শুক্রবার, ১৩ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা
ইন্টারভিউ → খুরশিদ আলম সেলিম

আমাদের দেশে চিত্রশিল্পীদের প্রচারটা ভালো হচ্ছে না

আমাদের দেশে চিত্রশিল্পীদের প্রচারটা ভালো হচ্ছে না

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক প্রবাসী চিত্রশিল্পী খুরশিদ আলম সেলিম। নিসর্গপ্রেমী এই চিত্রকর খ্যাতি কুড়িয়েছেন আন্তর্জাতিক চিত্রকলা আঙিনায়। শিল্পী হিসেবে শিল্পকলায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে জয় করেছেন বেইজিং অলিম্পিক স্বর্ণপদক। এছাড়াও পেয়েছেন চীন, জাপান, আমেরিকা, ভিয়েনা, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর নানা দেশের বিভিন্ন সম্মানজনক পুরস্কার। বিশ্বের ১৪টি দেশের জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে তার শিল্পকর্ম। সব মিলিয়ে শিল্পের ভুবনে দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে সম্মানের স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন এই চিত্রকর। সম্প্রতি ঢাকায় হয়ে গেল এই শিল্পীর ৭৪তম একক চিত্র প্রদর্শনী। নিজের জীবনের চিত্রকর্ম ও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন-  আলী আফতাব

 

এবার বাংলাদেশে আসার মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?

এবার বাংলাদেশে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল আমার একটি একক প্রদর্শনী করা। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছে ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত এডওয়ার্ড এম কেনেডি সেন্টারে। এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে আমার ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ৩২টি চিত্রকর্ম। এই চিত্রকর্মগুলো আমি আমেরিকা থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। এই আর্ট সেন্টারটিতে মূলত তরুণদের সমাগম বেশি হয়। তাই আমিও আমার এবারের চিত্রকর্মে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি তরুণদের।  

 

এবার এসে আর কোনো উৎসবে আপনি যোগদান করেছেন?

শত শত শিল্পী ও শিল্পপ্রেমীদের উপস্থিতিতে নীলফামারীর নীলসাগর পাড়ে ‘আন্তর্জাতিক চারুকলা উৎসব-২০২০’ অংশগ্রহণ করেছিলাম আমি। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রায় ৩৫ জনেরও বেশি চারুশিল্পী উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের চিত্রকর্ম নিয়ে। এর মধ্যে আমিও ছিলাম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংসদ সদস্য সংস্কৃতিজন আসাদুজ্জামান নূর।

 

বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন কোন দেশে আপনার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে?

এ পর্যন্ত চীন, তাইওয়ান, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, মরক্কো, স্পেন, ব্রিটেন, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, ভারত, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এবং বাংলাদেশে মোট ৭০টি শিল্পকর্ম প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের ১৪টি দেশের জাদুঘরে আমার চিত্রকর্ম সংগৃহীত হয়েছে।

 

আপনার কর্মজীবনের শুরুটা একটু বলুন।

আমি একজন নিসর্গপ্রেমী চিত্রকর। আমার চিত্রকর্মজুড়ে প্রকৃতির বন্দনা। প্রকৃতি এবং এর বহুমাত্রিক প্রকাশ আমার শিল্পের অনুপ্রেরণা। আমার কর্মজীবন শুরু করেছিলাম একজন নিখাদ বিমূর্ত চিত্রশিল্পী হিসেবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পরিমার্জন করেছি। ফলে নতুন লাইন, কৌশল, ফর্ম এবং বিভিন্ন বিষয়বস্তুর সংযোজন ঘটেছে আমার শিল্পকর্মে। ১৯৮৭ সালে শিল্পকলায় উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশে দেশ ছেড়েছিলাম আমি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগ পর্যন্ত নিজেকে একজন বিমূর্ত এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পী হিসেবে নিযুক্ত রেখেছিলাম।

 

তার মনে কি সময়ের সঙ্গে আপনার চিত্রকর্মের ধরনও পরিবর্তন হয়েছে?

