বুধবার, ৪ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

ছবির সেট থেকে পালাতে চেয়েছিলাম

ছবির সেট থেকে পালাতে চেয়েছিলাম

আরিফা পারভিন জামান মৌসুমী। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের তুমুল জনপ্রিয় একজন অভিনেত্রী। ১০ বছরে রেকর্ডসংখ্যক ১০০ ছবিতে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ছোট পর্দার বেশকিছু নাটক ও বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। চলচ্চিত্রকার মৌসুমীর চলচ্চিত্র ও ব্যক্তি জীবনের কথা তুলে ধরেছেন-  আলাউদ্দীন মাজিদ

 

চলচ্চিত্রে আসার গল্পটা নতুন করে শুনতে চাই।

হুম, চলচ্চিত্রে অভিনয় করব এমন ইচ্ছা তো আমার ছিলই, তবে মেজ বোন স্নিগ্ধা এ ব্যাপারে উৎসাহ জুগিয়েছে বেশি। ১৯৯০ সাল। তখন আমি কলেজে পড়ি। ইন্টারমিডিয়েট শেষ করলাম। আনন্দ বিচিত্রা ম্যাগাজিনের বিউটি কনটেস্টে সেরা হলাম। এরপরই মডেলিংয়ে অফার পেলাম।

 

মডেলিংয়ে অফার পাওয়াটা কীভাবে হলো?

প্রখ্যাত বিজ্ঞাপন নির্মাতা শাকিব লোহানী সাহেব স্কয়ার গ্রুপের তিনটি টিভিসির জন্য অফার দেন। মডেলিংয়ের জন্য আমার প্রথম ছবি তোলেন আলোকচিত্রশিল্পী  চঞ্চল চৌধুরী ভাই। অভিনেতা ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা আফজাল ভাই ও অনন চৌধুরী আমার ছবি দেখে তিনটি বিজ্ঞাপনের জন্য আমাকে চূড়ান্ত করেন। তাদের বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ক্যাসেন্ড্রা লিমিটেড।

 

মডেলিংয়ের ব্যাপারে পরিবারের উৎসাহ ছিল?

আব্বা-আম্মা কোনোভাবেই রাজি ছিলেন না। শাকিব লোহানী সাহেব অনেক বুঝিয়ে তাদের রাজি করান।

 

এরপর চলচ্চিত্রে এলেন?

হ্যাঁ, আমার বিজ্ঞাপনগুলো দেখে চলচ্চিত্র নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান ভাই আমাকে প্রস্তাব দেন ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য।

প্রথম প্রস্তাবেই রাজি হয়ে গেলেন?

হ্যাঁ, খুব আনন্দের সঙ্গেই রাজি হলাম। কারণ ছবিটি ছিল বলিউডের ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ ছবির রিমেক। বলিউডের এই ছবিটি ছিল আমার খুব প্রিয়। কমপক্ষে একটানা ৭ বার ছবিটি দেখেছিলাম। এই ছবিরই রিমেকে কাজ করব বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, লোভও সামলাতে পারছিলাম না। অন্য ছবি হলে হয়তো করতাম না।

 

পারিবারিক সম্মতি ছিল?

না, মোটেও নয়। আব্বা-আম্মা বললেন, কি ব্যাপার বললে শুধু বিজ্ঞাপনে কাজ করবে, এখন আবার ছবি কেন? এটি হবে না। শেষ পর্যন্ত সোহান ভাইসহ অনেকে আব্বা-আম্মাকে বুঝিয়ে রাজি করালেন।

 

প্রথম চলচ্চিত্রের ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর অনুভূতি কেমন ছিল?

আমি তো কিছুই করতে পারছিলাম না, আমার বয়স তখন মাত্র ১৯ বছর। অভিনয় সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। ডাবিংও করতে পারছিলাম না, রীতিমতো কান্নাকাটি করতাম। আমার কো-আর্টিস্ট সালমান শাহ, অভিনেতা রাজীব, জাহানারা আহমেদ, আহমেদ শরীফ, ক্যামেরাম্যান মিন্টু ভাইসহ সবাই সাহস দিলেন, সহযোগিতা করলেন। বিশেষ করে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দ মেলার পক্ষ থেকে আমাকে  প্রচ- সহযোগিতা করা হলো। এতে আমি কোনোরকমে কাজটি শেষ করতে পেরেছিলাম।

 

ছবিটি সুপার হিট হওয়ার পর রাতারাতি স্টার হয়ে গেলেন, আপনার নামে মানে ‘মৌসুমী’ শিরোনামে একটি ছবিও নির্মাণ হয়েছিল, তখনকার অনুভূতি কেমন ছিল?

