শুক্রবার, ২০ মার্চ, ২০২০ ০০:০০ টা
ইন্টারভিউ - মোহাম্মদ খুরশীদ আলম

ছিনতাইকারীকে গান শুনিয়েছিলাম

ছিনতাইকারীকে গান শুনিয়েছিলাম

কিছু সুর চির অম্লান, কিছু কণ্ঠ চির অমলিন। তেমনি এক কণ্ঠের জাদুকর একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। অসংখ্য কালজয়ী গানের শিল্পী তিনি। যিনি অডিও গান ও চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করে চলেছেন আজও।  বয়স এখন প্রায় ৭৫ বছর! শিল্পী জীবনের প্রাপ্তি অনেক। এখনো তিনি চিরতরুণ, উচ্ছল। এই গুণী শিল্পীর সঙ্গে জানা-অজানা নানা বিষয়ে কথা বলেছেন- পান্থ আফজাল

 

কেমন আছেন? জানা মতে, জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস চলছে। ঘটনাটা একটু খুলে বলবেন?

জি, মহান আল্লাহপাকের অশেষ রহমতে অনেক ভালো ও সুস্থ আছি। আর হ্যাঁ, সেকেন্ড ইনিংস তো অবশ্যই! গত বছর মার্চ মাসে আমার একটা এক্সিডেন্ট ঘটেছিল। মুসলমান হিসেবে তো বলা উচিত নয় পুনর্জন্ম। তবুও আমি স্বীকার করি, আমি দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি। প্রায় সাড়ে ৫ ঘণ্টা হাইওয়েতে পড়েছিলাম। মাথা কিন্তু দুই ভাগ, দাঁত একটাও নেই। তারপর সেখান থেকে হেলিকপ্টারে আমাকে নেওয়া হলো উত্তরবঙ্গে, আমার বাড়ি যেখানে। ব্যক্তিগতভাবে উত্তরবঙ্গের মানুষের সঙ্গে আমার বনিবনা হতো না অনেক আগে থেকেই। একবার বলেছিলাম, ‘আই হেইট নর্থবেঙ্গল পিপল’। সে জন্য মনে হয় আল্লাহপাক একটা থাপ্পড় মেরে দিয়েছেন। বলেছেন, লাইনে আয়! তারপরও আমি বলব, ঢাকার মানুষের জন্য আমি নিবেদিতপ্রাণ। কারণ তারা একবার বুক দিলে পিঠ দেয় না।

 

গাড়ি নেই। হেঁটে চলাফেরা করেন। এই বয়সে তো অনেক বিপদে পড়ার কথা। তাই না?

ক্লাসমেট অনেকে বিছানায় পড়ে আছে। কারও বুকে রিং, কারও পেসমেকার। গর্ব করছি না, আল্লাহ আমাকে সুস্থ রেখেছেন। আর আমি কিন্তু অল্পেই সন্তুষ্ট।

গাড়ি আমার হয়নি, সেটা অন্য বিষয়। তবে আমি কিন্তু ভীষণ রাফ টাইপের। একসময় সাংঘাতিক শখ ছিল চিফ অব স্টাফ হওয়ার।

 

একবার তো ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলেন?

সেটা অনেক মজার ব্যাপার। বেশির ভাগ সময় তো হেঁটে চলাফেরা করি। তো একবার পড়লাম ছিনতাইকারীর কবলে। ছিনতাইকারী ছিলেন সংগীতপ্রেমী। কোমরে অস্ত্র দেখিয়ে আমাকে শাসিয়ে বললেন, আপনাকে এখানে মেরে রেখে গেলে কিছুই করতে পারবেন না।

 

তবে আপনার একটা গান আমার অনেক ভালো লাগে। সেটি কি দুই লাইন গেয়ে শোনাবেন?

ছিনতাইকারীর এমন সংগীতপ্রীতি দেখে আমি তো রীতিমতো মুগ্ধ। তৎক্ষণাৎ গানটি গেয়ে শোনালাম। মজার বিষয়, ছিনতাইকারী আমাকে খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়েছিলেন। এটাই হচ্ছে সংগীতের শক্তি, বুঝলেন!

 

সম্প্রতি দেশটিভির ‘প্রিয়জনের গান’-এ অতিথি হয়ে এসেছিলেন। গান গেয়ে কেমন লেগেছে?

