বৃহস্পতিবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

সংগীতে নেই কোনো মান...

সংগীতে নেই কোনো মান...

প্রাণ আর মান হারিয়েছে গান। এখনকার গান আর  শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করতে পারছে না। আগের গানগুলো এখনো গুনগুনিয়ে গায় শ্রোতারা। কালজয়ী হয়ে আছে অসংখ্য গান। দীর্ঘদিন ধরে কৌলীন্য হারিয়েছে দেশীয় গান। কিন্তু কেন? এর কারণ জানিয়েছেন কয়েকজন সংগীতকার। তাদের কথা তুলে ধরেছেন-  আলাউদ্দীন মাজিদ

 

এখন যন্ত্রই প্রধান যন্ত্রণা : কে জি মোস্তফা

গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাব্যময়তা ও মেলোডি। এখন তা কোথায়? আগে গান লিখতে পড়ালেখা করতে হতো। যারা সাহিত্যচর্চা করতেন তারাই গান, গল্প লিখতেন। এখন ইচ্ছা করলেই যে কেউ গীতিকার-গল্পকার হয়ে যেতে পারছেন। বিষয়টি যেন একেবারেই সহজ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে এখন সাহিত্যনির্ভরতাকে বাদ দিয়ে বাণিজ্যকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আগে গান-গল্পে জীবনের ছায়া খুঁজে পাওয়া যেত। এখন তো গান মানে ফান। উচ্চলয়ে যন্ত্র বাজতে থাকে। গানের কথা বোধগম্য হয় না। এখন গানের ক্ষেত্রে যন্ত্রই প্রধান যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনকার গানে মেলোডি, কাব্যময়তা, জীবনবোধ, শিক্ষা এবং গভীরতা বলতে কিছু নেই। তাই এখনকার গান সহজে হারিয়ে যাচ্ছে।

 

অতি আধুনিক হয়ে গেছে : গাজী মাজহারুল আনোয়ার

আগে গান নিয়ে নির্মাতারা গবেষণা করতেন। গানের কারণে সিকোয়েন্স হতো। এখন বলা হয় সিচিউশনের জন্য গান দরকার। এটি আসলেই অবক্ষয়। এখন লেখা, সুর দেওয়া আর গাওয়া যার যার মতো করে চলছে। এক্ষেত্রে ব্যাকরণের ধার ধারা হচ্ছে না। তাই গানের স্থায়িত্ব বা মান বলে কিছুই থাকছে না। এখন সবকিছুই আধুনিক হয়ে পড়ছে। এই আধুনিকতার কারণে সবকিছুতেই পরিবর্তন আসছে। এই পরিবর্তন ভালো হলে তাকে মন্দ বলব না। কিন্তু সংগীতশিল্প এখন তথাকথিত আধুনিকতার ছোঁয়ায় ক্রমেই বিবর্ণ হচ্ছে। এর উত্তরণের জন্য গান নিয়ে গবেষণা

দরকার।

 

যোগ্যতার অভাব প্রকট : সৈয়দ আবদুল হাদী

কোনো কিছু সহজলভ্য হয়ে গেলে তার মান থাকে না। এখন শানাই, সেতার, বাঁশি, তবলা, হারমোনিয়ামসহ কোনো অ্যাকোয়িস্টিক ব্যবহার করা হয় না। সবই কি-বোর্ডনির্ভর হয়ে পড়েছে। এখন যে কেউ ইচ্ছা করলেই গান লিখতে পারছেন। মানে গান লেখা, সুর করা এবং কণ্ঠ দেওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। বর্তমানে গানের মৌলিকত্ব দুঃখজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। তাই এখনকার গান আর শ্রোতাদের মনে স্থায়ী আসন গড়ে নিতে পারছে না। যোগ্য গীতিকার ও সুরকারের অভাব প্রকট। গানের কথা ও সুরে মেলোডি এবং জীবনবোধের অভাব, কথা ও সুরে গভীরতা নেই। মান ও প্রাণহীন গান শ্রোতারা গ্রহণ করবে কেন?

