রবিবার, ৫ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা
এক ঝলক

বনরুই থেকেই কী মহাবিপর্যয়!

করোনাভাইরাস উৎপত্তি!

বনরুই থেকেই কী মহাবিপর্যয়!

চীনে পাচার হওয়া মালয় প্রজাতির বনরুইয়ের মধ্যে করোনাভাইরাসের দুই ধরনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাসের সঙ্গে মিল আছে মানুষের শরীরে পাওয়া ‘কভিড-১৯’ এর। হংকং ইউনিভার্সিটির গবেষকদের বরাত দিয়ে বিবিসি এ তথ্য জানিয়েছে। চীনের উহান থেকে বাদুড়ের মাধ্যমে করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ ছড়িয়েছে বলে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিলেন অনেক গবেষক।

তবে বিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ন্যাচারের এক গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, বনরুই থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে।  চীনে পাচার হওয়া বনরুই-এ করোনাভাইরাসের দুই ধরনের

উপস্থিতি পেয়েছেন গবেষকরা। এরপরই নতুন মোড় নিয়েছে করোনার উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা। লিখেছেন- সাইফ ইমন

 

নিরীহ প্রাণী। দেখতে অদ্ভুত। ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তারা। মালয় ভাষায় এদের পেঙ্গুলিং বলা হয়। এদের ইংরেজি নাম প্যাঙ্গোলিন। আঁশযুক্ত শরীর নিয়ে বনজঙ্গলে চলাফেরা করা প্রাণীর নাম বনরুই। বিপদের আভাস পেলে আঁশের মতো শক্ত খোলের ভিতর শরীর গুটিয়ে নেয় তারা। সাধারণত প্রাণীকুলে পুরুষ প্রজননকালে স্ত্রীর খোঁজ করে। তবে বনরুইয়ের ক্ষেত্রে আলাদা। পুরুষ নিজের এলাকায় নির্দিষ্ট জায়গাজুড়ে প্রস্রাব ও মল দিয়ে চিহ্নিত করে এবং স্ত্রী বনরুই গন্ধ শুঁকে ওই এলাকায় পৌঁছায়। তুলনামূলক ওই এলাকাটি অনেক বড়। বনরুই গ্রীষ্মকালে জোড়া বাঁধে এবং ৭০ থেকে ১৪০ দিনে বাচ্চা প্রসব করে। এরা ১ থেকে ৩টি বাচ্চা প্রসব করে এবং প্রায় দুই বছর পর্যন্ত মায়ের তত্ত্বাবধানে চলাফেরা করে। প্রথম দুই থেকে চার সপ্তাহ গর্তেই অবস্থান করে। এরপর মায়ের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। প্রায় তিন মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ খাওয়ার পর দুধ ও পিঁপড়া-উইপোকা খাওয়া শুরু করে। জন্মের সময় থেকে ৩-৪ মাস বাচ্চার আঁশগুলো নরম থাকলেও পরবর্তী সময়ে শক্ত হয়ে যায়। বনরুইয়ের নখর অত্যন্ত শক্তিশালী, যা দিয়ে গাছের বাকল ও উইয়ের ঢিবি ভেঙে ফেলে। বাচ্চা নিয়ে তখন এরা ভূরিভোজ করে। নিশাচর এ প্রাণীর ঘ্রাণশক্তি প্রখর, দৃষ্টিশক্তি তুলনামূলক কম। উইপোকা নিধনে এদের জুড়ি নেই। স¤প্রতি চীনে পাচার হওয়া মালয় প্রজাতির বনরুইয়ের মধ্যে করোনাভাইরাসের দুই ধরনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাসের সঙ্গে মিল আছে মানুষের শরীরে পাওয়া ‘কভিড-১৯’ এর।

 

হংকং ইউনিভার্সিটির গবেষকদের বরাত দিয়ে বিবিসি এ তথ্য জানিয়েছে। চীনর উহান থেকে বাদুড়ের মাধ্যমে করোনাভাইরাস বা কভিড-১৯ ছড়িয়েছে বলে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিলেন অনেক গবেষক। তবে বিখ্যাত মেডিকেল জার্নাল ন্যাচারের এক গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, বনরুই থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। হংকং ইউনিভার্সিটির গবেষক টমি ল্যাম বিবিসিকে বলেন, চোরাইপথে আসা মালয় প্রজাতির বনরুইয়ে এ ভাইরাস পাওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে, এই প্রজাতির বনরুইয়ের শরীরে ভাইরাস ঢুকল কীভাবে? পাচারের সময় আশপাশে থাকা বাদুড় থেকে এসেছিল, নাকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের যে প্রাকৃতিক আবাসস্থল সেখানেই ঘটেছিল? তিনি আরও বলেন, মানুষের মধ্যে রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকির ক্ষেত্রে বনরুইয়ের ভূমিকা বুঝতে হলে আরও পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা প্রয়োজন। যদিও ‘সার্স কোভ ২’ এর প্রাদুর্ভাবের সরাসরি ‘হোস্ট’ হিসেবে বনরুইয়ের ভূমিকা আরও নিশ্চিত হওয়ার দরকার আছে। তবে ভবিষ্যতে যদি এ রকম প্রাণী থেকে মানুষে মহামারী ছড়ানো ঠেকাতে হয়, তাহলে বাজারে এসব প্রাণীর বিক্রি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত।

ইকো হেলথ অ্যালায়েন্সের প্রেসিডেন্ট পিটার ডাসক নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, বনরুইয়ের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়া মহামারীর সম্পর্ক রয়েছে। মার্কিন এ প্রতিষ্ঠানটি বন্যপ্রাণী থেকে ছড়িয়ে পড়া রোগবালাই নিয়ে গবেষণা করে থাকে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাদুড়ের দেহেও করোনাভাইরাস আছে এবং তার সঙ্গে মানুষের দেহে সংক্রমিত ভাইরাসের আরও বেশি মিল আছে। কিন্তু একটি অংশ, যা মানুষের দেহের কোষ ভেদ করে ভিতরে ঢুকতে ভাইরাসটিকে সহায়তা করে, তার সঙ্গে এর মিল নেই। সহ-গবেষক সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাডওয়ার্ড হোমস বলেন, এর অর্থ হলোÑ বন্যপ্রাণীদের মধ্যে এমন ভাইরাস আছে, যা মানুষকে সংক্রমিত করার ক্ষেত্রে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে।

তিনি বলছেন, ‘করোনাভাইরাসের সঙ্গে বাদুড়ের নিশ্চয়ই সম্পর্ক আছে, হয়তো প্যাঙ্গোলিনও সম্পর্কিত, তবে অন্য কোনো প্রাণীর জড়িত থাকারও জোর সম্ভাবনা আছে।’ ঠিক কীভাবে ভাইরাসটি একটি জন্তুর দেহ থেকে বেরিয়ে অন্য একটি প্রাণীর দেহে এবং তারপর সেখান থেকে মানুষের দেহে ঢুকল, তা এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে রহস্য হয়েই রয়েছে। আইএফএডব্লিউ জানিয়েছে, নিরীহ বনরুই মেরে তা থেকে হাতুড়ে চিকিৎসকরা ওষুধ তৈরি করে। সেই কারণে এর চাহিদা বেশি। ফলে বনরুই (প্যাঙ্গোলিন) ক্রমশ অবলুপ্তির দিকে। বনরুইয়ের মতো প্রাণীগুলো প্রকৃতির জন্য আশীর্বাদ। কেননা প্রতিনিয়ত এরা পিঁপড়া ও উইপোকা খেয়ে প্রকৃতির সুস্থতা রক্ষা করছে, অর্থের সাশ্রয় করছে। এদের নিশ্চিহ্ন করার প্রবণতার কারণেই উইপোকার বিস্তার ও আক্রমণ বেড়ে গেছে। বাড়িঘরে ১৪-১৫ তলায়ও উইপোকার আগ্রাসন। বনরুই একবার বিলুপ্ত হয়ে গেলে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। কেননা প্রকৃতিতে Reintroduction -এর জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয় তার কোনোটাই এদের জন্য সম্ভব নয়। যেমন আবদ্ধ অবস্থায় এরা প্রজনন করে না। কেননা এদের প্রাকৃতিক Homerange বৃহৎ এলাকাজুড়ে। এরা পিঁপড়া ও উইপোকার নির্দিষ্ট প্রজাতির ওপর নির্ভরশীল, অন্য কিছুর ওপর কখনই আকৃষ্ট নয়। একটি বনরুই প্রতিদিন ১৪০ থেকে ২০০ গ্রাম নির্দিষ্ট প্রজাতির পিঁপড়া ও উইপোকা খেয়ে থাকে। এ ছাড়া আমরা এটাও জানি পতঙ্গভূক প্রাণীর Captive breeding প্রায় অসম্ভব।  এ ক্ষেত্রে বনরুই তো খাদ্যাভ্যাসের দিক থেকে একেবারে স্বতন্ত্র।

সর্বশেষ খবর