সোমবার, ৯ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

মৃত্যুর পর একটি কলম যেন সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি

মৃত্যুর পর একটি কলম যেন সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি

গাজী মাজহারুল আনোয়ার, যিনি ২০ হাজারেরও বেশি গানের স্রষ্টা ও সর্বকালের সেরা গীতিকারদের একজন। স্বনামধন্য কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার ও চিত্রপরিচালকও তিনি। এই গুণী মানুষটি বলেছেন নিজের জীবনের গল্প।  তার কথা তুলে ধরেছেন-  আলাউদ্দীন মাজিদ ও আলী আফতাব

 

বাবা-মার পরই আমার অন্তরে বঙ্গবন্ধুর স্থান

আজ আমি গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার হতে পেরেছি বঙ্গবন্ধুর উৎসাহে। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমার চুল টেনে ধরে বলতেনÑ তুই কখনই নড়বি না, সৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে যা। আমি তাঁর কথা রেখেছি, মোটেও নড়িনি। তিনি নড়েছেন; অসময়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এই দুঃখবোধ আমার চিরকালের। প্রতিটি মানুষের কাজ আর প্রতিষ্ঠার পেছনে কারও উৎসাহ থাকে, আমার উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা হলেন বঙ্গবন্ধু। আমি এখনো বঙ্গবন্ধুকে ভাবলে সমৃদ্ধ সুজলা-সুফলা বাংলাদেশকে দেখি আর এই অনুপ্রেরণা থেকে এখনো লিখে যেতে পারছি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি রইল আমার অশেষ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর সালাম। আমি মনে করি আমার মা-বাবার পর আমার অন্তরে শ্রদ্ধার আসনে আসীন রয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এক কথায় বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ। কেননা বঙ্গবন্ধুর দেশাত্মবোধ থেকেই বাংলাদেশের জন্ম।

 

দুঃখ একটাই, বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে সেই স্বীকৃতি নিতে পারলাম না

সংস্কৃতি জগতে অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধুই প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড প্রবর্তন করলেন। আমি সেই অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হলাম। কিন্তু পরিতাপের বিষয় তাঁর হাত থেকে সেই অ্যাওয়ার্ড নেওয়ার ভাগ্য আমার হলো না। কারণ এর আগেই দুষ্কৃতকারীরা তাঁকে হত্যা করল। আন্তর্জাতিকভাবে অনেক স্বীকৃতি পেয়েছি কিন্তু নিজ দেশের স্বীকৃতি আমার কাছে সবার ওপরে।

 

মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রায় ১৭-১৮টি গান লিখেছি

মুজিববর্ষ উপলক্ষে এ পর্যন্ত প্রায় ১৭-১৮টি গান লিখেছি। সর্বপ্রথম কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ আমাকে এসে বলল, দাদা বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে জাতির পিতাকে নিয়ে আপনার লেখা একটি কবিতা বাঁধাই করে দেয়ালে টাঙানো দেখলাম। ওই কবিতাটি নিয়ে আমি গান করতে আপনার অনুমতি চাই। আমি বললাম এর জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি প্রয়োজন। ও বলল সে ব্যবস্থা আমি করেছি এখন শুধু আপনার অনুমতি পেলেই হয়। আমি বললাম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তুই গান করবি এটিই তোর জন্য আমার আশীর্বাদ। ও গানটি করেছে। এটি ১৭ মার্চ মুজিববর্ষে চ্যানেল আইয়ে প্রচার হবে। এরপর বাদশা বুলবুলসহ অনেকে এসেছে। সবার জন্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গান লিখে দিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা আর সম্মান থেকেই গানগুলো আমার লেখা।

 

এদেশে সর্বোচ্চসংখ্যক গান আমিই লিখেছি

এদেশে সর্বোচ্চসংখ্যক গান লেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এ পর্যন্ত বিশ হাজারেরও বেশি গান লিখেছি। কিন্তু সব গান আমার সংরক্ষণে নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের ফাঁসির যে তালিকা তৈরি করেছিল সেই তালিকায় ১৩ নাম্বারে ছিলাম আমি। ফলে আমাকে আত্মগোপনে যেতে হয়েছিল। পরে বাসায় ফিরে দেখি আমার গানের পান্ডুলিপিগুলো আর নেই। এরপর রেডিও স্টেশনে গিয়ে দেখি সেখানেও আমার গানগুলো নেই। পাকবাহিনী বাঙালিদের সব সৃষ্টিকর্ম ধ্বংস করে দিয়েছিল। ফলে আমার রচিত প্রচুর গান হারিয়ে গেছে।

 

অসহায় শিল্পীদের রয়্যালিটি দেওয়া হোক

বর্তমানে কোনো শিল্পী অসুস্থ বা অসহায় হয়ে পড়লে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাকে অনুদানের জন্য যেতে হয়। আমাদের মহানুভব প্রধানমন্ত্রী কাউকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেন না। আমি বলব এভাবে প্রধানমন্ত্রী আর কত অনুদান দেবেন। ভারতে দেখেছি শিল্পীরা সারা জীবন যে কাজ করে তার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একসময় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাকে রয়্যালিটি দিয়ে যায়। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের সরকার শিল্পীদের কাজের মূল্যায়ন হিসেবে জীবনের শেষ দিনগুলোতে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে সম্মানী দিয়ে থাকে। ভারতে প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকরসহ আরও অনেককে এই সম্মানী দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশেও এই প্রথা চালু হলে ভালো হয়।

