শুক্রবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
অভিযোগের তীর কোন দিকে?

দর্শকশূন্য নাট্যমঞ্চ

দর্শকশূন্য নাট্যমঞ্চ

এমনিতে রাজধানীতে মঞ্চনাটক প্রদর্শনী নিয়ে নানা সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে শিল্পকলার নন্দনমঞ্চ-খোলামাঠে চলা সাংস্কৃতিক আয়োজন, পিঠা উৎসবসহ নানা আয়োজন নাটক প্রদর্শনীকে করছে ব্যাহত। এসব সংকট ও জটিলতার ফলাফল দর্শকশূন্য নাট্যমঞ্চ। মঞ্চ থিয়েটার কেন দর্শকশূন্য ও তার থেকে উত্তরণের পথ নিয়ে লিখেছেন -পান্থ আফজাল

 

যেসব সংকট : অনেক আগে থেকেই আমাদের মঞ্চে বিদেশি নাট্যকারের নাটক অনুবাদ বা রূপান্তর করে পান্ডুলিপি করার একটা ধারা চলে এসেছে। সম্প্রতি সে জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে মৌলিক ও বিষয়বৈচিত্র্যের কিছু পা-ুলিপি আমাদের মঞ্চাঙ্গনকে উৎসাহিত করলেও এখনো দেশীয় মৌলিক পান্ডুলিপি সংকট রয়েই গেছে। আর মহড়াকক্ষের সংকট যেন কাটছেই না। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় নাট্যশালায় রয়েছে মাত্র চারটি মহড়াকক্ষ। রাজধানীতে এত এত দলের জন্য এত কম সংখ্যক মহড়াকক্ষ প্রধান সমস্যার মধ্যে একটি। এ কারণে কোনো দলই নিয়মিত নাট্যচর্চা করতে পারছে না। মঞ্চনাটক প্রদর্শনীর জন্য যেমন ভালো পা-ুলিপি, নাট্যকার, নির্দেশক বা মহড়াকক্ষ জরুরি; তারও আগে প্রয়োজন মিলনায়তন। জাতীয় নাট্যশালার মঞ্চে নাটক ছাড়া অন্য কোনো অনুষ্ঠান করতে দেওয়ার সরকারি নীতিমালা অনেক দলের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর মিলনায়তনের ভাড়া কমানো জরুরি বলে অনেকে মনে করেন। প্রতিটি দল মঞ্চনাটক নিয়মিত মঞ্চস্থ করতে চায়। সেক্ষেত্রে হল বরাদ্দ নিয়ে রীতিমতো চলে কাড়াকাড়ি। এটা রীতিমতো নিয়মিত সমস্যায় পরিণত হয়েছে। হল বরাদ্দ কমিটি এটি নিয়ে উদাসীন বলা চলে। অন্যদিকে প্রশাসনও তেমন করে উদ্যোগী হচ্ছে না। ছোট দলগুলোকে নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ করতে হলে যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হয় বার বার। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সদস্যভুক্ত নাট্যদলগুলোর মধ্যে থিয়েটার মঞ্চে বড় কয়েকটি দলেরই প্রভাব বেশি দেখা যায়। ছোট দলগুলোর প্রতিভা ও সাংগঠনিক সফলতা থাকা সত্ত্বেও তেমন করে পাচ্ছে না মঞ্চ আর মহড়াকক্ষ। মঞ্চস্থ না করতে পারার কারণে নাট্যকর্মীরা হতাশ হয়ে থিয়েটারে নিয়মিত চর্চায় আসতে আগ্রহী হচ্ছেন না। স্বাধীনতার পর কিছু বিচক্ষণ নির্দেশক-নাট্যকারের মসৃণ পথ ধরে আমরা পেয়েছি তারুণ্যদীপ্ত কর্তৃক নাট্যনির্মাতা-নাট্যকারদের। অভিনয়ে, নির্মাণে, কলা-কৌশলীর জায়গাতেও আধুনিকায়নের স্পর্শে পরিবর্তন এসেছে। তবে তরুণ নাট্যকার ও নির্মাতারা তাদের কাজ অনুযায়ী মূল্যায়িত হচ্ছেন না। নেই নাট্যকর্মীদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভাতা। এটা নাট্যকর্মীদের থিয়েটার চর্চায় নিরুৎসায়িত করছে। আধুনিকায়নের এই সময়েও রাজধানীতে নেই জোনভিত্তিক মঞ্চ। নাটক হয়ে গেছে শিল্পকলা কেন্দ্রিক।