অনেক ভালো। অনেকদিন পর প্রিয় কিছু গান গেয়েছি। প্রায় ২৫টির মতো। আমি অনেক কৃতজ্ঞ এই অনুষ্ঠানটির প্রযোজক ওয়ালিদ হাসান, সঞ্চালক তাসনুভা মোহনা, মিউজিশিয়ান ও টেকনিক্যাল টিমের কাছে। সত্যি কথা বলতে কি, বহুদিন পর আমার মনের জমানো দুঃখ-বেদনা, ব্যথা, আনন্দ জড়ানো যে গানগুলো আমি গাইতে পারতাম না, সেসব উজাড় করে গেয়েছি। তবে ওপরওয়ালার কাছে আমি শোকর গোজার করি যে, মাত্র ৫টি গান আমি যেন সবসময় গাইতে পারি। যেমন- সংগ্রাম সংগ্রাম সংগ্রাম গানটির মানুষ কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন। তার খবর কেউ নিচ্ছেন না! কারণ কি, তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের! তাহলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে তাকে কেউ খোঁজ নেবে না? তারা কি আরেক দেশের লোক? এ বিষয় নিয়ে তো অনেক অঘটন হয়েছে। কেউ ডিসক্লোজড করতে চায় না। একজন করেছিলেন। তিনি গোবিন্দ হালদার। যে একজনকে লিরিক দিয়েছিলেন, যে কিনা নিজের নাম দিয়ে গানটি চালিয়ে দিয়েছেন। এটা কেমন কথা! এখন তো এমন ঘটনা অহরহ হচ্ছে। একেবারে যাচ্ছেতাই। গান করছে কেউ, সেখানে গীতিকার ও সুরকারের ক্রেডিট নেই। আমি যাই হই না কেন, গানটাকে ইবাদতের মতো দেখতে হবে।

 

প্রায় সব নায়কই আপনার গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন. তাই না?

সেই সোনালি যুগের চলচ্চিত্রের প্রায় সবাই বলা যায় আমার গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ঠোঁট মিলিয়েছেন নায়করাজ রাজ্জাক, ৬০%। বাকি ৪০% ওয়াসিম, জাভেদ, জাফর ইকবাল, মাহমুদ কলি, ইলিয়াস কাঞ্চন, আলমগীরসহ অনেকেই। সবার কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ। তবে, রাজ্জাক ভাইয়ের মতো মানুষ হয় না। পরিপূর্ণ একজন মানুষ। প্রথম ছবিটায় কেউ আমাকে শিল্পী হিসেবে মানতেই পারছিল না। এদিকে আজাদ রহমান সাহেবও বেঁকে বসলেন। এরপর রাজ্জাক সাহেব বললেন, ‘কাম টু মাই হাউস। কষ্ট করে যে লোক ওপরে ওঠে, সে অন্যের কষ্ট বোঝে।’ রাজ্জাক সাহেব কীভাবে রাগে, কথা বলার ঢংটা কেমন, হাসলে কীভাবে হাসেন, রোমান্টিক হলে কীভাবে কথা বলেনÑ এসব শেখালেন। তারপর বললেন, আমি তোমার গানে লিপসিং করব। এটাই ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। গীতিকার আমার চাচা, সুরকার আজাদ রহমান, গাইলাম ‘বন্দী পাখির মতো মনটা কেঁদে মরে’। একটা আলোড়ন সৃষ্টি হলো। সবচেয়ে বেশি কাজ করেছি আজাদ রহমান ও সত্য সাহার সুরে। খন্দকার নুরুল আলম সাহবের সুরে, সমরদা, আহাদ ভাই, এস এম রফিক সাহেবের সুরে, দেবুদা, আনোয়ার পারভেজসহ বহু সুরকারের সুরে গেয়েছি। মাত্র দুজনের সুরে সিনেমায় গাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। খান আতা ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।

 

মা, বোন-ভাই বিষয় নিয়ে অসংখ্য গান করেছেন...

মাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি গান করেছি; প্রায় ৫০টি চলচ্চিত্রে। একটি গান শুধু ভারতীয় গান। যেটি নায়করাজ রাজ্জাকের ‘চাপাডাঙ্গার বৌ’। ‘আমার সাধ না মিটিল...’। এটি ভারতীয় ঔপন্যাসিকের লেখা। এ বিষয়ে অবশ্য রাজ্জাক ভাইয়ের স্ত্রীর ডিমান্ড ছিল। একটা কথা বলা দরকার, বাংলাদেশের দুজন শিল্পীকে আমি সবচেয়ে বেশি ইজ্জত করি। এদের মধ্যে একজন হলেন সুবীর নন্দী আর অন্যজন সৈয়দ আবদুল হাদী।

 

এ সময়ের সংগীত প্রজন্ম কতখানি নিবেদিত?

তারা অনেক বেশি ট্যালেন্টেড, মেধাবী ও অত্যন্ত ফাস্ট। তবে তারা অভিভাবকহীন। যেন আমিই গীতিকার-কম্পোজার! আর একটা বিষয়ের বিরাট অভাব। তা হলো আদব-তমিজের।

সর্বশেষ খবর