 

৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশে কেন আমরা হতাশায় থাকব

আমি যখন ঢাকায় এলাম তখন আমার মগবাজারের বাসার সামনে একটি আম গাছ ছিল। সেই গাছে একটি চড়ুই পাখি বাসা বাঁধল। সারা দিন পাখিটি কিচিরমিচির করে উড়ে বেড়ায়। এক দিন দেখলাম পাখিটি ডিম পেড়েছে। সেই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটল। বাচ্চাগুলো সারাক্ষণ কিচিরমিচির করে। মা পাখিটি সকালে উড়ে চলে যায়। বাচ্চাগুলোর জন্য আমার মায়া হয়। আমি ওদের খাবার দিই। কিন্তু তারা খায় না। বিকালে মা খাবার নিয়ে আসে। নিজের মুখ থেকে বাচ্চাদের মুখে খাবার পুরে দেয়। বাচ্চারা পরম তৃপ্তিতে খাবার খায়। আমার কথা হলো ‘আমাদের তো পোলাও কোর্মার দরকার নেই, মা-বাবা পরিশ্রম করে আমাদের জন্য যা জোগাড় করে আনেন তা দিয়েই তো সন্তুষ্ট থাকতে পারি। তাছাড়া একটি পাখি যদি গাছে তার জন্য একটি বসবাসের ব্যবস্থা করে নিতে পারে, তাহলে আমরা মানুষ কেন আমাদের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই দেশে নিজেদের আশ্রয়ের জন্য এত হাহাকার করি, সংঘাত, মারামারি, হানাহানিতে লিপ্ত হই। একটি গণতান্ত্রিক দেশে যে যার মতো করে কেন সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। আমি একসময় এই পাখির কিচিরমিচির নিয়ে একটি গান লিখেছিলাম। গানটি ছিল- ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা আর তো প্রাণে সয় না’। পরে গানটি আজিজুর রহমান সাহেব পরিচালিত ‘অতিথি’ ছবিতে ব্যবহার করা হয় এবং এখনো গানটি সমান জনপ্রিয় হয়ে আছে।

 

ছোটবেলা থেকে শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি ঝোঁক ছিল

বাবার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব। সে হিসেবেই যখন এমবিবিএস সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন দেখলাম ‘মরা মানুষ কাটতে হবে’। এটা সহ্য করা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ল। আমি পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়লাম। ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আমার মনের টান ছিল। পড়াশোনায় আমার অমনোযোগী ভাব দেখে আমার এক সহপাঠী বলল তুমি ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা কর। মেডিকেল কলেজে নাটক হতো। নাটকের জন্য গান লিখতাম। একটি গান লিখলাম ‘বুঝেছি মনের বনে রং লেগেছে’। ফরিদা ইয়াসমিনের গানটি পছন্দ হলো। তিনি রেডিওতে গানটি গাইলেন। তুমুল জনপ্রিয় হলো। কিন্তু গীতিকার হিসেবে আমার নাম প্রচার হলো না। মনে খুব কষ্ট পেলাম। ডাক্তারি পড়া আর হলো না। মগবাজারের একটি ঝুপড়ি ঘরে থাকি। গান লিখি। বাবা জানলেন না তার ছেলে ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে গান লিখছে।

 

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাংলাদেশ

আমার চোখে হাজার বছরের এই দেশ বাংলাদেশ। দেশটি এত লোভনীয় যে, ব্রিটিশ, পাকিস্তানসহ অনেকে বার বার দেশটি দখল করেছে। যার নজির পৃথিবীতে অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে নেই। ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ রবীন্দ্রনাথের এই গানটি হৃদয়ে ধারণ করলে জাতি হিসেবে আমরা সমৃদ্ধ হব।

 

অপ্রাপ্তি বলে আমার কিছু নেই

জীবনে কতটা কাজ করতে পেরেছি কেমন করতে পেরেছি জানি না। তবে মানুষের যে অবারিত ভালোবাসা পেয়েছি তাতেই আমার জীবন পূর্ণতায় ভরে গেছে। আর কোনো অপ্রাপ্তি বা চাওয়ার কিছু নেই আমার। আমার এখন একমাত্র ইচ্ছা ‘মৃত্যুর পর একটি কলম যেন সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি।’

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন একটি গঠনমূলক পত্রিকা

বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই গঠনমূলক লেখা আর সাংবাদিকতার কারণে স্বল্প সময়ে পাঠকের মন জয় করে নিয়েছে। আজ দেশের শীর্ষ পত্রিকার সম্মান অর্জন করেছে। এর সম্পাদক নঈম নিজাম একজন দূরদর্শী ও মেধাবী ব্যক্তিত্ব।

তার সুদক্ষ সম্পাদনায় পত্রিকাটি আজ শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছে গেছে। এই পত্রিকায় শিল্প-সংস্কৃতির জন্য একটি স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে। যা শুধু শিল্পীদের কথা নয়, শিল্পের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে এর সমাধানের পথ প্রশস্ত করে দেয়। পত্রিকাটির সম্পাদক ও সাংবাদিকদের প্রতি আমার শুভ কামনা রইল।

শুধু ১১ বছর নয়, এটি শতবর্ষ ধরে এই শীর্ষত্ব বজায় রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

সর্বশেষ খবর