শনিবার, ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

নিজেকে অভিনেতা দাবি করতে কষ্ট হয়

নিজেকে অভিনেতা দাবি করতে কষ্ট হয়

বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তিতুল্য চলচ্চিত্রকার আলমগীর। ১৯৭২ সালে অভিনয়ে এসে প্রায় চার দশকে ২৩০টি ছবিতে অভিনয়, সাতটি ছবি নির্মাণ এবং নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। এই চলচ্চিত্রকারের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তার ব্যক্তি ও চলচ্চিত্র জীবন নিয়ে ওঠে আসা কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদপান্থ আফজাল

কেমন আছেন?

জি, ভালো আছি।

 

চলচ্চিত্র নির্মাণ ও অভিনয়ে আপনার সাফল্য ঈর্ষণীয়। অভিনেতা হিসেবেই সর্বোচ্চ ৯ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, নির্মাতা হিসেবে একাধিকবার এবং সর্বশেষ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পেলেন, অনুভূতি কেমন?

অবশ্যই ভালো। আমার নির্মিত সর্বশেষ ‘একটি সিনেমার গল্প’ ছবিটি ৫টি জাতীয় চলচ্চিত্র পেয়েছে। ছবিটি কিন্তু  বিদেশেও প্রশংসিত হয়েছে। আসলে নির্মাণ এবং অভিনয়, কোনোটিই আমার কাছে কষ্টের নয়। তবে অভিনয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এগুলো হলো ক্রিয়েটিভ বিজনেস। তারপরও নিজেকে অভিনেতা দাবি করতে খুব কষ্ট হয়। আমি নিজেকে অভিনেতা হিসেবে মূল্যায়ন করতে গেলে কোনো রকমে টেনেটুনে পাস মার্ক পাব। অভিনেতা দাবি করার মতো অবস্থা আমাদের দেশের কোনো শিল্পীর আছে কিনা জানি না। আমার তো নেই। অভিনয়ের বিশালতা এবং এর ব্যাপ্তি এত বড় যে, তা একজনের পক্ষে একজনমে ধারণ করা সম্ভব নয়। এর জন্য হয়তো শত জনম লাগবে। সেটি তো পাব না। কারণ জনম তো একটিই। নির্মাতা হিসেবে আমি কখনই হ্যাপি নই। হ্যাঁ, আমার নির্মিত ছবিগুলো হিট হয়েছে। পুরস্কৃত হয়েছে। ছবি হিট বা পুরস্কৃত হবে এমন আশা নিয়ে তা নির্মাণ করি না।

 

আবার কখন নির্মাণে আসছেন?

আমি তো দুই বছর পরপর ছবি নির্মাণ করি। ভালো গল্প এবং চিত্রনাট্যকারের অভাব রয়েছে। চলচ্চিত্রের জন্য গল্প লেখার মানুষ নেই বললেই চলে। আর আহ্বান করলে দেখা যাবে, সেগুলো নাটকের গল্প। নাটকের গল্প আর ছবির গল্প সম্পূর্ণ আলাদা। চলচ্চিত্র হচ্ছে একটি বিস্তৃত পরিসর। এটিকে ধারণ করার মতো মেধা এখন কজনের আছে, বলুন।

 

এফডিসি ঘরানার ছবিকে মেইনস্ট্রিম আর অন্যগুলোকে অবস্ট্র্যাক্ট বলে অনেকে, আপনার মতামত কী?

ব্যাসিক্যালি মেইনস্ট্রিম একটা ফ্যাক্ট। আসলে ছবির ক্যাটাগরি হলো দুই ধরনের। একটি ভালো ছবি আরেকটি খারাপ ছবি। যেটি জনগণ একসেপ্ট করে সেটি ভালো আর যেটা রিজেক্ট করে সেটি হচ্ছে খারাপ ছবি। আসলে মেইনস্ট্রিম ও প্যারালাল ছবি পৃথিবীর সব জায়গায়ই আছে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

 

বর্তমানে সিনেপ্লেক্সে দর্শক ছবি দেখতে আগ্রহী হচ্ছে, তাহলে সিনেমা হল ছবির ব্যর্থতার জন্য দায়ী?