তা বলা যেতে পারে। এখন আমার কোলাজগুলো মূলত আর্ট প্রযুক্তি এবং শিল্পের মোহনীয় প্রকাশ। আমার কোলাজগুলোতে বিভিন্ন উপকরণ যেমন হস্তনির্মিত কাগজপত্র, অলঙ্কারিক কাগজপত্র, লিনেন কাপড় এবং আরও নানা উপাদান ব্যবহার করে থাকি।

 

আমেরিকায় আপনি নিজের একটি গ্যালারি চালাতেন। তার কি অবস্থা?

এখনো আছে কিন্তু ছোট পরিসরে। গ্যালারিটির নাম ছিল ‘নিউইউর্ক আর্ট কালেশন’। এখানে ইউরোপ, আমেরিকা ও বাংলাদেশের অনেক শিল্পীর ছবি প্রদর্শন করেছি। আমার উল্লেখযোগ্য প্রদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের ১০০তম জন্মবার্ষিকী পালন করেছি। আমি এই গ্যালারির মধ্য দিয়ে শুধু নিজেকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরিনি, আমি তুলে ধরেছি অনেক বাংলাদেশি ও যুক্তরাষ্ট্রের চিত্রশিল্পীকে।

 

বিদেশে আমাদের চিত্রশিল্পীদের কেমন মূল্যায়ন করা হয়?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে একটি ঘটনা বলতে হবে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে যখন দ্বিবার্ষিক এশিয়া বিয়েনেল চালু হয় তখন এর সঙ্গে আমিও যুক্ত ছিলাম। তখন চারুকলা বিভাগের পরিচালক ছিলেন শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর। তার সঙ্গে শিল্পী সুবীর চৌধুরী, আমিও ছিলাম। তখন ভারতের এক নামকরা চিত্রশিল্পী রামকুমারকে আমরা জুরিবোর্ডের প্রধান করে নিয়ে আসি। তিনি ওই সময় আমাদের দেশের চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবিগুলো দেখেন। পরবর্তী সময় তার সঙ্গে আমার দেখা হয় নিউইউর্কে। তিনি আমাকে দেখে চিনতে পারেন। তখন রামকুমার আমাকে বলেন, সেলিম তোমরা আমাকে তোমাদের দেশে নিয়ে গিয়েছিলে বাংলাদেশি শিল্পীদের ছবি দেখার জন্য। আমি এর আগে কখনো তোমাদের দেশের শিল্পীদের আঁকা ছবি দেখিনি। বাংলাদেশের আর্ট ইন্ডিয়ার আর্ট থেকে অনেক এগিয়ে।’ তিনি আরও বলেন, তোমাদের দেশের চিত্রশিল্পী রশিদ চৌধুরীর মতো একজন শিল্পী ভারতে আসতে আরও একশ বছর অপেক্ষা করতে হবে। কষ্টের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশেও কতজন চিত্রশিল্পী রশিদ চৌধুরীকে চেনে। আমাদের দেশে চিত্রশিল্পীদের প্রচারটা ভালো হচ্ছে না।

    

নতুন প্রজন্মের চিত্রশিল্পীদের নিয়ে বলুন।

এখনকার নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সময়টা বোঝাতে হবে। তারা মূল্যটা বোঝে, কিন্তু গতিটা হারিয়ে ফেলেছে। কোথায় যেন থেমে গেছে তাদের গতি। বোঝার লেভেলটা সময়ের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। মুভমেন্টটা না বুঝলে সামনে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। কেবল এককভাবে বিশ্বায়নের কাছে পৌঁছাচ্ছে তারা। বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ ক্ষমতা খুব দুর্বল। শিল্পের জায়গাকে পেশাগত জায়গা দখল করে নিয়েছে। এই সবকিছু থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

সর্বশেষ খবর