস্কৃতি চালু হয়ে গেছে। বেশির ভাগ গানে সুরের চেয়ে যন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে যন্ত্রণা। একসময় সপরিবারে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি আর ঘরে বসে টিভিতে নাটক দেখা যেত। এখন সেই সোনালি দিন আর নেই। আগে শিক্ষা, তথ্য, বিনোদন ছিল টিভি অনুষ্ঠানের মূলমন্ত্র। এখন এই মূলমন্ত্র উপেক্ষিত। ছবি, গান আর নাটকের লোকেশনের জন্য কথায় কথায় অপ্রয়োজনে বিদেশে চলে যাওয়া হয়। অথচ দেশে দৃষ্টিনন্দন লোকেশনের অভাব নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের দেশ আর সংস্কৃতির প্রতি প্রীতি ফিরে না আসবে ততক্ষণ শোবিজ অঙ্গন নীতিহীন হয়ে থাকবে। এখন মিডিয়ায় সবকিছু সহজলভ্য হয়ে গেছে। জাতীয় পুরস্কারকেও বিতর্কিত করে ফেলা হয়েছে। বিদেশে গিয়েও সহজে পুরস্কার পাওয়া যায়। উদ্ভট সব নাটক নির্মাণ হচ্ছে। টিভিতে এসব প্রচারও হচ্ছে। অথচ টেলিভিশন হলো ন্যাশনাল মিডিয়া। এখন মূল্যবোধ হয়ে গেছে বাজারকেন্দ্রিক। মানে সবকিছুই যেন শুধুই বেচা-কেনার পণ্য। শিল্পভাবনা উপেক্ষিত। সিনেমা হয়ে গেছে টিভি চ্যানেলকেন্দ্রিক। এসব অব্যবস্থা যেন নতুন বছরে সুব্যবস্থায় রূপ নেয়, এটিই আমার কাম্য।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ
নতুন বছরকে গৌরবময় হিসেবে দেখতে চাই। সব জরাজীর্ণতা দূর হোক, গ্লানি আর অবক্ষয় ধুয়েমুছে যাক। নতুন বছরে ভালো কিছু ছবি আসছে। এগুলো মুক্তি পাক, দর্শকের দেখার সুযোগ হোক। এখন সিনেমা হল আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। সিনেমা সংস্কৃতি বাংলাদেশে হারিয়ে গেছে বললে ভুল হবে না। নতুন বছরে এই সংস্কৃতি আবার গড়ে উঠুক। ভালো ছবির জন্য সরকার ও চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা অপরিহার্য।
চলচ্চিত্র, নাটককে গুরুত্ব দিয়ে এর নির্মাণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হোক। একই সঙ্গে শোবিজ অঙ্গনের প্রতিটি শাখায় প্রাণের মেলা বসুক। নতুন বছরে এই আমার চাওয়া।
কুমার বিশ্বজিৎ
গত বছর আমরা অনেক প্রিয়জনকে হারালাম। সমবয়সী, কনিষ্ঠ, বয়োজ্যেষ্ঠ- অনেক নক্ষত্র চলে গেছেন। এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তাই আমাদের সবার উচিত নতুন প্রজন্মের কাছে গুণীজনদের সঠিকভাবে কৃতিত্ব তুলে ধরা। সংগীতের প্রতি অনুগামী করার জন্য নতুনদের সম্পৃক্ত করা। বিশ্বায়নের এই যুগে নতুনদের কাছে আমাদের শিকড়-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে।
সুচন্দা
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ও পরে বাঙালির নিজস্ব একটি সংস্কৃতির গণ্ডি ছিল। আর তা ছিল বলেই আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও গর্ব করা হতো। আমাদের ছবি বিদেশের মাটিতে সম্মান বয়ে আনত। এখন তো পুরো শোবিজ অঙ্গনে শুধুই অস্থিরতা আর অবক্ষয়। এই অবস্থার নিরসন আমাদের হাতেই নিহিত। আমরা যতক্ষণ নিজেরাই সচেতন না হব, নিজের দেশ আর সংস্কৃতির প্রতি মায়া না জন্মাবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই অবক্ষয় চলতেই থাকবে। আমি চাই নতুন বছরে শোবিজ জগৎটি স্বকীয়তা দিয়ে আবার নতুন করে সাজুক। বাঙালির প্রাণের ছবি, গান, নাটক আবার নির্মাণ হোক।
আহসান হাবিব নাসিম
