রবিবার, ৮ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

নারীপ্রধান নাটক ও চলচ্চিত্র উপেক্ষিত কেন?

আলাউদ্দীন মাজিদ

নারীপ্রধান নাটক ও চলচ্চিত্র উপেক্ষিত কেন?

‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’

নারী ও পুরুষকে এভাবেই দেখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নারী হলেন মায়ের জাতি। যে মায়ের গর্ভ থেকে আমাদের জন্ম সে মায়ের জাতিকে যদি মর্যাদা না দেওয়া হয় তাহলে তা কলঙ্কজনক। কোনো সমাজ ও রাষ্ট্র কতটা সভ্য বা উদার তা নির্ভর করে সেখানকার নারীদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থানের ওপর।

সংস্কৃতি জগতে নাটক ও চলচ্চিত্রে নারী অপরিহার্য অংশ। বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে আশির দশক পর্যন্ত নারীপ্রধান নাটক ও চলচ্চিত্রের সংখ্যা ছিল উল্লেখ করার মতো। চলচ্চিত্রের কথাই যদি ধরা হয় তাহলে দেখা যায়, একাত্তুর পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক যেসব ছবি নির্মাণ হয়েছে তাতে নারীর অবদান এবং নির্যাতনের চিত্র সুচারুরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন নির্মাতারা। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ একটি নারীপ্রধান ছবি। এ ছবির স্লোগানই ছিল- ‘লাঞ্ছিত নারীত্বের মর্যাদা দাও, নিষ্পাপ সন্তানদের বরণ কর...’। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’। এ ছবিতে রাত্রি চরিত্রটির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন একজন সহজ-সরল মেয়ে কীভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে সাহসী হয়ে ওঠেন তা দেখানো হয়েছে। রাত্রি চরিত্র রূপায়নকারী বিপাশা হায়াত ও নির্মাতাসহ ৮টি বিভাগে চলচ্চিত্রটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। এরপর আসা যাক সাহিত্যধর্মী ছবি প্রসঙ্গে। এক্ষেত্রে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন। সত্তুর ও আশির দশকে তিনি একে একে নির্মাণ করেন নারীপ্রধান চরিত্রের ছবি নয়নমণি, গোলাপী এখন ট্রেনে, সুন্দরী, দুই পয়সার আলতা, সখিনার যুদ্ধ প্রভৃতি। এসব ছবি দর্শক আনুকল্যসহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়। এ ছাড়া আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মাণ করেন নারীপ্রধান চলচ্চিত্র সারেং বৌ; চাষী নজরুল ইসলামের শাস্তি ও সুভা; আলমগীর কবিরের সূর্যকন্যা; সুচন্দার তিন কন্যা, মিতা, আলোর মিছিল; হারুনূর রশিদের মেঘের অনেক রঙ; নার্গিস আক্তারের চার সতীনের ঘর, মেঘের কোলে রোদ, মেঘলা আকাশ, অবুঝ বউ, পুত্র এখন পয়সাওয়ালা, পৌষ মাসের পিড়িত, যৌবতী কন্যার মন; একে সোহেলের খায়রুন সুন্দরী; মৌসুমীর মেহের নিগার; জয়ার দেবী ইত্যাদি। অন্যদিকে ছোট পর্দায় সংশপ্তক, আজ রবিবার, অয়োময়, রাহুসহ প্রচুর নারীপ্রধান নাটক নির্মাণ হয় আশির দশক পর্যন্ত। সম্প্রতি ছোট পর্দার সফল নাটক নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ‘বিশ্বসুন্দরী’ ছবি। আর সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত নারীপ্রধান চলচ্চিত্র হচ্ছে তানিম রহমান অংশু পরিচালিত ‘ন ডরাই’। গত বছর ছবিটি মুক্তি পায়। দুঃখের কথা হচ্ছে, নারীপ্রধান চলচ্চিত্র ও নাটকের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমছে। কিন্তু কেন?