তা তো বলতে পারব না, কারণ কিছু বোঝার মতো বয়স তখন আমার হয়নি। এও বুঝতাম না হিট বা ফ্লপ কি জিনিস। বলতে পারেন ওই সময়গুলো ট্রমার মধ্যে চলে যেত। যা কিছু হয়েছে ওপরওয়ালার ইচ্ছায় হয়েছে, সব ছিল স্বপ্নের মতো, সব কিছুই যেন আমার মাথার ওপর দিয়ে গেছে।

 

এরপর অভিনয় জার্নিতে কীভাবে এগুলেন?

অনেক স্ট্রাগল করে এগুলাম। একটানা এত কাজ হাতে এসে গেল যে, কাজ করতে গিয়ে জ্বর এসে যেত। সেট থেকে পালাতে চাইতাম। ছবির শিডিউল দেওয়া সত্ত্বেও শুটিংয়ে যেতে চাইতাম না। বুঝতাম না যে, শিডিউল দিয়ে কাজ না করলে নির্মাতার ক্ষতি হবে। আবার আব্বাকে ভয়ে এই কষ্টের কথা বলতাম না, কারণ তিনি তো চাননি আমি অভিনয় করি। আম্মাকে বলতাম, আম্মা বুঝিয়ে পাঠাতেন।

 

অভিনয় সম্পর্কে ভালো করে বুঝতে পারলেন কখন?

যখন ওমর সানীকে বিয়ে করলাম তখন। ও আমাকে সুন্দর করে বোঝাল। সাহস, শক্তি আর ধৈর্য জোগাল। ধীরে ধীরে আমার মধ্যে এ ব্যাপারে শক্তি সঞ্চয় হলো, অভিনয় থেকে নির্মাণেও এলাম। এ জন্য স্বামী ওমর সানীর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

 

চলচ্চিত্র জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি আছে কী?

অপ্রাপ্তি তো থেকেই যায়, দর্শকদের আকাশছোঁয়া ভালোবাসা, একাধিকবার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছি। তারপরও ভাবছি আমাদের চলচ্চিত্র জগৎ এখন এভাবে ডুবে গেল কেন?

চলচ্চিত্রের সুদিন আর নেই, এ কথা ভাবতে খুব কষ্ট হয়। এমনটি কখনো চাইনি। এটিই বড় অপ্রাপ্তি।

 

ছবি নির্মাণ কমেছে, কেন?

এর অনেক কারণ রয়েছে। যেমন- অনেকে ছবি নির্মাণ করে দর্শক আর সিনেমা হলের অভাবে লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত আনতে পারছেন না। অনেকে আবার দর্শক রুচি বুঝতে পারছেন না। এ জন্যই ছবি নির্মাণ কমে গেছে।

 

এ অবস্থার উত্তরণ কীভাবে সম্ভব?

মানসম্মত ছবি নির্মাণ বাড়াতে হবে। সিনেপ্লেক্সের সংখ্যাও বাড়ানোও জরুরি। মোবাইলেও এখন ছবি দেখা যায়। এ অবস্থায় সময়ের পথে হাঁটতে হবে। সব শ্রেণির দর্শক যেভাবে আধুনিক ব্যবস্থায় ছবি দেখে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে ব্যবস্থাই করতে হবে।

 

অভিযোগ রয়েছে, দেশীয় গল্পের ছবি হচ্ছে না, আপনার মতামত কী?

আসলেই এখন নিজস্ব গল্পের ছবির অভাব রয়েছে। এখনকার ছবিতে পারিবারিক ইমোশন, যাপিত জীবনসহ সমাজ ও দেশের ছায়া যুক্ত গল্পের বড়ই অভাব। ছবিতে দেশে ও পরিবারের নান্দনিক বিষয়গুলো তুলে আনতে পারছি না। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের চাহিদা ও তাদের জীবন সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠে এমন গল্পের ছবি নির্মাণ হয় না। বর্তমানে সন্তানরা হত্যার প্রতিশোধ, রক্তারক্তির গল্পের ছবি দেখতে চায় না। আসলে দর্শক রুচিকে প্রাধান্য দিতে না পারলে সিনেমা হলে দর্শক ফেরানো যাবে না।

সর্বশেষ খবর