আমাদের চাওয়া তো অনেক। তবে আমাদের প্রত্যাশা ছিল, নাটকের ইন্ডাস্ট্রিতে সময়ানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা ফিরে আসুক। যা বর্তমানে বাস্তবায়ন করছি আমরা। আর নতুন বছরে প্রত্যাশা থাকবে, পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে সব অভিনয়শিল্পীর পেশা নিরাপদ হোক।
মামুনুর রশীদ
প্রত্যাশা তো অনেক! গত বছর ছিল সংস্কৃতি অঙ্গনের জন্য হতাশার বছর। তবে আশার কথা, থিয়েটার অঙ্গনে নবীন নির্দেশকদের নতুন অনেক ভালো মঞ্চনাটক এসেছে। অনেক নাট্য উৎসবও হয়েছে। কিন্তু নাটক মিডিয়া অধঃপতিত। চাই ভালো কিছু নতুন নাটক নির্মিত হোক। শৃঙ্খলা ফিরে আসুক।
গোলাম কুদ্দুছ
সংস্কৃতি অঙ্গনের সব সেক্টরে জাগরণ প্রয়োজন। শুধু রাজধানীতে নয়, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংস্কৃতির উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের নাটক, আবৃত্তি বা অনুষ্ঠানের জন্য উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মঞ্চ নেই। নেই রিহার্সেল বা মহড়া কক্ষ। সংস্কৃতিকর্মীদের প্রশিক্ষণের সুযোগ-সুবিধা খুবই কম। প্রত্যন্ত অঞ্চলের সব নিষ্ক্রিয়, আধা-নিষ্ক্রিয় বা সক্রিয় সংগঠনের জন্য স্থায়ী রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দরকার। ব্যক্তিস্বার্থে নয়, সব সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।
শিবলী মুহাম্মদ
উচিত তো অনেক কিছুই! সামনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একশতম জন্মবার্ষিকী। তাই প্রত্যাশা অনেক বেশি। আশা করছি, সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। আমি চাই, নৃত্যের ব্যাপক প্রসার ঘটুক। অপসংস্কৃতি বিমূল হক। শিল্পীরা সচেতন হোক। এখন তো নৃত্যের মধ্যে ব্যাপক হারে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ঢুকে গেছে। আমাদের জন্য অশনি-সংকেত। এসবের ফলে নৃত্যের মৌলিকত্ব নষ্ট হচ্ছে। আমরা বিজাতীয় সংস্কৃতিতে মেতে নিজেদের শিকড় ও ঐতিহ্যকে ভুলে যাচ্ছি। চাই শুদ্ধ নৃত্যের প্রসার ও প্রচার।
লিয়াকত আলী লাকী
সংস্কৃতি একটি দেশের পরিচয়। প্রত্যেকটি মানুষের চেতনা, বোধ, আচার, সংগ্রাম দেশের সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত। তাই সাংস্কৃতিক প্রবাহটা ১৬ বা ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা প্রতিনিয়ত এই শিল্পাঙ্গন নিয়ে অনেক মাস্টারপ্ল্যান করেছি। এখনো করছি। তবে এই দায়িত্ব শুধু সরকারের একার নয়, প্রত্যেকের। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা বাদেও দরকার করপোরেট সেক্টর থেকে উদ্যোগ। আমাদের সব বয়সের জন্য মানবিক ও সৃজনশীল বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। আন্তঃসেবা নয়, দরকার জনসেবা। তবেই এ অঙ্গনের বিকাশ ঘটবে।
লাকী ইনাম
একটা বছর চলে যায়, আরেকটা নতুন বছর আসে। আমরা উৎফুল্ল হই, উজ্জীবিত হই। তবে যে বছর চলে যায়, সে বছরে রয়ে যায় অনেক ব্যর্থতা। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, কি ছিল ব্যর্থতা, নতুন কি করলে শিল্পাঙ্গনে সফলতা আসবে। কি করা প্রয়োজন। তা ফুলফিল করাই সবার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। আমাদের সব হীনমন্যতা বর্জন করে অন্যের সব অর্জনে প্রাণ খোলে প্রশংসা করা উচিত। তাহলে সবাই এই সংস্কৃতি অঙ্গনে মন খোলে কাজ করতে পারবেন। আর সমালোচনা নিতে শিখতে হবে, সমালোচনা মেনে নিয়ে সবাই মিলে-মিশে কাজ করে যেতে হবে।