রবিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

মানুষ আমাকে এখনো এত ভালোবাসে কেন

মানুষ আমাকে এখনো এত ভালোবাসে কেন

ষাট থেকে নব্বইয়ের দশকে বড়পর্দা মাতানো ঢালিউডের বিউটি কুইনখ্যাত জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানা এখনো তেমনই সৌন্দর্যের অধিকারী।  বয়স তাকে একটুও ছুঁতে পারেনি। সম্প্রতি দেশে এসেছেন তিনি। তার মুখোমুখি হয়েছিলেন- আলাউদ্দীন মাজিদ  -    ছবি : নিকিতা

 

বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় শাবানার প্রশ্ন

পৌষের শীতমাখা সন্ধ্যা। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আর ঘরের ভিতরে দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। এই অশ্রু ঢালিউডের কিংবদন্তি অভিনেত্রী বিউটি কুইন শাবানার। এ কান্না আনন্দ, খুশি আর পরম তৃপ্তির। আগেই নির্ধারিত ছিল শুক্রবার সন্ধ্যায় এ কিংবদন্তিকে চোখের মায়ায় বেঁধে নেওয়ার। শাবানার ড্রইং রুমের শোভা আরও বর্ধন করলেন তার স্বামী প্রখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজক ওয়াহিদ সাদিক।

আবেগ সামলে নিয়ে শাবানার প্রশ্ন- আমাকে এখনো মানুষ এত ভালোবাসে কেন? বলতে বলতেই আবার ফুপিয়ে কান্না তার। কোনোভাবে কান্না সংযত করে তিনি বললেন, ‘জানেন প্রতিদিন ভোরে মর্নিংওয়াকে বের হই। সেদিন আমি পার্কে হাঁটছি, একটা মেয়ে এসে আমাকে বলল, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা বলি। আমি বললাম বলো। ও বলল, আপনি আমাদের শাবানা আপা না? আমি হেসে উঠলাম। আমার হাসি দেখে তার উচ্ছ্বাসের মাত্রা আরও বেড়ে গেল। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে উঠল- হ্যাঁ, ঠিকই তো, আপনি আমাদের শাবানা আপা। ওই যে আপনার সেই ভুবন ভোলানো হাসি, বলতে বলতে সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মুখে কোনো কথা নেই। নিজেকে প্রশ্ন করলাম- এতটুকু মেয়ের পক্ষে তো আমাকে চেনার কথা নয়, হয়তো তার মা-বাবা আমাকে চিনতে পারেন। কারণ তাদের সময়ে আমার ছবি মুক্তি পেত। ও বলল, আমি এখনো টিভি, ইউটিউবে আপনার ছবি দেখি। আপনাকে আমার অনেক ভালো লাগে। এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলেন ঢালিউডের এ বিউটি কুইন। আবারও তার কান্নাভেজা প্রশ্নÑ আমাকে এখনো মানুষ এত ভালোবাসে কেন। কারও জন্য তো কখনো কিছু করতে পারিনি। তার কথায় শুধু দেশে নয়, বিদেশের মাটিতেও এমন ঘটনা নিয়মিত ঘটে। বলতে বলতে চোখ মুছে নিলেন তিনি। তার কান্নায় আমাদের চোখও ভিজে উঠল।

 

সংসারের টানে প্রবাসী হয়েছি

ভুবন মোহিনী অভিনেত্রী শাবানার কাছে প্রশ্ন ছিল- কেন হঠাৎ করে প্রবাসী হলেন। সাবলীলভাবে তিনি বলে চললেন, দেখুন কর্মজীবনের পাশাপাশি সবার সংসার জীবন থাকে, আমারও আছে। এক সময় যখন আমার সন্তানরা আমেরিকায় পড়াশোনার জন্য চলে গেল তখন আমার মনে হলো ওখানে তো ওরা ভীষণ একা। আমাকে খুব মিস করছে। মা হয়ে আমি যদি তাদের কাছ থেকে দূরে থাকি তাহলে তারা হয়তো মানসিকভাবে ভেঙে পড়বে। সন্তান আর সংসারের টানে ১৯৯৯ সালে অভিনয় থেকে অবসর নিয়ে আমেরিকায় সন্তানদের কাছে চলে যাই। আমার একটিই প্রতিজ্ঞা ছিল, তিন সন্তানকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলব। সৃষ্টিকর্তা আমার সেই ইচ্ছে পূরণ করেছেন। তার কাছে শোকরিয়া জানাই। বড় মেয়ে ফারহানা সাদিক সুমি এমবিএ, সিপিএ পাস করে চাকরি করত। পরে তার দুই বাচ্চাকে দেখাশোনার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। ছোট মেয়ে সাবরিনা সাদিক বিশ্বখ্যাত ইয়েল ও হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এখন শিকাগোর হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছে। ছেলে শাহীন সাদিক নিউজার্সির রাদগার্স ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ সম্পন্ন করে এখন সেখানকার স্বনামধন্য ব্লুমবার্ড কোম্পানিতে জব করছে। আমার জীবনে অপ্রাপ্তি বলতে এখন আর কিছু নেই।

প্রিয় এ অভিনেত্রী বলেন, বিদেশে থাকলেও মনটা পড়ে থাকে দেশে। বাঙালি বলে গর্ববোধ করি বলেই সময়-সুযোগ পেলে মাতৃভূমি মায়ের কোলে ছুটে আসি। তার কথার প্রমাণ মিলল ড্রইং রুমের শোকেসে থাকা ১১টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও একটি আজীবন সম্মাননার রাষ্ট্রীয় ট্রফি। ট্রফিগুলো যেন বলে দিচ্ছে দেশের প্রতি তার মায়া না থাকলে আজ আমরাও আমেরিকার মাটিতেই থাকতাম।

 

লিডারশিপের অভাব চলচ্চিত্রকে ধ্বংস করেছে

এবার খ্যাতনামা চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এসএস প্রোডাকশন (শাবানা-সাদিক প্রোডাকশন)-এর অন্যতম কর্ণধার প্রযোজক ওয়াহিদ সাদিকের কাছে জানতে চাই, চলচ্চিত্রের বর্তমান দৈন্যদশার কথা। এ প্রশ্নে একদিকে হতাশা অন্যদিকে ক্রোধমিশ্রিত কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন- ‘চলচ্চিত্রে এখন আর লিডারশিপ নেই। লিডারশিপ না থাকায় দৃঢ়তা নিয়ে কেউ কথা বলতে পারছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চলচ্চিত্রশিল্প ও এ অঙ্গনের মানুষের প্রতি খুবই আন্তরিক ও উদার। তার কাছে গিয়ে এ শিল্পের সমস্যা তুলে ধরার মতো লিডার কোথায়? আমাদের সময়েও অনেক সমস্যা ছিল, কিন্তু সত্যিকারের লিডারশিপ থাকলে এসব সমস্যার সমাধান দ্রুত হয়ে যেত। দ্বিতীয়ত, তথ্য মন্ত্রণালয় দিয়ে চলচ্চিত্রের উন্নয়ন হবে না। চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান পরিচালককে দেওয়া হয় বলে এর মিস ইউস হয়। অনুদান দিতে হবে প্রযোজককে। চলচ্চিত্র হচ্ছে শিক্ষিত মানুষের শিল্প। এক সময় নবাবদের হাত ধরেই এর গোড়াপত্তন হয়েছিল। আমাদের সময় কাজী জহির, কামাল আহমেদ, আমজাদ হোসেন, সুভাষ দত্ত, খান আতাউর রহমান প্রমুখের মতো শিক্ষিত নির্মাতারা ছিলেন বলেই কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাণ হতো। এখন ছবি নির্মাণে লগ্নী করতে গিয়ে ধার-দেনা, জায়গা-জমি বিক্রি করতে হয়। অথচ ভারতে ছবি নির্মাণে অর্থলগ্নী করার জন্য ‘ফিল্ম ফাইন্যান্স করপোরেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখান থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়া হয়।