সিনেপ্লেক্সে মধ্য এবং নিম্নবিত্তের দর্শক ছবি দেখতে পারে না। কারণ টিকিটের উচ্চমূল্য তাদের নাগালের বাইরে। এদেশে সিনেপ্লেক্স আসলে  তৈরিই হয়েছে উচ্চবিত্তের জন্য। এভাবে তো চলচ্চিত্র শিল্পের উত্তরণ হবে না। একটি ছবির সফলতার জন্য সব শ্রেণির দর্শক দরকার। শুধু উচ্চবিত্তের দর্শক দিয়ে ছবির ব্যবসায়িক স্বার্থরক্ষা সম্ভব নয়।

 

চলচ্চিত্র কি শুধুই বাণিজ্যিক মাধ্যম?

চলচ্চিত্র পুরোপুরি বাণিজ্যিক মাধ্যম নয়। এটি একাধারে শিল্প এবং বাণিজ্যের সংমিশ্রণ। একটিকে বিসর্জন দিয়ে আরেকটি নয়। এটি যে একাধারে শিল্প ও বাণিজ্যিক মাধ্যম, ছবির সফলতার জন্য প্রযোজকদের সবার আগে তা মনে রাখতে হবে।

 

এবার ব্যক্তিগত বিষয়ে আসি। মানুষ হিসেবে আপনি কেমন?

হুম, আমি খুব গোছালো একজন মানুষ। সুখ একটি আপেক্ষিক শব্দ। সুখের অর্থ কী? এর উত্তর কেউ জানে না। সুখের কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। কারও জীবনে পূর্ণ প্রাপ্তি আসে না। পূর্ণতার জন্য শুধুই সাধনা করে যেতে হয়। আরেকটি কথা, অনেকেই মনে করেন আমি ভীষণ রাশভারী মানুষ। আসলে কিন্তু তা মোটেও ঠিক নয়। আমি সময় উপযোগী একজন মানুষ। যখন যেখানে যেমন পরিস্থিতি থাকে আমি সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি। মানুষের সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারি। আমার সম্মানবোধ অনেক বেশি। যেখানে আমার সম্মান থাকবে না মনে হয়, সেখান থেকে সবসময় দূরে থাকি।

 

জীবনে পূর্ণতার দেখা পেয়েছেন?

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং দর্শকপ্রিয়তা- দুটিই আমি পেয়েছি। দুটি দুই রকম অর্থ বহন করে। দর্শকের ভালোবাসা হলো অনুপ্রেরণা। এতে কাজ নিয়ে পথ চলা সহজ হয়। জনগণ ছাড়া ব্যাসিক্যালি আমরা শূন্য। আর জাতীয় স্বীকৃতি প্রতিটি শিল্পীর পরম কাম্য। প্রত্যেকটি শিল্পীর জীবনে এই স্বীকৃতি বিশাল অবদান রাখে, দায়বদ্ধতা বেড়ে যায়। কিন্তু জনগণই আমাদের সবকিছু। এসব দিক বিচার করলে আমার আর চাওয়ার কিছু নেই। মানে আমার জীবন শতভাগ পূর্ণতায় পরিপূর্ণ।

 

সাফল্যের ছোঁয়া কীভাবে পেলেন?

পৃথিবীতে কোনো জিনিসই সহজ এবং সস্তা নয়। যে কোনো ক্ষেত্রে সফলতা পেতে সাধনার বিকল্প নেই। কাজ করতে হবে সিনসিয়ারলি। ছোটবেলা থেকে একটি জিনিস জেনেছি, আর তা হলো- গাছ যত বড় হয় গাছের ডালপালা তত ঝুঁকে যায়। কিন্তু আমরা যত বড় হই ততই যদি বড়াই করতে থাকি, তাহলে সফল হতে পারব না। সাধনা হলো সাফল্যের সবচেয়ে বড় সোপান। সাধনা, একাগ্রতা, নিষ্ঠা- এসব কিছু মিলিয়ে হলো সাফল্য। এটি সবার এবং সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সাধনা করতে পেরেছি বলেই হয়তো সাফল্যের ছোঁয়া পেয়েছি।

 

নতুনদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

নতুন প্রজন্মকে বলব তোমরা সাধনা কর। চলচ্চিত্রকে আগে  ভালোবাস আর নিজের মধ্যে ধারণ কর। চলচ্চিত্র এমন একটি        জায়গা যেখানে অর্থের পেছনে ছুটলে নিজে এবং চলচ্চিত্র ধ্বংস হবে। আর চলচ্চিত্রকে সাধনা ও ভালোবাসা দিয়ে ধারণ করলে অর্থ তোমাদের  পেছনে ছুটবে। এতে তোমাদের ও চলচ্চিত্র উভয় ক্ষেত্রে উন্নয়ন হবে।

সর্বশেষ খবর