 

গানকে আত্মার কাছে নিতে হবে : শহীদুল্লাহ ফরায়েজী

যে গানে জীবনের নৈতিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে না, পরম সুন্দরের দিকে ধাবিত হওয়ার শক্তি দেয় না, আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান হওয়া যায় না, সে গান ক্ষণস্থায়ী। অমরত্বের জন্য গানকে হৃদয় ও আত্মার সঙ্গে সংযুক্ত করে রচনা করতে হবে। সংগীতেই সংগীতের প্রাণ আর ঐতিহ্য নিহিত। সংগীত হচ্ছে আত্মার খোরাক। মানুষের ভিতর যতদিন আত্মা ও হৃদয় থাকবে ততদিন সংগীত থাকবে। সত্যের কাছে অবস্থান করলে গানের মাঝে প্রাণের ছোঁয়া আসবে। গান একসময় ছিল জীবনমুখী ও  নৈতিকতাপূর্ণ। তাই সে গান মানুষের হৃদয়কে দোলা দিত, তাড়িত করত। সে অবস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে চলচ্চিত্রের গানকে আবারও জীবন ও আত্মার কাছে নিয়ে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

 

গুরুর দীক্ষা জরুরি : খুরশীদ আলম

আগে একটি গান তুলতে কয়েক মাসও সময় লেগে যেত। কথা, সুর, গায়কী নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতো। আর এখন মুহূর্তে লেখা থেকে শুরু করে এক বসাতেই গেয়ে ফেলা হচ্ছে। তাই এসব গান আর প্রাণ ছুঁতে পারছে না। মানে আঁতুড় ঘরেই গানের মৃত্যু হচ্ছে। গান হচ্ছে গুরুমুখী বিদ্যা। সাধনার বিষয়। এখন গুরুর কাছেও কেউ দীক্ষা নেন না। সাধনাও করেন না। তাই সব গানই প্রাণহীন হয়ে পড়ছে। এখন একেবারেই যে ভালো গান হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। এর পরিমাণ নিতান্তই স্বল্প। এই স্বল্পতা দিয়ে এ দেশের ঐতিহ্য হিসেবে সংগীতকে ধরে রাখা যাবে না। একসময় চলচ্চিত্রে গল্পের প্রয়োজনে গান হতো। আর এখন গানের প্রয়োজনে চলচ্চিত্র হয়। এ অবস্থার জন্যই চলচ্চিত্রের গানের অবস্থা নাকাল হয়ে পড়েছে। এ অবস্থার উত্তরণে ওই যে বললাম গুরুর দীক্ষা আর সাধনা অত্যন্ত জরুরি।

 

গান কমিটমেন্টের মাধ্যম : কুমার বিশ্বজিৎ

গান হচ্ছে একটি দেশের সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। এখন যারা গানকে অর্থনৈতিকভাবে প্রমোট করছেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি ব্যবসায়িক হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তাদের কথায় গান হচ্ছে খাওয়া না খাওয়ার বিষয়। এ দৃষ্টিভঙ্গি সংস্কৃতির জন্য খুবই নেগেটিভ। গান দুই ধরনের, একটি হচ্ছে হৃদয় স্পর্শ করা অন্যটি কানে শোনা। কানে শোনার গান মানে এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। এখনকার অধিকাংশ গানই কানে শোনার গান। যারা এক্ষেত্রে ইনভেস্ট করেন তারা বিশ্বায়নের দোহাই দিয়ে অন্য দেশের গানের অনুকরণ করছেন। এতে আমাদের গানের স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য ধ্বংস হচ্ছে। সিনিয়র সংগীতকারদের অনেকেই এখন আর নেই। তাই এসব দেখার মানুষের অভাবও রয়েছে। গানের কথার মধ্যে যে কাব্যময়তা থাকার কথা তা এখন কোথায়? সংগীত একটি জাতির পরিচয় বহন করে। ভালো গান আমাদের দেশের সম্পদ। সংগীতকার ও ব্যবসায়ীদের নিজের দিকে না তাকিয়ে দেশের দিকে তাকাতে হবে। বর্তমান সময় জীবনের জটিলতার কারণে অন্ন, বস্ত্রসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকারের পর ৮ম স্থানে চলে গেছে গান। আগে গান কেন জনপ্রিয় হতো তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা দরকার। যাতে এ দেশের গান আবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্থায়িত্ব পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। মনে রাখতে হবে গান হচ্ছে সৃষ্টিশীল ও কমিটমেন্টের একটি মাধ্যম। তাই গানকে সে আঙ্গিকেই এগিয়ে নিতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর