শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

মৌসুমেও অস্তিত্ব সংকটে যাত্রাপালা

মৌসুমেও অস্তিত্ব সংকটে যাত্রাপালা

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃৃতি যাত্রাশিল্প। এই শীতে যাত্রার ভরা মৌসুমেও উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালা  মঞ্চস্থের দেখা নেই। তাই যাত্রাশিল্পের দুরবস্থা নিয়ে যাত্রাসংশ্লিষ্টরা খুবই চিন্তিত। যাত্রাশিল্পের সংকট নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন-  পান্থ আফজাল

 

বিনোদনের অন্যতম উৎস যাত্রাপালা। বাঙালি জাতির গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে হাজার বছর ধরে মিশে আছে যাত্রা গান। জাতির আদি সংস্কৃতি হিসেবে এসেছে যাত্রা। আর এ যাত্রা থেকেই এসেছে নাটক, থিয়েটার ও সিনেমা। এই আদি সংস্কৃতি যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। শীতকাল যাত্রাপালার ভরা মৌসুম সত্ত্বেও বিশাল আকারে যাত্রাপালার মঞ্চায়ন নেই। হাজার বছরের এই নাট্য-ঐতিহ্য যাত্রার সূচনা বাংলার শৈব ও সূর্যপূজার মাধ্যমে। যে পূজার প্রচলন করেছিলেন বাংলার ভ্রাম্যমাণ নৃত্যশিল্পীরা। ষোড়শ শতকে সূর্যের দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরুর মুহূর্ত থেকে অনুষ্ঠিত হতো সূর্যপূজা; সূর্যের গমন থেকে যাত্রার উৎপত্তি। এ যাত্রা শুরু হতো শ্রীকৃষ্ণের রথযাত্রার পর থেকে দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিন পর্যন্ত। এ সময় পালা রচনা এবং মহড়া অনুষ্ঠিত হতো। প্রাচীন নাট্যধারায় দুই ধরনের নাটকের সন্ধান পাওয়া যায়, যার একটি মঞ্চস্থ হতো উন্মুক্ত মঞ্চে অন্যটি প্রেক্ষাগৃহে। বিভিন্ন সময় এর শিল্পরীতি পরিবর্তিত হলেও যাত্রা বাংলার ঐতিহ্য হিসেবে আজও রয়ে গেছে জনপদের মুক্তমঞ্চে। তবে আধুনিকতার নামে অন্যের সংস্কৃতির হাওয়া লেগে যাত্রার চরিত্রধর্ম বদলে গেছে। যাত্রা পেশাদারি শিল্প মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে নানারকম ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

এম এ মজিদ

(অভিনেতা, পালাকার ও সাধারণ সম্পাদক, যাত্রা পালাকার পরিষদ)

‘এখন তো যাত্রাপালার মৌসুম শেষের পথে। দুর্গাপূজার সপ্তমী থেকে যাত্রার মৌসুম শুরু আর এপ্রিলের ১৩ তারিখ পর্যন্ত এর শেষ ধরা হয়। এই মৌসুমে প্রায় ২০-২২টি দল বিভিন্ন স্থানে অংশগ্রহণ করেছে। উত্তরবঙ্গের মেলাকেন্দ্রিক কিছু যাত্রাপালা এখনো চলছে। ঠাকুরগাঁও ও নওগাঁতে একটি করে যাত্রা প্যান্ডেল রয়েছে। এগুলো ব্যক্তি উদ্যোগে। নওগাঁতে ‘আনন্দ অপেরা’ আর ঠাকুরগাঁওয়ে ‘নিউ রংধনু অপেরা’। নেত্রকোনায় ‘সীমা অপেরা’ রয়েছে। সরকারিভাবে যাত্রা বন্ধ, এমন নিয়ম নেই। আসলে আয়োজকদের উদ্যোগের অভাবে যাত্রাশিল্প এখন বন্ধের পথে। এমন অনেক আয়োজক রয়েছেন যারা যাত্রাকে সামনে রেখে অশ্লীলতা প্রদর্শন ও অন্যান্য ব্যবসার জন্য ব্যস্ত থাকেন। যে কারণে অনেক সময় প্রশাসন অনুমতি দেয় না। সুস্থ ও সুন্দর আয়োজন হলে প্রশাসন কেন দেবে না! যাত্রাশিল্পের স্থায়ী নীতিমালা প্রণয়নের পর এই শিল্পটিকে শিল্পকলা একাডেমির ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। তাই এর ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব শিল্পকলার। ২০১৩ সালে নীতিমালা পাসের পর থেকে শিল্পকলা দেশব্যাপী কিছু যাত্রা উৎসবের আয়োজন করেছে। ১১১টি দলকে নিবন্ধন দেওয়ার পর আরও ৬টি দল নতুন করে নিবন্ধিত হয়। যাত্রাপালায় অশ্লীল কিছু হলে শিল্পকলার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাকে জানানো হয়। প্রশাসন কিন্তু অনুমতি দিয়ে থাকে সুস্থ যাত্রাপালার। তবে কিছু ভুল বোঝাবুঝির কারণে যাত্রাপালার নিয়মিত আয়োজন ব্যাহত হচ্ছে।

