কেমন আছেন? এখনো বয়সী দুরন্ত যুবা! রহস্য কী?
জি, অনেক ভালো আছি। আর আমি ভেবেছিলাম রবীন্দ্রনাথকে তো কিছুতেই ছাড়িয়ে যেতে পারব না, তবে বয়সকে অতিক্রম করেছি...হা হা হা। তিনি তো ৮০ বছর বেঁচেছিলেন। আর আমার এখন ৮৫!
রবীন্দ্রনাথের গান আপনার খুবই পছন্দ।
তিনি তো সব সময়ের। আমার প্রিয় একজন। এই তো কবিগুরুর ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার’ গানটি আমি ৮১ বছর বয়সে নিউইয়র্কে উদীচীর আয়োজনে একটি অনুষ্ঠানে গেয়েছিলাম। তখন ভিডিওটি মোবাইলে রেকর্ড করে ইউটিউবে আপলোড করা হয়।
শৈশব সম্পর্কে জানতে চাই।
আমার শৈশব তো অনেক লম্বা। নানা কাজ করেছি। দুষ্টু ও দুরন্ত ছিলাম; পুকুরে সাঁতার কাটতাম। বহুবার তো মরতে মরতে বেঁচে এসেছি। পানিতে ডোবা থেকে, সাপে কামড় কিংবা আগুনে পোড়া থেকে। রাজনৈতিক কারণে মায়ের বুকে রিভলবার ঠেকিয়ে অনেকেই আমার মৃত্যুর হুমকি দিয়েছে। এত বড় ইতিহাস তো আর অল্প কথায় শেষ করা যাবে না।
আর বেড়ে উঠা ও ব্যক্তিগত জীবন...
মাত্র দুই বছর বয়সে বাবাকে হারাই। শিক্ষাজীবন শুরু হয় বর্ধমান টাউন স্কুলে। তারপর ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত রাজ কলেজ ও ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত টেকনিক্যাল কলেজে পড়ালেখা করি। তবে ১৯৫৭ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বর্ধমান জেলা গণনাট্য সংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই।
ছাত্রজীবনে আপনি তো ভালো গানও করতেন?
সেটা ছাত্রজীবনের কথা। ১৯৫২ সালে অল ইন্ডিয়া ইয়ুথ ফেস্টিভ্যালে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছিলাম। এরপর ১৯৫৫ সালে কলেজের অনুষ্ঠানে আমার কণ্ঠে গান শুনে দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় আমাকে বিনা পারিশ্রমিকে গান শেখানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তবে আমি মাত্র এক বছর উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নিয়েছিলাম।
সহধর্মিণীর সঙ্গে পরিচয় কীভাবে?
আমাদের প্রথম পরিচয় একসঙ্গে ঘটেনি। লায়লা আমাকে আগে দেখেছে। রবীন্দ্রশতবর্ষে দুজনের দেখা হয়েছিল। ও তখন বাচ্চা, এই বাচ্চা মেয়ের কথা আমি তখন ভাবিনি; আমার মাথার ওপর দিয়ে চলে যেত... হা হা হা। আমি তাকে প্রথমে দেখিনি; অবশ্য পরে তাকে দেখেছি। লায়লা আমাকে প্রথম দেখেছে ১৯৬১ সালে। পরে আমরা একসঙ্গে ভয়েজ আমেরিকায় নাটক করেছি। আর এই বিষয়টি ভয়েজ আমেরিকায় কর্মরত কাছের মানুষেরা ইচ্ছা করেই করেছিলেন। তখন আমার জন্য পাত্রী খোঁজা হচ্ছিল। আর লায়লা এমনিতেই আমাকে চিনত। নাটকে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখেছে।
আপনি কোনোদিন চিঠি লিখেছিলেন তাকে?
লিখেছিলাম একটা। তবে সেই চিঠির উত্তরটা সে আজও দেয়নি। এরপর তো ১৯৬৫ সালে আমরা বিয়ে করি।
স্ত্রীর সঙ্গে জুটি হয়ে তো ‘মিশন এক্সট্রিম’ করেছেন...
হ্যাঁ। দুজনেই আছি এই চলচ্চিত্রে।
স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘রূপান্তরের গান’র ভূমিকা কেমন ছিল?
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দলিল ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ এবং স্টপ জেনোসাইড’ নির্মিত হয়। আমাদের ‘স্টপ জেনোসাইড দেখে অনেক বিপক্ষ দেশে জনগণ উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তখন মুক্তিকামী শিল্পী সংস্থায় আমি, ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, মুস্তাফা মনোয়ার ছিলাম। আমরা যুবকদের নিয়ে স্কোয়াড গঠন করেছিলাম। আর ৪৭-৭১ এর পটভূমিতে করা ‘রূপান্তরের গান’র ধারা বর্ণনা তখন আমি করতাম। রচনায় ছিল শাহরিয়ার কবির। রূপান্তরের গান নিয়ে তখন আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলাম।
আর ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’-এর ভূমিকা...
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় শিল্পীদের প্রতিবাদী সংগঠন ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’। সবাই তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বর্জন করি। গণআন্দোলনের চাপে পাকিস্তান সরকার ৮ মার্চ থেকে বেতার-টেলিভিশনের দায়িত্ব বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চের পর আমি মুজিবনগরে চলে যাই এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাটক বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে নিযুক্ত হই।
তখন তো আপনি একটি ছদ্মনামে সংবাদ পাঠ করতেন...
তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সালেহ আহমেদ নামে বাংলা সংবাদ পাঠ করতাম। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংবাদ পাঠের দায়িত্ব পালন করি। দুটি কমিটি করে বেতার-টেলিভিশনের প্রচার চালাই। আর পাকিস্তানের প্রচার মাধ্যম আমাদের কাজে ব্যবহার করি। প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে স্বাধীন সরকার গঠিত হলে যারা বেতার-টেলিভিশন থেকে ভারতে চলে গিয়েছিল তাদের ফিরিয়ে এনে প্রচার শুরু করি।
স্বাধীনতার লক্ষ্য পূরণে আমরা কতটা সফল হয়েছি?
অনেক কিছুই হয়েছে আবার অনেক কিছুই হয়নি। তবে সাম্প্রদায়িক উত্থান, মৌলবাদীর উত্থান বর্তমানে কমেছে। আমি মনে করি, সব মানুষই সমান।