এ বিষয়ে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুচন্দা বলেন, আমাদের সমাজে নারীরা সব সময়ই উপেক্ষিত। নারীদের আনন্দ-বঞ্চনা নিয়ে ছবি নির্মাণ নারীদের হাতেই যথাযথভাবে ফুটে ওঠে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পে নারী নির্মাতাদের অংশগ্রহণ কম। যেসব নারী নির্মাতা ইতিমধ্যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তাদের চলচ্চিত্রে নারীদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার চিত্র সূচারুরূপে ফুটে উঠেছে এবং সফল হয়েছে। এখন চলচ্চিত্রের দুঃসময় চলছে। তাই এমনিতেই এ শিল্পে কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। যদি কোনো দিন আবার চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরে আসে তাহলে অবশ্যই নারীপ্রধান চলচ্চিত্র নির্মাণে নারীদের এগিয়ে আসতে হবে।

প্রখ্যাত নাটক নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী বলেন, একজন নারী হিসেবে আমি যখন নির্মাণ করি তখন তাতে নারীদেরই প্রাধান্য দেই। আর নারীপ্রধান উল্লেখযোগ্য চরিত্র রূপায়নে ফেরদৌসি মজুমদার, সুবর্ণা মুস্তাফা, শমী কায়সার, বিপাশা হায়াত, তমালিকা, রিচি সোলায়মান, মম, তিশা, অপি করিম, তারিন জাহানের মতো শিল্পী প্রয়োজন। তারা চরিত্রের গুরুত্বকে যথাযথভাবে নিজেদের মধ্যে ধারণ করার সক্ষমতা রাখেন। এখনকার শিল্পীদের মধ্যে এই বোধের অভাব আছে। অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা, গবেষণা আর নির্মাতাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তাদের মধ্যে কম বলেই বর্তমান সময়ে নারীপ্রধান নাটক নির্মাণ তেমনভাবে আর হয়ে ওঠে না। আমি আমার প্রথম নির্মিত চলচ্চিত্র নারীপ্রধান গল্প নিয়েই নির্মাণ করেছি। ছবির নাম ‘বিশ্ব সুন্দরী’। শিগগিরই এটি মুক্তি পাবে। আমার শেষ কথা হলো একটি প্রবাদ আছে ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, গুণবান পতি যতি থাকে তার সনে’। সবাই কিন্তু শেষ চরণ মানে ‘গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে’ এ লাইনটি বলেন না। আসলে ‘নারী ও পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক’ এ ভাবনাটি যতক্ষণ পর্যন্ত দেশ ও সমাজে প্রতিষ্ঠা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত নারী অবহেলিতই থেকে যাবে। প্রখ্যাত চিত্র নির্মাতা নার্গিস আক্তারের কথায়- নারীরা বেশিরভাগই পুরুষদের দ্বারা নিগৃহীত হয়ে থাকে। তাই একজন পুরুষ নির্মাতা যখন নারীপ্রধান নাটক বা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যান তখন তারা তাদের এ দুর্বল অবস্থানকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলার সাহস পান না। ফলে নারীদের সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-বঞ্চনার কথা অপূর্ণই থেকে যায়। তাই নারীদের কথা নারীদেরই তুলে ধরতে হবে। আমি এ পর্যন্ত যত চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছি সবই নারীপ্রধান। আসলে এখন নারী নির্মাতার সংখ্যা কম বলেই নারীপ্রধান নাটক ও চলচ্চিত্রের সংখ্যাও কম। জনপ্রিয় অভিনেত্রী মৌসুমীর কথায় ‘নারীপ্রধান চলচ্চিত্র বা নাটক নির্মাণ করতে গেলে একজন নারীর জীবনের পারিপার্শ্বিকতাকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হবে। কিন্তু আমাদের সমাজে নারীকে এখন পদে পদে নানা দুর্ভোগে পড়তে হয়। সংসার, কর্মক্ষেত্র বা রাস্তাঘাটে নারী খুব একটা নিরাপদ নয়। বর্তমানে এ বিষয়টি চলচ্চিত্র বা নাটকে তুলে ধরার মতো গল্প বা সাহসের অভাব রয়েছে বলেই নারীপ্রধান নাটক ও ছবি নির্মাণ কমে গেছে। এক্ষত্রে নারীরা যদি এগিয়ে আসে তাহলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে।

সর্বশেষ খবর