 

ড. তপন বাগচী

(কবি, গীতিকার ও যাত্রা গবেষক)

‘যাত্রাশিল্পে সংকটের অন্যতম হলো রাজনৈতিক কারণ। যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করতে জেলা বা থানার প্রশাসনের অনুমতি নিলেই হয়। এখানে প্রশাসনিক কোনো বাধা নেই। তবে আইনশৃঙ্খলা কমিটির কারও কারও আপত্তির কারণে যাত্রা প্রদর্শনী ব্যাহত হয়। অনুমতি দেওয়া হয় না তখন। যেখানে ওয়াজ-মাহফিল করতে অনুমতি থাকে, সেখানে যাত্রার অনুমতি মেলে না। আর আরেকটি সংকটের কারণ হচ্ছে, আগের মতো মেলায় লোক যাত্রা দেখতে আগ্রহী হয় না। মানুষের মন-মানসিকতা নেই যাত্রা দেখার। প্রযুক্তির বহুবিধ ব্যবহারে মানুষ অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে। যাত্রা তেমন করে টানে না। যেখানে সিনেমার প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ, সেখানে যাত্রাশিল্প কীভাবে বেঁচে থাকবে? হলে গিয়ে ছবি দেখারই তো মানসিকতা নেই, যাত্রা দেখবে কীভাবে! শিল্পকলায় নীতিমালায় একটা প্রস্তাবনা ছিল প্রত্যেক জেলায় একটি করে উন্মুক্ত মঞ্চ হবে। যেখানে যাত্রার সান্ধ্যকালীন আয়োজন হবে মৌসুমে।’

বিভিন্ন অবহেলা আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে এই শিল্প। বিলুপ্তির পথে এখন লোকজ সংস্কৃতির বাহক যাত্রাশিল্প। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত এসব লোকজ যাত্রাপালার সোনালি যুগ ছিল। একসময় যাত্রাপালায় অভিনয় করত দেশের নামকরা সুপারস্টার। নামকরা শিল্পী, কলাকুশলী দ্বারা এই যাত্রাপালা গঠন করা হতো। যাত্রা দলে দেশজুড়ে হাজারো শিল্পী, কলাকুশলী রয়েছে যারা পেশা ছাড়া অন্য পেশা জানে না। ফলে তাদের বড়ই দুর্দিন। ধর্মীয় গোঁড়ামি, জঙ্গিবাদের উত্থান, নাশকতা, মোড়ে মোড়ে টেলিভিশন, সিনেমা, ডিস অ্যান্টেনার মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের নগ্ন ছবির ছড়াছড়ির কাছে নুয়ে পড়েছে বাঙালি জাতির লোকজ সংস্কৃতি।

সর্বোপরি মালিকদের আর্থিক দৈন্যতাও এ শিল্পের ভরাডুবি শুরু হয়েছে। এই লোকজশিল্প বাঁচিয়ে রাখতে সবাই এক হয়ে কাজ করলে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

সর্বশেষ খবর