যত অভিযোগ : শেষ হচ্ছে একুশ দিনব্যাপী বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব ২০২০। উৎসবে ৬৪ জেলার সাংস্কৃতিক দলের নিয়মিত আয়োজন ছাড়াও খোলা মাঠে বসেছে বিভিন্ন পিঠার স্টল। উৎসবটি একই সঙ্গে চলছে শিল্পকলা একাডেমির নন্দনমঞ্চ ও খোলা মাঠে। তবে এই দীর্ঘদিনব্যাপী আয়োজন শিল্পকলা একাডেমিতে নিয়মিত নাট্য মঞ্চস্থকে ব্যাহত করছে বলে বেশির ভাগ দল ও নাট্যকর্মীদের অভিযোগ। কিছুদিন আগে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় ছিল ঢাকা থিয়েটারের ‘পুত্র’ নাটকের প্রদর্শনী। তবে খোলা মাঠ ও নন্দনমঞ্চে চলা সাংস্কৃতিক উৎসব এই নাটক মঞ্চস্থকে ব্যাহত করে বলে ফেসবুকে তীব্র প্রতিবাদ জানান শিমূল ইউসুফ। তিনি ফেসবুকে নাটক মঞ্চস্থের আগে স্ট্যাটাস দিয়ে লিখেন, ‘ঢাকা থিয়েটারের ‘পুত্র’ হবে এখন, সন্ধ্যা ৭টায়। নাটকের চরিত্রের সঙ্গে মনসংযোগ করার কোনো উপায় নেই! টাকা খরচ করে নাটক দেখবে কেন মানুষ? যদি বিনা পয়সায় মুক্তমঞ্চ নামক একটি উন্মুক্ত জায়গায় ফুল ভলিউমে গান, বক্তৃতা, কবিতা, নাচ তার সঙ্গে গান দেখতে পায়! আমি জানি না এইভাবে কোনো শিল্প বেঁচে থাকবে কিনা! অনুষ্ঠান যদি শিল্পকলা একাডেমির করতেই তবে সেটা ৪টা থেকে ৭টা অবধি হতেই পারে। তবে নাটকের মানুষগুলো অন্তত প্রোডাকশন কস্টটা উঠাতে পারে। শিল্পকলার লিয়াকত আলী লাকী কী মনে করে মঞ্চনাটকের এ সময়টা বেছে নিলেন? জানি না। তিনিও একটি নাট্যদলের প্রধান! স্বাধীনতার ফসল এই মঞ্চ নাটকটাকে ধ্বংস করার জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? আজ এইক্ষণে আমি আমার অবস্থান থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানাই। পুত্র নাটকে যারা চরিত্র রূপদান করেন তারা সবাই অপমানে অভিনয় করছে আর কাঁদছে মাত্র ২৩ জন দর্শকের সম্মুখে।’ এদিকে তার স্ট্যাটাসে কমেন্টে সহমত পোষণ করে সেদিনই ‘বিদ্রোহী কণ্ঠ’ ইশরাত নিশাত মন্তব্য করেছিলেন, ‘মনে আছে এ বিষয়ে আমরা কয়েকজন মিলে শিল্পকলায় একটা স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান করেছিলাম? সেখানে ৫০০ স্বাক্ষরসহ একটি অনুরোধ রাখা হয়েছিল মন্ত্রণালয়ে, মন্ত্রী বরাবর, সে সময় আসাদুজ্জামান নূর ছিলেন মন্ত্রী, তিনি শিল্পকলার মহাপরিচালককে বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নিতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি একটি সুতো পরিমাণ ব্যবস্থাও নেননি। নাট্য সম্পৃক্ততা আছে বলেই কি তিনি প্রশাসনের স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারবেন? উনাদের নাটকের চেয়ে আরও কিছু বেশি হিসাব মেলাতে হয়, এটা তো রাজনৈতিক পদায়ন, কি অদ্ভুত কারণে এখানে মন্ত্রীর নির্দেশ মানা অন্যায় বোঝা মুশকিল, আমরা নাট্য কর্মীরাও নিজেদের অধিকার আদায় করতে ভুলে গেছি, পদলেহন তো পদাধিকারীদের যোগ্যতা, আমাদের এত দ্বিধা কীসের!!! এরপর আরেক নাট্যকর্মী মোমেনা চৌধুরী লেখেন, ‘শিল্পকলায় আগে গেলে মন ভালো হতো। এখন মন খারাপ হয়। তাই খুব কম যাই।’

এসব অভিযোগ বিষয়ে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘আমিও মঞ্চে অভিনয় করি। তবে শুরুর দিকে এই অনুষ্ঠানের সাউন্ড ও প্রজেকশন কন্ট্রোলে ছিল না। পরে কিন্তু কোনো সমস্যাই হয়নি।

যখন শুনি সাউন্ডের জন্য নাটক মঞ্চস্থ করতে সমস্যা হচ্ছে, তখন সাউন্ড কন্ট্রোল করা হয়। আর অনুষ্ঠান তো শুধু নন্দনমঞ্চেই হয় না, খোলা মাঠসহ বিভিন্ন স্থানেই হয়। মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠান হবেই। এর দর্শক সাধারণ; তারা নাটকের দর্শক নন। যারা নাটকের দর্শক, তারা কিন্তু নিয়মিত নাটক দেখে। এতে অবশ্য সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিনটি মঞ্চেই নাট্য প্রদর্শনীতে নাটকের দর্শকরা যায়। স্বীকার করছি, কিছুটা ব্যাঘাত মাঝে মধ্যে হয়। সাউন্ড মাথায় রাখলে এমন সমস্যা হওয়ার কথা না।

তবে একসঙ্গে এতো মঞ্চ থাকলে ব্যাঘাত একটু ঘটতেই পারে। জাতীয় নাট্যশালায়ও নিয়মিতভাবে নাটক মঞ্চস্থ হবে আর আমাদের কিন্তু সাংস্কৃতি বিনির্মাণে সর্বত্র ছড়িয়ে যেতে হবে।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর