বৃহস্পতিবার, ১৯ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্ব বিনোদন জগৎ

করোনার কারণে বিশ্ব বিনোদন জগৎ এখন চরম ক্ষতির মুখে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চলচ্চিত্র শিল্প। আটকে আছে বিনিয়োগকৃত কয়েক হাজার কোটি টাকা। অনেকে এরই মধ্যে গুনছেন ক্ষতির হিসাব। কারণ সিনেমা হল বন্ধ ও শুটিং স্থগিত। তারকাদের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন, আবার অনেকে রয়েছেন হোম কোয়ারেন্টাইনে। হলিউড ও বলিউড সবচেয়ে বেশি আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে। বিনোদন দুনিয়ার স্থবির অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

করোনায় বিপর্যস্ত বিশ্ব বিনোদন জগৎ

স্থবির দেশের শোবিজ অঙ্গন

১৮ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সব সিনেমা হল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে সিনেমা হল মালিকরা। মুক্তি পিছিয়ে গেছে বেশকিছু ছবির।

যে কোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যাবে নাটক নির্মাণ। এমন খবর দিলেন ডিরেক্টরস গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক এস এ হক অলিক। বাতিল হয়েছে বহু কনসার্ট। বিদেশে স্টেজ শোতে যাওয়া হয়নি অনেক শিল্পীর। সাধারণত এ সময় গানের শিল্পীরা স্টেজ শো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কেউ কেউ এ সময় দিনে দুটি মঞ্চেও গান করেন। এ সময়ই বিদেশ থেকে গান করার আমন্ত্রণ আসে। করোনা আতঙ্কে সেসব বন্ধ। স্টেজ শো, রেকর্ডিং নিয়ে ব্যস্ত শিল্পীরা এখন গৃহবন্দী।  সোলস ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য পার্থ বড়–য়া বলেন, ‘সবদিকে করোনা আতঙ্ক। জীবনের নিরাপত্তা সবকিছুর আগে। রোজার আগ পর্যন্ত আমাদের যত কনসার্ট ছিল, সব বাতিল।’

একই সঙ্গে বন্ধ থাকছে নাটক প্রদর্শনী, মহড়া ও এর কার্যক্রম। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজিদ ও শিল্পকলা একাডেমি। কামাল বায়েজিদ বলেন, ‘জনসমাগম যেন না হয়, এ জন্য মঞ্চনাটক প্রদর্শনী ও মহড়াসহ এর সব কার্যক্রম স্থগিত করেছে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। সবার আগে জীবনের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কার্যক্রম বন্ধ।

 

টলিউডেও সব বন্ধ

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে পশ্চিমবঙ্গের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি টলিউডের শুটিংও বন্ধ হয়ে গেল। টলিউডের ধারাবাহিক, সিনেমা ও রিয়েলিটি শোয়ের শুটিং আগামী ৩০ মার্চ পর্যন্ত বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন টলিউডের প্রযোজক-পরিচালক ও কলাকুশলীরা। পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্র কেন্দ্র নন্দনে গত ১৭ মার্চ উ™ভূত করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে এক জরুরি সভায় টলিউডের শুটিং বন্ধের  সিদ্ধান্ত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের চেয়ারম্যান রাজ চক্রবর্তী, ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়শনের (ইমপা) সভাপতি পিয়া সেনগুপ্ত, অভিনেতা শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, পরিচালক অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় ও অভিনেত্রী জুন মালিয়া প্রমুখ। সভা শেষে রাজ চক্রবর্তী ও অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় জানান, ৩০ মার্চ পর্যন্ত টলিউডের সব শুটিং বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর করোনা থেকে বাঁচতে সোমবার (১৬ মার্চ) রাজ্যের সব সিনেমা হল বন্ধ রাখার আবেদন জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তার অনুরোধ মেনে ১৬ মার্চ স্টার থিয়েটারসহ একাধিক মালিক সিনেমা হল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। মঙ্গলবার ইমপার পক্ষ থেকেও এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। করোনার ধাক্কায় টালিগঞ্জের দেব, জিৎসহ একাধিক তারকার ছবির শুটিং বাতিল হয়েছে। পিছিয়েছে প্রচুর সিনেমার মুক্তি। ফলে অগ্রিম টাকা দিয়ে লোকেশন বুক করেও বাতিল হয় শুটিং। টলিউডও অর্থনৈতিক ধাক্কার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে।

 

আইসোলেশনে জিৎ ও মিমি

দুজনই সম্প্রতি বিদেশ থেকে ফিরেছেন। তাই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়টা ছিলই। তার ওপর কলকাতায় একজন করোনা আক্রান্ত পাওয়া গেছে। সে কারণে ভয়টা বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। তাই দেশে ফিরেই তড়িঘড়ি করে আইসোলেশনে গেছেন টালিউডের অভিনেতা জিৎ ও অভিনেত্রী তথা সাংসদ মিমি।

কয়েকদিন আগে লন্ডনে শুটিং করতে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু সতর্কতার জন্য যেহেতু বিদেশি বিমান আসার ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া হয়েছে, তাই দ্রুত দেশে ফিরতে হয় তাদের। ১৮ মার্চ সকালেই কলকাতায় ফিরেছেন তারা। দুজনই আপাতত আইসোলেশনে থাকবেন। কারণ তাদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব  বেশি। কলকাতা বিমানবন্দরে নেমেই মিমি জানিয়েছেন, তিনি আপাতত তার কোনো আত্মীয়র সঙ্গে দেখা করবেন না।

 

হোম কোয়ারেন্টাইনে অমিতাভ

 

বলিউড শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চনের হাতে পড়ল কোয়ারেন্টাইনের সিল। ১৭ মার্চ মহারাষ্ট্র সরকার এই বিশেষ সিল দিয়েছে।

কারণ নভেল করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে অমিতাভ বচ্চন নিজেই হোম কোয়ারেন্টাইনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এটি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করেছেন বিগ-বি। ছবিসহ টুইটারে পোস্ট করা সে টুইটে অমিতাভ লেখেন, ‘অবশেষে হাতে পড়ল বিশেষ সিল। সবাই সাবধান থাকুন, শনাক্ত হলে বিচ্ছিন্ন থাকুন।’ বিষয়টি প্রথম নজরে আসে গত রবিবার (১৫ মার্চ)। কারণ বিগত কয়েক বছর সপ্তাহের প্রতি রবিবার ভক্তদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের জন্য নিজেকে উন্মুক্ত রাখেন তিনি। তবে গত রবিবার সেটা হয়নি। এরপর টুইটারে তার পোস্টটির মাধ্যমে পুরো বিষয়টি নিশ্চিত হন তার ভক্তরা। যেখানে দেখা গেল ৩০ মার্চ তার কোয়ারেন্টাইনের ১৪ দিন পূর্ণ হবে। এদিকে শুধু অমিতাভই নন, বিশ্বজুড়ে এমন পরিস্থিতিতে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না সাইফ আলী খান, কারিনা কাপুর খান, অর্জুন কাপুর, ক্যাটরিনা কাইফ, দীপিকা পাড়ুকোন, আলিয়া ভাটসহ বলিউডের অনেকেই। তারকারা এখন জিমে যাওয়ার পরিবর্তে নিজ বাড়ির ছাদেই জিম করছেন।

 

হলিউডেও ছবি মুক্তি বন্ধ

করোনা আতঙ্কে হলিউডে বন্ধ হয়ে গেছে নতুন ছবি মুক্তি। জেমস বন্ড সিরিজের নতুন সিনেমা ‘নো টাইম টু ডাই’-এর মুক্তি ৭ মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘নো টাইম টু ডাই’ সিনেমাটির মুক্তি ২০২০ সালের এপ্রিলের পরিবর্তে নভেম্বরে পিছিয়ে দেওয়া হয়।  জেমস বন্ড সিরিজের মূল মুনাফা আসে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে। করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে এপ্রিলে ‘নো টাইম টু ডাই’ মুক্তি দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়। গত সপ্তাহে প্যারামাউন্ট পিকচার্স মিশন ইমপসিবল সিরিজের সপ্তম সিনেমার নির্মাণ আটকে দেয়। এর চিত্রায়ণের কথা ছিল ইতালির ভেনিসে। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি চীনে ‘সনিক দ্য হেজহগ’ মুক্তি দেওয়া স্থগিত করেছে।

 

বলিউডে এখন পর্যন্ত ক্ষতি প্রায় ১ হাজার কোটি রুপি

কেরালা, জম্মু-কাশ্মীর, দিল্লি, কর্ণাটক ও মুম্বাইয়ে শুক্রবার থেকে বন্ধ শপিংমল, জিম ও সিনেমা হল। দিল্লিতে ১৫০টি সিনেমা হল রয়েছে, সরকারের নির্দেশে ৩১ মার্চ পর্যন্ত তা বন্ধ থাকবে। সবাই লোকসানের মুখ দেখছেন, কারণ যদি সিনেমা হল না চলে তবুও বেতন ও ইলেকট্রিক বিল দিতে হবে। অক্ষয় কুমার অভিনীত ‘সূর্যবংশী’। সম্প্রতি এই ছবির ট্রেলার মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এই ছবির মুক্তির দিন পিছিয়ে যায়। এই আতঙ্কের মধ্যেই মুক্তি পেয়েছে ইরফান খান, কারিনা কাপুর, রাধিকা মদন অভিনীত ‘অংরেজি মিডিয়াম’। কিন্তু সব সিনেমা হল বন্ধ থাকায় চলচ্চিত্র নির্মাতারা ছবিটি ফের মুক্তি দেওয়ার কথা চিন্তাভাবনা করছেন। এরই মধ্যে সিনেমা হলে দর্শকসংখ্যা গভীরভাবে হ্রাস পেয়েছে ও যে ছবিটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা হলো টাইগার শ্রফের ‘বাঘি থ্রি’। মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্র পরিবেশক রাজেশ থাদানি বলেন, ‘৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে বা তারও বেশি। দিল্লি, কেরালা ও জম্মু-কাশ্মীরেও সিনেমা হলগুলো বন্ধ রয়েছে। বড় বড় সিনেমাগুলোর মুক্তি পিছিয়ে গেছে। ‘বাঘি থ্রি’র লোকসান হয়েছে ১০ শতাংশ।’

বক্স অফিস ইন্ডিয়ার মতে, মুক্তি পাওয়া ছবি মুখ থুবড়ে পড়া, বেশকিছু ছবির মুক্তি আটকে থাকা এবং বহু ছবির শুটিং বন্ধ হওয়া, সব মিলিয়ে বলিউড ইন্ডাস্ট্রির ৮০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। এমন অবস্থা দেখে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে নির্মাতাদের কপালে। কতদিন এরকম পরিস্থিতি থাকবে, তা নিয়ে চিন্তায় পুরো বলিউড। করোনা আতঙ্কে ইতিমধ্যেই শুটিং বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলিউড। ইন্ডিয়ান মোশন পিকচার্স প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন, ফেডারেশন অব ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়া সিনে এমপ্লয়িজ এবং ইন্ডিয়ান ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ডিরেক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের এক যৌথ সভায় ১৫ মার্চ বলিউডের সব শুটিং ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়। গত ৬ মার্চ মুক্তি পায় টাইগার শ্রফ ও শ্রদ্ধা কাপুর অভিনীত ‘বাঘি থ্রি’। কিন্তু প্রথম সপ্তাহে ছবিটির মোট আয় মাত্র ৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অন্যদিকে মুক্তি পায় ইরফান খান অভিনীত ‘অংরেজি মিডিয়াম’। কিন্তু এই ছবিটি তিন দিনে ঘরে তুলেছে মাত্র সাড়ে ৯ কোটি টাকা। জানা গেছে, ৯০ কোটির থেকেও বেশি আয় করার কথা ছিল ‘বাঘি থ্রি’র। কিন্তু ইতিমধ্যে ২৫-৩০ কোটি টাকা লোকসান হয়ে গেছে ছবিটির। একই অবস্থা ‘অংরেজি মিডিয়াম’-এর। সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভালো ব্যবসা করতে পারছে না ইরফান খান অভিনীত ছবিটিও। করোনাভাইরাসের কারণে পিছিয়ে গেছে ‘সূর্যবংশী’, ‘উধম সিং’, ‘নো টাইম টু ডাই’, ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস নাইন’, ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ ছবির মুক্তি।

সর্বশেষ খবর