ওয়াহিদ সাদিক আক্ষেপ করে বলেন, দেশে সাড়ে ১২শর মতো সিনেমা হল রেখে গিয়েছিলাম। এখন একশ সিনেমা হলও নেই। এ অবস্থায় একজন প্রযোজক কীভাবে অর্থলগ্নী করবেন। তার বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত আসবে কোথা থেকে। ওই যে বললাম, লিডারশিপের অভাবেই কিন্তুÍ এ অবস্থা চলছে। সিনেমা হল বন্ধের আগেই হল মালিকদের নিয়ে বন্ধের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বন্ধ রোধ করার উপায় বের করতে হবে। ছবি আমদানি করে এ শিল্প টিকিয়ে রাখা যাবে না। স্থানীয় নির্মাণ ও যৌথ প্রযোজনা বাড়াতে হবে। সবার আগে সারা দেশে সিনেমা হল ও সিনেপ্লেক্সের সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, এক্ষেত্রে তিনি সহযোগিতা করবেন। তাহলে আমরা তার সহযোগিতা নিতে পারছি না কেন? আরেকটি বিষয় হলো শিল্পীদের রাজনীতি ও দলাদলিতে জড়ানো উচিত নয়। চলচ্চিত্র ছাড়াও টিভি চ্যানেলগুলোর অবস্থাও তো ভালো নয়। এত বিপুলসংখ্যক টিভি চ্যানেল থাকার পরেও মানসম্মত অনুষ্ঠান পাচ্ছি না কেন।

ওয়াহিদ সাদিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কয়েক বছর আগে আমি একসঙ্গে চারটি ছবি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এর মধ্যে একটি ছিল যৌথ প্রযোজনার। নারগিস আক্তার, শাহীন সুমন, এমবি মানিক প্রমুখ নির্মাতাদের ছবিগুলো নির্মাণের জন্য চূড়ান্তও করে ফেলেছিলাম। পান্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন ড. মনিরুজ্জামান। কিন্তু সহযোগিতার অভাবে বিশেষ করে যৌথ প্রযোজনার ছবির ক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতা আমার এ নির্মাণ থামিয়ে দিয়েছে। সার্বিক অবস্থা যদি অনুকূল হয় তাহলে আবার চলচ্চিত্র নির্মাণে নিয়মিত হবো- এমনটি জানিয়ে এ প্রখ্যাত প্রযোজক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সুদিনের হাতছানির প্রহর গুনলেন। ওয়াহিদ সাদিক বর্তমানে নিউইয়র্ক ও নিউজার্সিতে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।

 

কাজের প্রতি যত্নবান ছিলাম বলেই শাবানা হয়েছি

ঢালিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী শাবানা হতাশা নিয়ে জানতে চান, চলচ্চিত্রের এমন দুর্যোগ হলো কী করে? শুনেছি এফডিসিতে এখন নাকি কোনো কাজ হয় না। অথচ আমাদের সময় কাজের জন্য সেখানে জায়গা পাওয়া যেত না। তিনি উদ্বেগ নিয়ে বলেন, আমার মনে হয় কাজের প্রতি কেউ যতœবান নয়। সবাই সহজেই তারকা হতে আসে আর সহজেই অর্থ-বিত্ত ও খ্যাতি অর্জন করতে চায়। এটিই শুরুতে শেষ হয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ। আমরা যখন কাজ করতাম তখন কাজের প্রতি সবার এতটাই ডেডিকেশন ছিল যে কখনো খাবার খেয়েছি কিনা তাও মনে থাকত না। আমি ১৯৬২ সালে ফ্রগপড়া অবস্থ্য়া সেই ছোট্ট বয়সে অভিনয়ে এসেছিলাম। প্রথম ছবিতে আমাকে মোটা শাড়ি পড়িয়ে একটি নাচের দৃশ্যের জন্য ৭ জন মেয়ের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো। নৃত্য পরিচালক দেবুদা নির্মাতাকে জিজ্ঞেস করলেন- এই মেয়ে এত মোটা শাড়ি পড়ে নাচতে পারবে তো? নির্মাতা কিছু বলার আগেই আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, নাচতে পারব স্যার, আমার কোনো ছোট্ট শাড়ি নেই। নাচতে গিয়ে সেদিন হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু মনোবল হারাইনি বলে আবার উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে একদিন সবার ভালোবাসার শাবানা হলাম। এ ভালোবাসা এখনো বুকের গভীরে অতি যত্নে লালন করছি।

গল্পে গল্পে রাত হয়ে আসে। এবার বিদায়ের পালা। বাইরে তখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। লিফটে উঠলাম আমরা... শাবানা-সাদিকের চোখে-মুখে তখনো গল্পের রেশ লেগে আছে। হাত নেড়ে হাসিমুখে বিদায় জানালেন। অসমাপ্ত গল্পের ইতি টানতে আরেক সুন্দর সময়ের অপেক্ষায় ফিরে এলাম আমরা।

সর্বশেষ খবর